বামফ্রন্ট সরকার তাহার শাসনের প্রথম দুই বৎসরে ৭৩০ দিন পাইয়াছিল। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় এক দিন বাড়তি পাইয়াছেন। তাহাতে অবশ্য বিশেষ লাভ হয় নাই। ৭৩১ দিনই কথায় কাটিয়াছে। অবান্তর কথা। কখনও মুখ্যমন্ত্রী বলিয়াছেন, কখনও তাঁহার পারিষদরা। কখনও তদন্ত শুরু হইবার পূর্বেই মুখ্যমন্ত্রী সিদ্ধান্ত ঘোষণা করিয়া দিয়াছেন, কখনও কেহ মুখ খোলামাত্রই বুঝিয়া লইয়াছেন তাঁহার রাজনৈতিক পরিচয়। তাঁহার কোনও পারিষদ বিরোধীদের সর্পবৎ ঘৃণা করিবার পরামর্শ দিয়াছেন। অন্য এক জন লগ্নি সংস্থার এজেন্ট সম্মেলনের মঞ্চে দাঁড়াইয়া যে কোনও বিপদে তাঁহাদের পার্শ্বে থাকিতে প্রতিশ্রুত হইয়াছেন। বাক্স্বাধীনতা মানুষের মৌলিক অধিকার। কিন্তু বিবেচনাবর্জিত হওয়া সম্ভবত নেতাদের অধিকারের তালিকাভুক্ত নহে। কথার তোড়ে অনেক কিছুই ভাসিয়া গিয়াছে। রাজ্যের অভিভাবকদের নিরপেক্ষতার ভরসা, প্রশাসনের প্রতি আস্থা, সমাজের অভ্যন্তরীণ বিশ্বাস ক্ষতির তালিকাটি দীর্ঘ। এত কথার প্রয়োজন ছিল না। মমতাদেবী তাঁহার মুখ্যমন্ত্রিত্বের তৃতীয় বৎসরে অভ্যাস পরিবর্তন করুন। অবান্তর কথা তাঁহাদের যে ক্ষতি করিতেছে, বাক্সংযম তাহার তুলনায় ঢের কম করিবে।
কথা কম বলিলে সময় বাঁচিবে। সেই সময় লইয়া শাসকরা কী করিবেন? কাজ করিয়া দেখিতে পারেন। একটি নির্দিষ্ট লক্ষ্যে কাজ। এক বছরে নব্বই শতাংশ কাজ করিবার কোনও প্রয়োজন নাই, বরং যে কাজগুলির অগ্রাধিকার প্রাপ্য, সেগুলিতে মনঃসংযোগ করুন, এবং একশো শতাংশ নিষ্ঠা সহকারে করুন। তাহা হইলেই রাজ্যের মঙ্গল হইবে। কাজ কী কী, তাহার তালিকা রচনা নিষ্প্রয়োজন। কিন্তু যে কাজটির কথা আলাদা করিয়া বলা দরকার তাহার নাম শিল্পায়ন। সিঙ্গুরের শবসাধনায় এই সরকারের জন্মলগ্নটি বাঁধা। সেই অভিশাপ মুছিতে হইলে শিল্পায়নকে বিশেষ গুরুত্ব দেওয়াই বিধেয়। তদুপরি, শিল্পায়ন ভিন্ন পশ্চিমবঙ্গের প্রকৃত উন্নতি সম্ভব নহে। অথচ, গত দুই বৎসরে শিল্পায়নের সম্ভাবনা বাড়িয়াছে, এমন দাবি মুখ্যমন্ত্রী করিতেই পারেন, আটকায় কে? কিন্তু তাঁহার শিল্পমন্ত্রীও সেই দাবি শুনিয়া মনে মনে সঙ্কোচ বোধ করিবেন কি না, তাহা তিনিই জানেন। শিল্পে উৎসাহ দানের জন্য সরকার কিছু করে নাই, ইহা গৌণ। মুখ্য ইহাই যে, শিল্পকে নিরুৎসাহ করিবার জন্য সরকার যৎপরোনাস্তি চেষ্টা করিয়াছে। এক দিকে জমি অধিগ্রহণ এবং এস ই জেড প্রশ্নে সরকারের তথা মুখ্যমন্ত্রীর ধনুর্ভঙ্গ অনমনীয়তা, অন্য দিকে তাঁহার অর্থমন্ত্রীর পণ্য প্রবেশ করের রক্তচক্ষু, তাহার উপর সামগ্রিক অশাসন এবং তোলাবাজির ব্যাধি তো স্বপ্রকাশ। দুই বৎসর পূর্তিতে যে নূতন ‘খসড়া শিল্পনীতি’ সরকার প্রকাশ করিল, তাহাতেও এই বিষয়ে যথার্থ পরিবর্তনের কিছুমাত্র আশা মিলিল না। অর্থাৎ দ্বিবার্ষিকীতে রাজ্যবাসীর ভরসা কিছুই নাই। রাজ্যপাট যাঁহারা চালাইতেছেন, তাঁহাদের ফুর্তি অবশ্য অফুরন্ত। |