ক্রিকেট-জুয়ার তদন্তে ক্রমশ জাল গোটাচ্ছে পুলিশ। রবিবার দিল্লি পুলিশের জালে ধরা পড়লেন আরও দুই রঞ্জি ক্রিকেটার। গ্রেফতার হয়েছে দুই বুকিও। শ্রীসন্ত-চান্ডিলাদের আজ আরও এক দফা জেরা করে পাওয়া তথ্যের ভিত্তিতে ইতিমধ্যেই দেশের বিভিন্ন প্রান্তে গিয়েছে দিল্লি পুলিশের একাধিক দল।
পুলিশের পাশাপাশি সক্রিয় হয়েছে ভারতীয় ক্রিকেট কন্ট্রোল বোর্ডও। রবিবার বোর্ডের জরুরি বৈঠকে বার্তা দেওয়া হয়েছে, আইপিএলের প্লে-অফ পর্যায় থেকেই ক্রিকেট জুয়া ঠেকাতে কড়া পদক্ষেপ করা হবে। সেই মতো একাধিক সিদ্ধান্তের কথা জানানোও হয়েছে।
রবিবার মুম্বই থেকে ধরা পড়া মণীশ গুড্ডেওয়ার ও বাবুরাও যাদব যথাক্রমে বিদর্ভ ও রেলওয়েজের হয়ে কয়েক বছর আগেও ক্রিকেট খেলেছেন বলে জানিয়েছে পুলিশ। ধরা পড়েছেন দুই বুকি সুনীল ও কিরণ। ধৃত বুকি এবং ক্রিকেটারদের টেলিফোন রেকর্ড থেকেই এই চার জনের হদিস পাওয়া যায় বলে দিল্লি পুলিশের তরফে জানানো হয়েছে।
এ দিনও দিল্লি পুলিশের স্পেশ্যাল সেলের অফিসারেরা সকাল থেকে দফায় দফায় জেরা করেন শ্রীসন্ত, চান্ডিলা ও অঙ্কিত চহ্বাণকে। সোমবারই শ্রীসন্তদের পুলিশি হেফাজতে রাখার মেয়াদ শেষ হচ্ছে। পুলিশের তরফে জানানো হয়েছে, সোমবার তিন ক্রিকেটার জামিনের আবেদন করার আগে যত বেশি সম্ভব তথ্য জোগাড় করাটাই তাঁদের প্রধান লক্ষ্য। জামিনের বিরোধিতায় অভিযুক্তদের বিরুদ্ধে সব নথিপত্র নিয়ে কোর্টে হাজির থাকতে চাইছে পুলিশ।
আজ তিন ক্রিকেটারকে পাশাপাশি বসিয়ে জেরার সময় শ্রীসন্ত, চান্ডিলা ও অঙ্কিত চহ্বাণ একে অন্যের উপর দোষ চাপানোর চেষ্টা করেন বলে পুলিশ সূত্রের খবর। একটা সময় তিন জনের মধ্যে তর্কাতর্কিও শুরু হয়ে যায়। পরে জিজু-সহ চার বুকির সঙ্গে মুখোমুখি বসিয়ে জেরা করা হয় শ্রীসন্তদের। তাতে অনেক নতুন তথ্য পাওয়া গিয়েছে বলে দাবি পুলিশের। |
• দিনভর জেরা শ্রীসন্ত, চান্ডিলা, অঙ্কিতকে
• ক্রিকেটারদের সঙ্গে যোগাযোগ রাখতেন চান্ডিলা
• জুয়ার টাকায় আড়াই লাখে দু’টি জিনস কেনেন চান্ডিলা
• ইডেনে কেকেআর-রাজস্থান ম্যাচেও সক্রিয় ছিল বুকিরা
• শ্রীসন্তদের বিরুদ্ধে রাজস্থান রয়্যালস এফআইআর করবে |
|
পুলিশের দাবি, জেরার মুখে তিন বুকি চন্দ্রেশ, জিজু ও মণীশ জানিয়েছেন যে, ক্রিকেটারদের সঙ্গে যোগাযোগ রাখা ও তাঁদের টাকাপয়সা পৌঁছে দেওয়ার দায়িত্বে ছিলেন অজিত চান্ডিলা। তবে করাচিতে বসে থাকা আনিস ইব্রাহিম এবং টাইগার মেমনের সঙ্গে টাকাপয়সা সংক্রান্ত যোগাযোগ মূলত তাঁরাই রাখতেন। জেরায় চান্ডিলা জানিয়েছেন, স্পট-ফিক্সিংয়ের টাকায় তিনি প্রায় আড়াই লক্ষ টাকা খরচ করে দু’টি জিন্স প্যান্ট কেনেন। দামি ব্র্যান্ডের জামা, ঘড়িও ওই টাকায় কিনেছেন। যা দেখে তার স্ত্রী এবং বাড়ির লোকেরা এক সময় অবাক হয়ে যান। একটি সূত্রের বক্তব্য, পুলিশের হাতে ধরা পড়ার সময় নিজেকে কেরল এবং মহারাষ্ট্রের মুখ্যমন্ত্রীর ঘনিষ্ঠ পরিচয় দিয়ে গ্রেফতারি এড়ানোর চেষ্টা করেছিলেন শ্রীসন্ত। যদিও দিল্লি পুলিশ সে সবে পাত্তা না দিয়ে শ্রীসন্তকে সরাসরি নিজেদের গাড়িতে তুলে নেয়।
ক্রিকেটারদের জেরা করে পাওয়া তথ্যের ভিত্তিতে দেশের বেশ কয়েকটি জায়গায় ছড়িয়ে পড়েছে দিল্লি পুলিশের একাধিক দল। দিল্লি ছাড়াও কলকাতা, মুম্বই, হায়দরাবাদ, চণ্ডীগড়, চেন্নাই, পুণে, জয়পুর ও বেঙ্গালুরুর যে সব হোটেলে আইপিএলের দলগুলো থাকত, শহরের যে সব রেস্তোঁরা, শপিং মলে ক্রিকেটাররা ঘুরে বেড়াতেন, যেখানে যেখানে বুকিদের সঙ্গে পার্টিতে যোগ দিতে যেতেন প্রতিটি জায়গা থেকে ক্লোজড সার্কিট টিভির ফুটেজ সংগ্রহ করা হচ্ছে। যে সব বড় দোকান থেকে জামাকাপড়, ইলেকট্রনিক সরঞ্জাম কিনেছেন ধৃত তিন ক্রিকেটার, সিসিটিভি-র ফুটেজ থেকে সেই সব কেনাকাটার ছবিও জোগাড় করার চেষ্টা চালানো হচ্ছে। এই সব কিছুই প্রমাণ হিসেবে আদালতে পেশ করতে চায় পুলিশ।
গোয়েন্দা সূত্রের খবর, এ দিনই কলকাতার দু’টি পাঁচতারা হোটেলে দিল্লি পুলিশের তদন্তকারী দল গিয়ে সিসিটিভি ফুটেজ এবং হোটেলের রেজিস্টার চেয়েছে। ওই দু’টি হোটেলেই আইপিএল-এর বিভিন্ন দলের খেলোয়াড়েরা উঠতেন। কেন্দ্রীয় গোয়েন্দাদের মাধ্যমে (আইবি) প্রচুর ফোন রেকর্ডও খতিয়ে দেখবে দিল্লি পুলিশ। বিশেষ করে ‘জুনিয়র কলকাতা’ নামে এক বুকির সঙ্গে কলকাতার কোনও জুয়াড়ির যোগ রয়েছে কি না, তা দেখা হবে। পুলিশ সূত্রের খবর, ‘জুনিয়র কলকাতা’র একাধিক এজেন্ট কলকাতায় কাজ করত। এর আগে এক বার আইপিএলের সময় তাঁদের গ্রেফতারও করেছিল পুলিশ। তাঁরা এ বারের আইপিএলেও সক্রিয় কি না, তা দেখছেন তদন্তকারীরা।
গোয়েন্দারা জানতে পেরেছেন, এ বারের আইপিএল-এ ইডেনে কেকেআর-রাজস্থান ম্যাচেও সক্রিয় ছিল বুকিরা। কিন্তু অঙ্কিত ও অজিতকে সেই ম্যাচে খেলানোই হয়নি। ফলে বুকিদের বহু টাকা লোকসান হয় বলে জানতে পেরেছেন গোয়েন্দারা। ওই ম্যাচে কোন কোন বুকি মাঠে এসেছিল এবং কাকে কত টাকা দেওয়া হয়েছিল, তা এখন খুঁজে বের করতে চাইছে পুলিশ।
এ দিন সকালেই দিল্লি পুলিশ জানতে পারে, ধৃত তিন ক্রিকেটারের বিরুদ্ধে দিল্লি পুলিশের কাছে আলাদা করে এফআইআর করবে রাজস্থান রয়্যালস। দিল্লি পুলিশের তদন্তকারী দলের নেতা এস এন শ্রীবাস্তব এই খবরে রীতিমতো উচ্ছ্বসিত। তাঁর কথায়, “দলের তরফে ওদের বিরুদ্ধে এফআইআর করা হলে এই মামলায় পুলিশের হাত আরও মজবুত হবে।”
মুম্বই পুলিশ ইতিমধ্যেই শ্রীসন্তের ল্যাপটপে বেশ কয়েক জন মডেল এবং কয়েক জন উঠতি বলিউড নায়িকার প্রচুর ছবি পেয়েছে। গুড়গাঁওয়ের এক হোটেলের সিসিটিভি ফুটেজে শ্রীসন্ত ও অজিত চান্ডিলাকে বেশ কয়েক জন মহিলা এসকর্টের সঙ্গে দেখা গেছে। পুলিশের সন্দেহ, বুকিরা ক্রিকেটারদের স্পট-ফিক্সিংয়ে টানতে নানা ভাবে মধুচক্রে জড়িয়ে দিত।
দিল্লি পুলিশের এক কর্তা আজ জানান, স্পট-ফিক্সিং নিয়ে প্রথম যে অফিসার তদন্ত শুরু করেছিলেন, সেই বদ্রীশ দত্ত চলতি মাসের গোড়ায় কেন আত্মহত্যা করেছিলেন, তার কিছুটা হদিশ মিলেছে। পুলিশের ধারণা, আন্ডারওয়ার্ল্ডের চাপেই তিনি আত্মহত্যা করেন।
এই পরিস্থিতিতে সক্রিয় হয়েছে কেন্দ্রীয় ক্রীড়া মন্ত্রকও। সব খেলাতেই গড়াপেটা রুখতে কঠোর আইন আনা নিয়ে আজ কেন্দ্রীয় ক্রীড়ামন্ত্রী জিতেন্দ্র সিংহের সঙ্গে দীর্ঘ পরামর্শ করেন কেন্দ্রীয় আইনমন্ত্রী কপিল সিব্বল। পাশাপাশি বোর্ড দিল্লি পুলিশের কর্তাদের জানিয়েছে যে, তারা নিজেদের মতো করে গোটা ঘটনার তদন্ত করতে চায়। এ জন্য বোর্ডের দুর্নীতি দমন শাখার প্রধান রবি সাওয়ানিকে মামলা সম্পর্কে বিস্তারিত জানতে দিল্লি পুলিশের কাছে পাঠানো হচ্ছে।
|