সম্পাদকীয় ১...
বিলম্বিত, যথারীতি
ভারতীয় কমিউনিস্ট পার্টির (মার্ক্সবাদী) কেন্দ্রীয় কমিটির মনে হইয়াছে, ফাঁসি বা মৃত্যুদণ্ড রদ করিয়া দেওয়াই সঙ্গত। এমনকী বিরলতম ও জঘন্যতম অপরাধের শাস্তি হিসাবেও যাবজ্জীবন সশ্রম কারাদণ্ডই উপযুক্ত। এই ‘বোধোদয়’-এর কথা কেন্দ্রীয় কমিটিতে আলোচনার পর দলের শীর্ষ নেতা প্রকাশ কারাট নিজেই জানাইয়াছেন। মানবাধিকার আন্দোলনের শিবির হইতে এবং প্রগতিশীল ছাত্র সংগঠনগুলির তরফেও ক্রমাগত মৃত্যুদণ্ডের যৌক্তিকতা বিষয়ে বিবিধ সংশয়, জিজ্ঞাসা ও সমালোচনা সি পি আই এম নেতৃত্বের উদ্দেশে ধাবিত হইতেছিল। কমিউনিস্টরা যে সকল দেশে ক্ষমতাসীন, সেখানে সচরাচর মৃত্যুদণ্ড যে জলভাত, তাহার প্রেক্ষিতেই ভারতের মতো দেশে মার্ক্সবাদীদের এই প্রশ্নে কী অবস্থান হওয়া উচিত, প্রশ্নটি ছিলই। এ বার মৃত্যুদণ্ড রদের পক্ষে রায় দিয়া কমিউনিস্ট নেতৃত্ব দীর্ঘ দিনের একটি বিভ্রান্তি দূর করিতে সচেষ্ট হইলেন।
প্রশ্ন তবু থাকিয়াই যায়। কার্ল মার্ক্স নিজে মৃত্যুদণ্ডের পক্ষপাতী ছিলেন না। তথাপি তাঁহার মতাদর্শে দীক্ষিত কমিউনিস্টরা দেশে- দেশে শাসনক্ষমতা হাসিল করা মাত্র ‘মেনশেভিক’, ‘সোশালিস্ট রেভলিউশনারি’, ‘পুঁজিবাদী পথের অনুতাপহীন পথিক’, ‘সিআইএ-র গুপ্তচর’ বা নিছক শ্রেণিশত্রু রূপে চিহ্নিত করিয়া হাজার-হাজার, এমনকী রাশিয়া, চিন, কম্বোডিয়া প্রভৃতি দেশে লক্ষ লক্ষ বিরুদ্ধবাদীকে হত্যা করিয়াছেন। এ সকল যদি মোটের উপর বিংশ শতাব্দীর ইতিহাসের অঙ্গ হইয়া গিয়া থাকে, তবে এই একবিংশ শতাব্দীতেও মৃত্যুদণ্ডের স্বীকৃতি এবং রূপায়ণে প্রবল ভাবে ধ্বজা তুলিয়া রাখিয়াছে ‘গণপ্রজাতন্ত্রী’ চিন, যেখানে এখনও কথায় কথায় মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হয়। মাওবাদী পার্টি দেংবাদী পার্টিতে পরিণত হইবার পরে একটি সূক্ষ্ম পরিবর্তন অবশ্য ঘটিয়াছে মৃত্যুদণ্ডে দণ্ডিতদের অপরাধের তালিকায় রাজনৈতিক বিরোধিতার স্থানে অর্থনৈতিক দুর্নীতির প্রাদুর্ভাব বাড়িয়াছে। ইহাও চিনের অর্থনৈতিক বিপ্লবের একটি প্রমাণ বইকী।
ভারতের মতো তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলিতে মার্ক্সবাদীরা ইয়োরোপীয় মার্ক্সবাদীদের প্রতি আনুগত্যের সূত্রে (যে-আনুগত্যও এক ধরনের ঔপনিবেশিক দাসত্বেরই সূচক) মৃত্যুদণ্ডকে প্রায় কখনওই প্রতিবাদযোগ্য গণ্য করেন নাই। পরে ইউরোপ সমাজতন্ত্র, তথা ফলিত মার্ক্সবাদকে বর্জন করিলে এই বিষয়ে চিনা কমিউনিস্টদের অনুসরণই তাঁহাদের কৃত্য হয়। চিনারা যখন মৃত্যুদণ্ড বহাল রাখিয়াছেন, তখন তাহা আপত্তিকর হইতে পারে কী রূপে? তাই মার্ক্সবাদী-শাসিত পশ্চিমবঙ্গেও কিশোরী ধর্ষণ ও হত্যার দায়ে মৃত্যুদণ্ডে দণ্ডিত ধনঞ্জয় চট্টোপাধ্যায়ের ফাঁসির পক্ষে তৎকালীন শাসকদের এবং তাঁহাদের পরিমণ্ডলের কাহাকে কাহাকেও জোরালো সওয়াল করিতে দেখা যায়। বস্তুত, সেই সওয়াল ক্ষেত্রবিশেষে নিছক মৃত্যুদণ্ডের সমর্থনে সীমিত না থাকিয়া দণ্ডাজ্ঞার উচ্ছ্বসিত উদ্যাপনে পরিণত হইয়াছিল।
ত্রিধাবিভক্ত ভারতীয় কমিউনিস্ট আন্দোলনের সর্বাপেক্ষা জঙ্গি ও অগ্নিবর্ষী অংশটি অবশ্য ‘শ্রেণিশত্রুর রক্তে হাত না রাঙাইলে প্রকৃত কমিউনিস্ট হওয়া যায় না’ জাতীয় স্লোগানে রাজ্যের সকল দেওয়াল দাগাইয়া দিয়াছিল। ওই দায়িত্বজ্ঞানহীন ‘শিশুসুলভ বিশৃঙ্খলা’র সাময়িক মেয়াদ পূর্ণ হইলে যে ভদ্রস্থ ও সাংবিধানিক মার্ক্সবাদীরা রাজ্যে নির্বাচিত হইয়া আসেন, তাঁহারাও সম্ভবত চিনা অনুশীলনের মায়ায় আটকা পড়িয়া মৃত্যুদণ্ডের প্রতি তাঁহাদের সমর্থন অব্যাহত রাখেন। বিশ্বের ৯৭টি দেশ যখন চরম দণ্ড হিসাবে ইহা তুলিয়া দিয়াছে, তখন ভারতীয় কমিউনিস্টদের পক্ষে ইহার প্রতি সমর্থন অটুট রাখা অস্বস্তিকর ঠেকিয়া থাকিবে। তবে কিনা মার্ক্সবাদীদের সব বিষয়েই ‘উপলব্ধি’তে পৌঁছাইতে কিঞ্চিৎ বিলম্ব হয়। চিনা কমিউনিস্টরা যেমন ফরাসি বিপ্লবের দুই শত বৎসর পরেও তাহার মূল্যায়নের ‘সময় হয় নাই’ বলিয়া মনে করিতেন। ভারতীয় মার্ক্সবাদীরা তাঁহাদের ‘জনযুদ্ধ’ তত্ত্ব খারিজ করিতে কিংবা সুভাষচন্দ্রকে হিটলার-তোজো-র সাম্রাজ্যবাদী অনুচর রূপে মূল্যায়নের ‘ভ্রান্তি’ অপনোদন করিতে অর্ধ শতাব্দীর বেশি কাটাইয়া দেন। মৃত্যুদণ্ড যে কোনও ‘মার্ক্সবাদী’ নিদান নয়, তাহা বুঝিতেও না-হয় একটু দেরিই হইল।


First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.