বোলান গঙ্গোপাধ্যায়ের চিঠি (২৪-৪) এবং সুভাষ মণ্ডলের চিঠি (২৯-৪)-এর পরিপ্রেক্ষিতে বলা যায়, বোলান যেমন কিছু ভুল লেখেননি, আবার সুভাষবাবুও অনেকটা ঠিকই লিখেছেন। তবে এক জন প্রাক্তন ব্যাঙ্ক কর্মী হিসেবে কিছু কথা জানাতে চাই।
১) শহরে কাছেপিঠে একাধিক ব্যাঙ্ক থাকলেও গ্রামেগঞ্জে গড়ে ৪/৫ কিমি অন্তর একটা ব্যাঙ্ক পাওয়া যায়। সেই শাখায় কর্মী-সংখ্যা প্রায়শই ৪/৫ জনের বেশি থাকে না। সেখানে হরেক রকমের কাজ ওই ৪/৫ জনের উপর ন্যস্ত থাকে। যেমন, স্কুল-কলেজ কর্মীদের বেতন, পেনশন, ছাত্রদের হস্টেল গ্র্যান্ট খাতা, বার্ধক্য ও বিধবা ভাতা, ১০০ দিনের খাতা, কিসান ক্রেডিট কার্ড, পঞ্চায়েত ও স্থানীয় প্রতিষ্ঠানের খাতা, রাজ্য ও কেন্দ্রীয় সরকারের বিভিন্ন প্রকল্প সংশ্লিষ্ট খাতা, স্বনির্ভর গোষ্ঠীর জমা ও ঋণের খাতা ইত্যাদি। তার পর ব্যাঙ্কের নিজস্ব কাজ, অডিট, রিপোর্ট-রিটার্ন ইত্যাদি। এত সব সামলে তার পর নতুন অ্যাকাউন্ট খোলার কাজ। তবে অ্যাকাউন্ট খোলার দু’তিন রকম ট্যাবুলার ফর্ম ঠিক মতো পূরণ করে, সব রকম প্রমাণপত্র ও পরিচয়পত্রসমেত যাঁরা ব্যাঙ্কে আসেন, এ রকম অনেক অ্যাকাউন্ট রোজই সব ব্যাঙ্কে খোলা হয়। কিন্তু সমস্যা হয়, যাঁরা এই সমস্ত ফর্ম নিজেরা পূরণ করতে পারেন না তাঁদের নিয়ে। কারণ, মুষ্টিমেয় ব্যাঙ্ক কর্মচারীর পক্ষে লেখালিখি করে দেওয়ার মতো সময় থাকে না। আবার অনেকে সাপোর্টিং ডকুমেন্টস ঠিক মতো আনতে পারেন না। যেমন ভোটার কার্ডে নাম ধরা যাক, লক্ষ্মণ দাস। অথচ ঠিকানার প্রমাণপত্রে নাম লক্ষ্মণচন্দ্র দাস। তাকে হয়তো এফিডেভিট করে আনতে বলা হল। কোনও বিবাহিতা মহিলার ভোটার কার্ডে পদবি আগেকার। আবার কারও স্থায়ী ঠিকানা মেদিনীপুরের। রেশন কার্ডেও তাই। অথচ খাতা খুলতে চান কলকাতার ব্যাঙ্কে। সেই অস্থায়ী ঠিকানার কোনও প্রমাণপত্র নেই। তাঁকে তা আনতে বলা হল। এঁরা এগুলোকে হ্যারাসমেন্ট মনে করেন। অথচ এত জালিয়াতির ঘটনা ঘটছে, সব কিছু ঠিকঠাক না-থাকলে দায় ব্যাঙ্কের উপরেই বর্তাবে। তা ছাড়া, কে ওয়াই সি নর্মস মানাও বাধ্যতামূলক। আবার কেউ হয়তো স্থায়ী আমানতে ১৫ জি/এইচ দিলেন না, টি ডি এস কাটা গেল। পরে এসে জানতে পারলেন। তাঁকে বোঝানো মুশকিল। এ ছাড়া আছে লিঙ্ক প্রবলেম, কর্মী অনুপস্থিতি ইত্যাদি। সব মিলিয়ে গ্রাহকদের লেনদেনে বেশ কিছু সময় লেগেই যায়। খেটে-খাওয়া মানুষ ঘন ঘন ব্যাঙ্কে এতটা সময় দিতে পারেন না। |
২) দৈনিক জমার স্কিম সব রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাঙ্কে আগেই ছিল। পরে তা অধিকাংশ ব্যাঙ্ক তুলে দিতে বাধ্য হয়েছে। আমরা বলতাম, ‘মিনি ডিপোজিট’। এজেন্টরা আমানতকারীদের বাড়ি বাড়ি গিয়ে টাকা জমা নিতেন এবং প্রতিদিনের সংগ্রহ, নিয়মমাফিক পরবর্তী কাজের দিনে ব্যাঙ্কে গিয়ে জমা করতেন। নির্দিষ্ট হারে কমিশন পেতেন। কিন্তু সামান্য কমিশনে খুশি না-থেকে তাঁদের একটা অংশ দিনের সংগ্রহ দিনে জমা না-দিয়ে নিজেদের কাছেই রেখে একেবারে চার-পাঁচ দিনের টাকা ব্যাঙ্কে জমা করতেন। এই ভাবে ওই কিছু সংখ্যক এজেন্ট আইনের তোয়াক্কা না-করে গ্রাহকদের মোটা টাকা হাতিয়ে নিয়ে নিরুদ্দেশ হয়ে পড়তে শুরু করলেন। অথচ স্বাভাবিক ভাবেই জমার রসিদ দেখিয়ে আমানতকারীরা ব্যাঙ্কের কাছে টাকা দাবি করলেন। তখন দোষী এজেন্টের বিরুদ্ধে আইনমাফিক অ্যাকশন নেওয়া শুরু হল। আর এ দেশের আইনের দীর্ঘসূত্রিতা তো সবাই জানেন। আবার যে এজেন্টরা দায়িত্ব নিয়ে ভাল ভাবে কাজ করছিলেন, তাঁরা স্থায়ী চাকরি চেয়ে বসলেন। যেটা ব্যাঙ্ক কর্তৃপক্ষের পক্ষে মেনে নেওয়া সম্ভব ছিল না। এই ভাবেই মিনি ডিপোজিট প্রকল্পটি বন্ধ করে দিতে অধিকাংশ রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাঙ্ক কর্তৃপক্ষ বাধ্য হন।
তবে বর্তমানে বেশ কিছু ব্যাঙ্ক মফস্সলের বিভিন্ন শাখায় বিজনেস করেস্পনডেন্ট নিয়োগ করেছে, যাঁরা বিশেষ এক ধরনের কম্পিউটার-যুক্ত মেশিন নিয়ে গ্রামে গ্রামে গিয়ে সাধারণ গ্রাহকদের আর্থিক লেনদেনের কাজ সম্পন্ন করছেন। এই পদ্ধতি এখনও পর্যন্ত ফুল প্রুফ রয়েছে। গ্রাহকদেরও পাশ বইয়ে এন্ট্রিটা দেখে নেওয়া দরকার। মেশিনটি ইন্টারনেটের মাধ্যমে ব্যাঙ্কের মূল সার্ভারের সঙ্গে যুক্ত থাকে।
আশা করছি, মফস্সল শাখাগুলিতে প্রয়োজনভিত্তিক বিজনেস করেস্পনডেন্ট নিয়োগ করে এলাকার ব্যাঙ্কিং চাহিদা পূরণ করা হবে এবং জনগণকে অর্থের সুরক্ষা প্রদান করা হবে। আর মানুষকেও লোভের ফাঁদ থেকে বেরিয়ে আসতে হবে। নচেৎ লোভে পাপ...
সাধন মুখোপাধ্যায়। অরবিন্দনগর, বাঁকুড়া
|
আশির দশকে একটি ব্যাঙ্কে চাকরির সুবাদে আমাকে প্রায় পাঁচ বছর কর্নাটকে কাটাতে হয়। সেখানে দেখেছি, সব দক্ষিণ ভারতীয় ব্যাঙ্কই দৈনিক জমা প্রকল্প চালাত। আমানতকারীদের গরিষ্ঠ ভাগই মহিলা। এঁরা মিস্ত্রি, সবজি বিক্রেতা, পরিচারিকা বা খুবই কম বেতনের চাকুরে। এঁরা টাকা জমা দিতে ব্যাঙ্কে আসতেন না। ব্যাঙ্কগুলি আমানত সংগ্রহের জন্য এজেন্ট নিয়োগ করত কমিশনের ভিত্তিতে। এঁরা প্রতিদিনই আমানতকারীদের বাড়ি বা দোকান থেকে টাকা সংগ্রহ করে ব্যাঙ্কে জমা করতেন এবং পাশ বই করিয়ে নিয়ে যেতেন। আমানতকারী টাকা তোলার দরকার হলে তবে ব্যাঙ্কে আসতেন। বহু বছর ধরেই এই প্রকল্পগুলি চালু ছিল। কিন্তু আশির দশকের মাঝামাঝি দেখা গেল, বেশ কিছু এজেন্ট টাকা সংগ্রহ করে জমা দিচ্ছে না। পাশ বই ব্যাঙ্কে না-এনে নিজেরাই ভুয়ো এন্ট্রি করে আমানতকারীদের ঠকাচ্ছে। আমানতকারীরা ইংরেজি না-জানায় তাঁদের ঠকানো সহজ হয়ে যায়। এঁরা টাকা তুলতে ব্যাঙ্কে এসে জানতে পারেন, তাঁদের কষ্টার্জিত অর্থের অনেকটাই খোয়া গেছে। এজেন্ট তখন উধাও। ব্যাঙ্ক পুলিশে ডায়েরি করে এজেন্টকে হাজতে পাঠাতে পারলেও আমানতকারীদের টাকা উদ্ধার হয়নি। ব্যাঙ্কগুলি ধীরে ধীরে এই প্রকল্প বন্ধ করে দেয়। প্রকল্প লাভজনক না-হওয়াও ব্যাঙ্কের পক্ষে প্রকল্প বন্ধ করার একটা বড় কারণ ছিল।
তিন দশক পরেও দরিদ্র শ্রেণির অবস্থার এমন কিছু পরিবর্তন হয়নি যে, তাঁরা নিয়মিত ব্যাঙ্ক বা পোস্ট অফিসে টাকা জমাতে পারেন। ব্যাঙ্কের অবস্থাও এমন নয় যে, এজেন্টের ওপর নির্ভর না করে মানুষের বাড়ি বা কর্মস্থল থেকে দশ-বিশ টাকা করে সংগ্রহ করতে পারবে। এর জন্য অন্য কোনও সংস্থার প্রয়োজন।
কী ভাবে তা সম্ভব, তা কি যাঁরা অর্থনীতি বোঝেন এবং যাঁরা গরিব মানুষকে বোঝেন, তাঁরা একসঙ্গে বসে আলোচনা করে বার করতে পারবেন?
শুভ্রা দত্ত। কলকাতা-২৯ |