কলকাতা পুরসভার নতুন অঙ্কেই ধরা পড়ে যাচ্ছে তাদের পুরনো বেহিসেবি খরচ।
কলকাতার রাস্তায় একটি ত্রিফলা বাতিস্তম্ভ বসাতে মাস কয়েক আগেও খরচ হয়েছে ২৩ থেকে ২৭ হাজার টাকা। এখন পুরসভাই তা বসাচ্ছে ১৩ হাজার টাকায়। অর্থাৎ, এক ধাক্কায় খরচ কমেছে গড়ে ১২ হাজার টাকা।
বিতর্কের জেরে বেশ কয়েক মাস বন্ধ রাখার পরে কলকাতার ফুটপাথে ফের ত্রিফলা আলো লাগানোর কাজ শুরু করেছে পুরসভা। ওই সব বাতিস্তম্ভ সরবরাহ করেছে পুরসভারই এন্টালি ওয়ার্কশপ। আর আলোর সরঞ্জাম দিচ্ছে পুরসভার স্টোর বিভাগ। পুরসভার এক পদস্থ অফিসার বলেন, “শহরে ১১ হাজারেরও বেশি ত্রিফলা বাতিস্তম্ভ লাগানো হয়েছে। পুরনো দামের সঙ্গে নতুন দরের বিস্তর ফারাক। হিসেব করলে দেখা যাচ্ছে, ত্রিফলা খাতে প্রায় ১৩ কোটি ২০ লক্ষ টাকা গচ্চা দিয়েছে পুরসভা।” ওই অফিসারের মতে, ত্রিফলার নিয়ে সিএজি নানা রকম প্রশ্ন তোলাতেই বাধ্য হয়ে এখন পুর-কর্তৃপক্ষ খরচে লাগাম দেওয়ার চেষ্টা করছেন।
দামের এই তফাতের বিষয়টি জানেন মেয়র শোভন চট্টোপাধ্যায়ও। পুরনো দামে কেনা ত্রিফলায় কয়েক কোটি টাকা গচ্চা যাওয়ার বিষয়ে প্রশ্ন করা হলে তিনি বলেন, “এক জনকে দায়িত্ব দেওয়া হয়েছিল। ভুলটা তিনি করেছেন। এ বার সংশোধন করা হল। যাঁরা দায়ী, তাঁদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে।”
কেউ কেউ এই প্রসঙ্গে বলেছেন, পুরসভার দায়িত্ব তো নাগরিক পরিষেবা দেওয়া। ওয়ার্কশপ রেখে বাতিস্তম্ভ তৈরি করাটা কি তার মধ্যে পরে? পুরসভার এক কর্তার কথায়, বহু দিন ধরে এই ব্যবস্থা চলে আসছে। এ ক্ষেত্রে তাই ওই ওয়ার্কশপ থেকেই বাতিস্তম্ভ সরবরাহ করা হয়েছে। পরিস্থিতির বিচারেও মনে হয়েছে, এই কাজটা এখন পুরসভারই করা উচিত। |
হিসেব বদল |
সেট পিছু |
আগে* |
এখন* |
সিএফএল ৩টি (১৮ ওয়াট করে) |
৬৯৩ |
৩৯০ |
ল্যাম্পের ঢাকনা ৩টি |
৮৮৯৫ |
৩৯০০ |
বাতিস্তম্ভ (পোল) ১টি |
৫৮২৭ |
৩১৫০ |
কেবল-সহ বসানোর খরচ |
৯৫০০ |
৫০০০ |
মোট খরচ |
২৪৯১৫ |
১২৪৪০ |
* টাকায় |
|
প্রশ্ন হল পরিস্থিতিটা কেমন? পুরসভা সূত্রে যে তথ্য-পরিসংখ্যান পাওয়া গিয়েছে, তাতেই সবটা পরিষ্কার। জানা গিয়েছে, গত বছর শহরে প্রায় ১১ হাজার বাতিস্তম্ভ বসানো হয়। সে সময়ই ত্রিফলার বরাত দেওয়া নিয়ে অনিয়মের অভিযোগ ওঠে। প্রায় ২৭ কোটি টাকার কাজকে ৫৪০টিরও বেশি ফাইলে এমন ভাবে ভাগ করা হয় যে এক একটি কাজ হয় ৫ লক্ষ টাকার কম। এই নিয়ে প্রশ্ন ওঠে তৃণমূল শিবিরেও। সংবাদপত্রে তা প্রকাশিত হতেই তোলপাড় হয় রাজ্য রাজনীতি। বাম ও কংগ্রেস দলের পক্ষ থেকে ওই ঘটনায় বিচারবিভাগীয় ও সিবিআই তদন্তের দাবি ওঠে। পুর কমিশনার খলিল আহমেদ ওই কাজে বরাত পাওয়া ঠিকাদারদের বিল আটকে রাখার নির্দেশ দেন। বন্ধ হয়ে যায় শহরে ত্রিফলা বসানোর কাজও। রাজনৈতিক চাপে এক সময় ত্রিফলা নিয়ে বিশেষ অডিট করতে হয় পুর প্রশাসনকে। ওই রিপোর্টেই প্রমাণিত হয় ত্রিফলার নিয়ে অনিয়ম। অডিট রিপোর্টে বলা হয়, শুধু বরাতেই অনিয়ম নয়, দামের ক্ষেত্রেও বেহিসেবি খরচ করা হয়েছে। বাজার যাচাই না করেই ‘ফেয়ার রেট’ নির্ধারণ করেছে পুরসভার আলো বিভাগ। যার ফলে বাড়তি কয়েক কোটি টাকা বেরিয়ে গিয়েছে পুরসভার ভাঁড়ার থেকে।
ত্রিফলায় অনিয়মের অভিযোগ এক সময় মানতে চাননি মেয়র। তবে অডিটের পর তিনি ত্রিফলা বাতি লাগানোর ক্ষেত্রে বেহিসেবি কাজের কথা স্বীকার করেন নেন। পর পর দু’জন ডিজি (আলো)-কে তাঁদের পদ থেকে সরানো হয়। এমনকী, তাঁদের বিরুদ্ধে প্রশাসনিক ব্যবস্থা নেওয়ার প্রক্রিয়াও শুরু করা হয়।
পুরসভা সূত্রের খবর, আলোচনার আড়ালে চলে যাওয়া ত্রিফলা বিতর্ক ফের উস্কে উঠল সেট প্রতি দামের ফারাকে। পুরসভার আলো দফতরের এক অফিসার জানান, বাতিস্তম্ভে ল্যাম্পের উপর যে ঢাকনা রয়েছে, আগে তা কেনা হয়েছে ২৯৬৫ টাকায়। এখন ১৩০০ টাকা। সিএফএল ল্যাম্প (১৮ ওয়াট) আগে ২৩১ টাকায় কেনা হয়েছে। এখন ১৩০ টাকা। ত্রিফলার স্তম্ভ (পোল) আলো বিভাগ আগে বাইরে থেকে কিনেছে ৫৮২৭ টাকায়। এখন তা এন্টালি ওয়ার্কশপ থেকে মিলছে ৩১৫০ টাকায়। পুরো বাতিস্তম্ভ বসাতে (দুই স্তম্ভের মধ্যবর্তী দূরত্বের তার ও আনুষঙ্গিক জিনিসপত্র-সহ) আগে যেখানে সাড়ে ন’হাজারেরও বেশি টাকা খরচ হয়েছে, এখন নেমে এসেছে পাঁচ হাজারে। অর্থাৎ, এখন সেট পিছু (বসানো-সহ) খরচ হচ্ছে প্রায় ১২ হাজার ৪৪০ টাকার মতো।
দামের এত ফারাক হওয়ার কারণ কী? আলো দফতরের ওই অফিসারের কথায়, “পুর-অডিটের পর পুরনো দর বাতিল করে ত্রিফলার প্রতিটি সামগ্রীর আলাদা করে দরপত্র ডাকা হয়। তাতেই দর কমেছে। আর বাতিস্তম্ভ (পোল) সরবরাহ করছে এন্টালি ওয়ার্কশপ।”
পুরসভা সূত্রের খবর, সোমবার, ২০ মে রাজ্য সরকারের দু’বছর পূর্তি হচ্ছে। তার আগেই শহরে ফের ত্রিফলা আলো বসানোর প্রক্রিয়া শুরু করার কথা ওঠে মেয়র পরিষদের বৈঠকে। সেখানেই সিদ্ধান্ত হয়, এ বার থেকে ত্রিফলার সরঞ্জাম পুরসভা নিজেরাই কিনবে। সেই মতো স্টোরস বিভাগকে দায়িত্ব দেওয়া দেওয়া হয়। বতর্মান ডিজি (আলো) সঞ্জয় ভৌমিক বলেন, “পার্ক সার্কাস এলাকায় বাংলাদেশ দূতাবাসের সামনে ৫০টি বাতিস্তম্ভ বসানোর কাজ শুরু হয়েছে। গঙ্গার পাড়ে সৌন্দর্যায়নের জন্যও একশোর বেশি ত্রিফলা আলো বসবে।”
এ দিকে শহরের বেশ কয়েকটি রাস্তায় কিছু ত্রিফলার অবস্থা এর মধ্যেই বেহাল। কোনওটার বাতি জ্বলছে না। কোনওটার আবার ঢাকনা-সহ বাতি উধাও। কোথাও বা ভেঙে পড়েছে ত্রিফলার স্তম্ভ। পুরসভার আলো দফতরের এক অফিসার বলেন, “আগে লাগানো ওই বাতিস্তম্ভের বছরভর রক্ষণাবেক্ষনের কোনও চুক্তি নেই। ফলে খারাপ হলে সেই অবস্থাতেই থেকে যাচ্ছে।” তিনি জানান, এ বার থেকে রক্ষণাবেক্ষনের চুক্তি করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে পুরসভা। |