বাবা জ্ঞান দিয়ো না
জেন X ও রবীন্দ্রসঙ্গীত

মাথায় ফুল লাগিয়েই কি রবীন্দ্রসঙ্গীত গাইতে হবে

আমি পরীক্ষা-নিরীক্ষার পক্ষে। আই অ্যাম অল ফর এক্সপেরিমেন্টেশন। অনেকেই বলছেন যে এক্সপেরিমেন্টেশন না করলেও অল্পবয়সিরা রবীন্দ্রসঙ্গীত শুনতেন। আমার মনে হয় সেটা ঠিক নয়। আজকাল কত শো-তে গিয়ে আমি অল্পবয়সিদের কাছ থেকে রবীন্দ্রসঙ্গীত গাওয়ার অনুরোধ পাই। এমনকী এমনও বলেছে যে রবীন্দ্রসঙ্গীত খালি গলায় গান। যদি তাদের শুধুমাত্র আমার গলায় ওয়েস্টার্ন মিউজিকই ভাল লাগত, তা হলে তো তারা আমাকে খালি গলায় রবীন্দ্রসঙ্গীত গাইতে বলত না! আমার মনে হয় কোথাও একটা ‘শুরুওয়াত’ হয়েছে। সেটাই তো ভাল।
বন্যাদি যা বলেছেন, সেটা তাঁর ব্যক্তিগত মতামত। তা নিয়ে আমার কিছু বলার নেই। বয়স এবং অভিজ্ঞতাতে আমি ওঁর থেকে অনেক ছোট।
কিন্তু উনি হয়তো আমার ‘মায়াবনবিহারিণী’ ছাড়া আর কোনও রবীন্দ্রসঙ্গীত শোনেননি। আমি তো অন্য ছবিতেও রবীন্দ্রসঙ্গীত গেয়েছি। ‘বসন্ত উৎসব’-এ গেয়েছি ‘আজ যেমন করে গাইছে আকাশ’, ‘বালুকাবেলা.কম’য়ে গেয়েছি ‘তোমায় গান শোনাব’। যতটা সম্ভব চেষ্টা করেছি নোটেশন মেনে গাইতে। এসেন্সটা অক্ষুণ্ণ রেখে।
আমি রবীন্দ্রসঙ্গীত শিল্পী নই। আমি প্লে-ব্যাক সিঙ্গার। রবীন্দ্রসঙ্গীতগুলো সিনেমাতে ব্যবহার করা হয়েছে। সেখানে আমার নিজস্ব ইচ্ছে-অনিচ্ছেকে বাদ দিয়ে আগে দেখতে হয়েছে সিনেমার প্রয়োজনে গানগুলোকে কী ভাবে গাওয়া দরকার। সেটা না করলে নিজেকে প্রফেশনাল বলতে পারব না। তা হলে তো আমি নিজস্ব ইনহিবিশনেই নিজেকে বেঁধে ফেলব। রোজ কম করে প্রায় দশটা মেসেজ পাই আমি। আমার মতো করে একটা রবীন্দ্রসঙ্গীতের অ্যালবাম করার অনুরোধ এসেছে শ্রোতাদের কাছ থেকে। যেখানে ওয়েস্টার্ন অ্যারেঞ্জমেন্ট থাকবে। আমি তাদের অনুরোধকে অমান্য করতে পারব না। কথা, সুর আর গানের ফিলটা নষ্ট না করেই চেষ্টা করব রবীন্দ্রসঙ্গীতের অ্যালবাম করতে। অ্যালবামের ক্ষেত্রে আমার মনে হয় যে স্বরলিপি অনুসরণ করাটা দরকার। তবে শুধুমাত্র এক্সপেরিমেন্ট করব বলেই করাটা উচিত নয়।
একবার একটা অ্যালবাম শুনেছিলাম সোমশুক্লা বলে একজন শিল্পীর। গেয়েছিলেন ‘মন মোর মেঘের সঙ্গী’ গানটি। ওই রকম ভাবে রবীন্দ্রসঙ্গীত গাওয়াটা আমার পছন্দ হয়নি।
সবশেষে বলব যে আমি কী পোশাক পরে রবীন্দ্রসঙ্গীত গাইছি, সেটা কি সত্যি কোনও বিচার্য বিষয় হতে পারে? জিন্স পরেও আমি খুব শ্রদ্ধা নিয়ে রবীন্দ্রসঙ্গীত গাই। আমার কাছে পঁচিশে বৈশাখ বা বাইশে শ্রাবণ-এ আলাদা করে অনুষ্ঠান করে রবীন্দ্রসঙ্গীত গাওয়ার সে রকম তাৎপর্য নেই। আমার কাছে রবীন্দ্রসঙ্গীত গাওয়ার আলাদা করে কোনও দিন নেই, যে দিন মাথায় ফুল লাগিয়ে স্টেজে বসে তা গাইতে হবে! রবীন্দ্রসঙ্গীত আমার কাছে প্রত্যেক দিনের গান। জিন্স পরে গাইলে সে গানের প্রতি অশ্রদ্ধা হয় না।
যে যে ভাবে ব্যাখ্যা করবে সেটা নিতান্তই তার নিজস্ব অভিরুচি।

কণিকা বন্দ্যোপাধ্যায়ের গান আমাকে ছোঁয়নি
পরীক্ষা-নিরীক্ষা তো চলতেই থাকবে। আর তার মধ্যে দিয়েই কালজয়ী শিল্পের সৃষ্টি। শেক্সপিয়রকে দেখুন, কত বার ‘হ্যামলেট’ আর ‘ওথেলো’ হয়েছে। হয়তো শেক্সপিয়র ‘মকবুল’ দেখলে, তাঁর সেটা নাও ভাল লাগতে পারত। কিন্তু তাই বলে তো এক্সপেরিমেন্ট থামবে না।
আসল কথা হল যখন কোনও শিল্পী কিছু সৃষ্টি করেন, তার পরে আর সেই কাজটা তার নিজের থাকে না। কোন এক্সপেরিমেন্টটা থাকবে তা নির্ভর করে কতটা গভীরে গিয়ে সেটা নিয়ে পরীক্ষা-নিরীক্ষা করা হয়েছে। কই, কেউ তো আজ পর্যন্ত কোনও কথা বলেন না যখন মোজার্টের কম্পোজিশন হঠাৎ গাড়ির হর্নে বেজে ওঠে! বা কোনও ঘড়ির বিজ্ঞাপনে! আমার ধারণা অনেকে সেটা জানেও না যে সেই সুরটা মোজার্ট থেকে নেওয়া।
আমার মনে হয় না ‘রেজিমেন্টেড’ ধারণা থেকে কোনও রুচি তৈরি করা সম্ভব। সেটা হলে শিল্পবোধ ব্যাপারটাই অবরুদ্ধ হয়ে পড়বে!
সোমলতা ‘মায়াবনবিহারিণী’ একটা বিশেষ ভাবে গেয়েছে। তবে সেটা আইন করে বন্ধ করে দেওয়া দরকার, এটা বলা যুক্তিসঙ্গত নয়। সেন্সরশিপ ব্যাপারটা একান্তই ইন্টারনাল।
আজ বলতে বাধা নেই, কণিকা বন্দ্যোপাধ্যায়ের কোনও গানই আমার ভাল লাগেনি। ওই স্বরভঙ্গিটাই ভাল লাগে না আমার। আমি অত্যম্ত বিনম্র ভাবে শ্রদ্ধার সঙ্গে বলছি, গানগুলো আমায় এতটুকু টানেনি। ভবিষ্যতে টানবে কি না জানি না। আমরা তো বদলাই। তাই ভবিষ্যতের কথা বলতে পারব না।
সুচিত্রা মিত্রের বহু গান আমার ভাল লাগেনি। কিন্তু দেবব্রত বিশ্বাসের প্রতিটি গানই আমার ভাল লাগে। এমনকী হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের রবীন্দ্রসঙ্গীত আমার খুব প্রিয়। শুনে মনে হয়েছে যেন শঙ্করের গল্প পড়ছি।
সুমিত্রা সেনের গানও পছন্দের। শ্রাবণী সেনের গানগুলো সুন্দর। যে আবহপদগুলো তৈরি করা হয়েছে সেগুলো আমার বিশেষ পছন্দের। বন্যার গান ভাল লাগে। বন্যা একটা নিজস্ব স্টাইল তৈরি করেছে।
আর ভাল লেগেছে লোপামুদ্রার গাওয়া রবীন্দ্রসঙ্গীত। এই তো সে দিন একটা অনুষ্ঠানে গিয়ে শুনি লোপা রবীন্দ্রসঙ্গীত গাইছে। আর তার সঙ্গে আফ্রিকান রিদম। তা শুনে বাচ্চারা কী অসম্ভব আনন্দ পাচ্ছে। এ ভাবে রবীন্দ্রসঙ্গীতকে যদি বাচ্চাদের কাছে নিয়ে যাওয়া যায়, তাতে তো কোনও আপত্তি থাকার কথা নয়।

আশা ভোঁসলের রবীন্দ্রসঙ্গীত ভাল লাগেনি
যদি ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে রবীন্দ্রসঙ্গীত শোনাতে চাই, তা হলে তো এক্সপেরিমেন্ট করতেই হবে। ভাঙাচোরার মধ্যে দিয়েই তো এগিয়ে যাওয়া। ‘গানের ওপারে’ বলে একটা সিরিয়াল হয়েছিল। দেবজ্যোতি মিশ্র সুর করেছিলেন। তাতে সামন্তক যে ভাবে গানগুলো গেয়েছিল, সেটা আমার অসম্ভব পছন্দ ছিল। ওই ভাবে গাওয়ার জন্যই বোধহয় এত অল্পবয়সি ছেলেমেয়েরা গানগুলো শুনেছিল।
রবীন্দ্রসঙ্গীত নিয়ে নতুন কিছু করলে আগেও অনেক বাধা এসেছে। দেবব্রত বিশ্বাস প্রিল্যুড দিয়ে গান গাইতেন। তাতে অনেকেরই আপত্তি ছিল।
পীযূষ কান্তি সরকার যখন এক্সপেরিমেন্ট করেছিলেন, তখন বিশ্বভারতী থেকে তাঁর অনেকগুলো গান বাতিল করে দেওয়া হয়েছিল।
আমার মনে হয় গান গাওয়ার সময় কোথায় ‘সা’ লাগছে বা ‘গা’ লাগছে, সেটা দেখার চেয়েও বেশি করে দেখা দরকার গানটা হৃদয়ে লাগছে কি না। যেমন মন ছুঁয়ে যেত ঋতু গুহর গান, দেবব্রত বিশ্বাসের গান।
তবে এটাও বলব যে সব এক্সপেরিমেন্ট তো আর ভাল লাগে না। শ্রদ্ধার সঙ্গে বলছি, আশা ভোঁসলের গাওয়া রবীন্দ্রসঙ্গীত কিন্তু আমার ভাল লাগেনি। ওস্তাদ রাশিদ খানের রবীন্দ্রসঙ্গীতের প্রসঙ্গে বলছি, বাণী-প্রধান গানে উচ্চারণের ত্রুটি থাকলে তো সেটাও কি কানে একটু লাগে না? সোমলতার গান আমার পছন্দ। শুধুমাত্র ওর গানে খানিক ওয়েস্টার্ন অ্যারেঞ্জমেন্ট আর ড্রামস থাকে বলে, ওকে কেন এ ভাবে বলা হচ্ছে?
বলতে গেলে তো এটাও বলা যেতে পারে যে মুম্বইয়ের অনেক গায়ক সে ভাবে ভাল রবীন্দ্রসঙ্গীত গান না। তবে তাঁদের অ্যালবামের বিক্রি ভাল। আর কেউ সে নিয়ে কথাও বলে না! সোমলতাকেই কেন এত কথা শুনতে হচ্ছে?
নতুন গায়কদের মধ্যে বাংলাদেশের অর্ণবের রবীন্দ্রসঙ্গীত আমার দারুণ পছন্দ। অর্ণবের অ্যারেঞ্জমেন্টে সাহানার গানও শুনে ভাল লেগেছে।
আর একজনের নাম বলব। এখন তিনি নেই। বিক্রম সিংহ। তাঁর গায়কি এত সুন্দর ছিল যে, সেটা নতুন প্রজন্মের শ্রোতাদের ভাল লাগত।

জিলিপির সঙ্গে কষা মাংস মেখে খাওয়ার দরকার নেই
আমি রবীন্দ্রসঙ্গীত নিয়ে পরীক্ষা-নিরীক্ষার বিরোধী নই। নিজেও কিছু কাজ করেছি। কিন্তু সেই পরীক্ষা-নিরীক্ষাগুলো সর্বদাই অ্যারেঞ্জমেন্টেই সীমাবদ্ধ থেকেছে। সব সময় খেয়াল রেখেছি যাতে গানের শুদ্ধতাটা নষ্ট না হয়ে যায়। উচ্চারণ ঠিক থাকে যাতে গানের সারমর্মটা না পাল্টে যায়।
‘অবশেষে’ ছবিতে রূপা গঙ্গোপাধ্যায়ের সঙ্গে কাজ করেছিলাম ‘দূরে কোথায় দূরে দূরে’ গানটি নিয়ে। খেয়াল রেখেছিলাম যাতে গানটার অরিজিনাল ফর্মটা নষ্ট না হয়ে যায়। সাধারণত মানুষ আমেরিকার প্রটেস্ট স্টাইলের গিটার বাজানোর ভঙ্গিকে টপ্পাঙ্গের গানে ব্যবহার করে না। কিন্তু আমরা সেটাই করেছিলাম। তা করে গানের মুডটা ছবির দৃশ্যের সঙ্গেও মানিয়ে গিয়েছিল।
‘সখি ভাবনা কাহারে বলে’ গানটি অ্যারেঞ্জ করা হয় ‘একটি তারার খোঁজে’ ছবিতে। রেকর্ড করার আগে অনেক বার জয়তী চক্রবর্তীর সঙ্গে কথা বলেছিলাম গানটা নিয়ে, যাতে মূল সুর আর কথা না পাল্টেও গাওয়ার ভঙ্গিটা সিনেমার চরিত্রের সঙ্গে মানিয়ে যায়। সিম্ফোনিক অ্যারেঞ্জমেন্ট করা হয়েছিল যেটা পরিচালক অভীক মুখোপাধ্যায়ের ‘ভিসুয়াল গ্র্যাঞ্জার’-এর সঙ্গেও মানিয়ে যায়।
আমার নিজের ধারণা যে রবীন্দ্রনাথের গানগুলো স্বয়ংসম্পূর্ণ। কথা আর সুরের এক সুন্দর মেলবন্ধন আছে তাতে। তাই অযথা রবীন্দ্রসঙ্গীতকে অন্য ভাবে গাওয়ার মানে হয় না। নতুন সুর করতে চাইলে মানুষ নিজের কম্পোজিশনেই তা করতে পারে। রবীন্দ্রনাথের গান কেন?
আসলে যে কোনও স্কুল অব মিউজিক তা সে রক, জ্যাজ, ফোক বা অপেরা হোক, তার একটা বিশেষ ধরন থাকে গাওয়ার। ডিউক এলিংটনের গান আমরা রাবীন্দ্রিক ভাবে গাই কি? রবীন্দ্রসঙ্গীত একটা জার। যেটা সময়ের সঙ্গে সঙ্গে বিবর্তিত হয়েছে। রবীন্দ্রনাথ তো নিজেই কত ধরনের এক্সপেরিমেন্ট করেছেন। ওয়ার্ল্ড মিউজিকের এক চূড়ান্ত উদাহরণ হল রবীন্দ্রসঙ্গীত। বিশ্বের কত রকমের সঙ্গীত থেকে অনুপ্রেরণা নিয়েই তো এই স্কুলটা তৈরি হয়েছে। হালফিলের পরীক্ষা-নিরীক্ষাগুলো যদি রবীন্দ্রসঙ্গীতের সৌন্দর্যটাই নষ্ট করে দেয়, তা হলে তো সেই গানগুলো গাওয়ার মানেই থাকে না।
জিলিপির সঙ্গে কষা মাংস মেখে খেয়ে দেখার প্রয়োজন নেই। এমনিতেই আন্দাজ করা যায় যে ওটা ভাল লাগবে না। ঠিক তেমন ভাবে রবীন্দ্রসঙ্গীতের সঙ্গে পিঙ্ক ফ্লয়েডকে মেখে কোনও পরীক্ষানিরীক্ষা হয় না। রবীন্দ্রসঙ্গীতের শুদ্ধতাটা বজায় রেখে যদি নতুন শব্দসৃষ্টি করা যায়, সেটাই এক্সপেরিমেন্ট। এক বার রক করলাম, ডিস্কো করলাম, গায়কির অ্যাটিটিউডটা পাল্টালাম, অরিজিনাল করতে গিয়ে এমন কিছু করলাম যে সেটা রবীন্দ্রসঙ্গীত রইল না আর, তা হলে আর লাভটা কোথায়!
আমাদের নিজেদের অক্ষমতা ঢাকার জন্য রবীন্দ্রসঙ্গীতকে নিয়ে পরীক্ষা-নিরীক্ষা করা উচিত নয়। সম্প্রতি ‘খরবায়ু বয় বেগে’ গানটির একটি এক্সপেরিমেন্ট শুনলাম। বেসিক টেম্পো আর গ্রুভটা এমন ব্যবহার করা হয়েছিল, তাতে শিল্পী গানের কথাগুলোই ঠিক করে উচ্চারণ করতে পারেননি। এই ধরনের এক্সপেরিমেন্টের মানে কী?
যখন তস্কানিনি বা জুবিন মেটা বিটোভেন-এর সিম্ফনি পরিচালনা করেন, তাঁরা বেসিকটা বদলান না। তবু নিজেদের ছাপ ফেলে যান। তেমনই রবীন্দ্রনাথের স্কোরটা মাথায় রেখেও অরিজিনাল হওয়া সম্ভব।

তেমন পরীক্ষা হচ্ছে কোথায়?
‘পাগলা হাওয়া’ আর ‘জাগরণে’ নতুন ভাবে উপস্থাপন করার পর আমি ভেবেছিলাম কলকাতাতে রবীন্দ্রসঙ্গীত নিয়ে অনেক কিছু হবে। কিন্তু কই? তা তো হল না!
আর একটা অ্যালবাম শুনেছিলাম। অর্ণব পাঠিয়েছিল বাংলাদেশ থেকে। কী সুন্দর অ্যারেঞ্জমেন্ট! শুধু একটা পিয়ানো। আর তার সঙ্গে গাওয়া রবীন্দ্রসঙ্গীত। খুব ভাল কাজ।
আমি নিজে তো আজকাল সিনেমাতে রবীন্দ্রসঙ্গীত ব্যবহার করা বন্ধই করে দিয়েছি। স্ক্রিপ্টে প্রয়োজন হলে আমি করি। না হলে করি না। ‘গণেশ টকিজ’ মুক্তি পাবে সামনে। ওখানে একটা রবীন্দ্রসঙ্গীত ব্যবহার করেছি। ইন্দ্রনীল সেনের গাওয়া ‘সে দিন দুজনে’। ইন্দ্রনীলের সাবেকি গলা। আর তার সঙ্গে একটা হারমোনিয়াম। মাঝখানে অর্কেস্ট্রা ব্যবহার করেছি। তাও আবার সিনেমার প্রয়োজনেই করা। যেটুকু পরীক্ষা-নিরীক্ষা আজকাল রবীন্দ্রসঙ্গীত নিয়ে করা হয়, তাতে এমন কিছু নতুনত্ব দেখিনি। কিন্তু তা আর তেমন বিশাল এক্সপেরিমেন্ট কোথায়!
আমি চাইব রবীন্দ্রসঙ্গীত এমন ভাবে গাওয়া হোক, যাতে শিল্পীর স্বাতন্ত্র্যটা বজায় থাকে। কণিকা বন্দ্যোপাধ্যায়, শান্তিদেব ঘোষ, সুচিত্রা মিত্র, পূর্বা দাম এঁরা সবাই গেয়েছেন। তবু এদের প্রত্যেকের গায়কির মধ্যে একটা ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্য ছিল। আজ যদি সোমলতা ‘বাজে করুণ সুরে’ গায়, তা হলে আমি চাইব যে গানটার মধ্যে সোমলতার নিজস্বতাটাও যেন থাকে। কেউ যেন উঠে দাঁড়িয়ে না বলেন কেন সোমলতা কণিকা বন্দ্যোপাধ্যায়ের মতো করে গানটা গায়নি?
‘ব্লোয়িং ইন দ্য উইন্ড’ বা ‘ইমাজিন’ তো কত জনেই গেয়েছেন। কিন্তু সবাইকে কি ডিলান আর লেননের মতো করে গাইতে হবে?
আমি তাকিয়ে আছি কিউয়ের ‘তাসের দেশ’-এর অ্যালবামের দিকে। ওখানে অনেক বাইরের শিল্পীও কাজ করেছেন। হয়তো ওই গানগুলোতে অনেক নতুন কিছু পাব আমি!

সোমলতার পোশাক নিয়ে মন্তব্য অকারণ
এমন কথা বলা যায় না যে কপিরাইট থাকাকালীন বিশ্বভারতীর অনুমোদিত সমস্ত রেকর্ডই অসাধারণ। ঠিক তেমনিই রবীন্দ্রনাথ যখন বিশ্বভারতী থেকে বেরিয়ে বিশ্ব-ভারতের হচ্ছেন, তখনও যা কিছু তাঁকে ঘিরে হচ্ছে তা সবই ভাল হচ্ছে। বা সবই মন্দ হচ্ছে। তবে আকাশ বা সমুদ্রকে যেমন আইন দিয়ে বাঁধতে চাওয়া ছেলেমানুষি, তেমনই রবিঠাকুরের গানকে কারও ব্যক্তিগত সম্পত্তি করে রাখাও অযৌক্তিক।
আমাদের সব থেকে প্রিয় দু’জন কণ্ঠসঙ্গীত শিল্পীর কথা যদি বলতে বলা হয়, আশা ভোঁসলে তাঁদের মধ্যে একজন। তবে তাঁর গাওয়া রবীন্দ্রনাথের গান আমাদের মন ছোঁয়নি। ঠিক যেমন কণিকা বন্দ্যোপাধ্যায় মিউজিক্যালি আমাদের খুব মুগ্ধ করেন না কারণ কোথাও শোনার সময় মনে হয় এই দুই শিল্পীর ম্যানারিজম মূল কম্পোজিশন এবং তার সারল্যকে আঘাত করছে।
রেজওয়ানা চৌধুরী বন্যা একজন শ্রদ্ধেয় শিল্পী। আমাদের ভাল লাগার শিল্পী, আমাদের অগ্রজ, গুরুস্থানীয়। তাঁর সমস্ত মন্তব্য এবং বক্তব্যকে মাথা পেতে নেওয়ার পরেও সোমলতার হয়ে বলতে ইচ্ছে করছে যে, পোশাক নিয়ে ওঁর করা মন্তব্যটি বোধহয় অকারণ।
এখন আমাদের এই প্রজন্মে রবীন্দ্রনাথের গান নিয়ে প্রচুর কাজ হচ্ছে। কবির কথায়, আমরা বোধহয় এত দিনে তাঁকে বহন করা ছেড়ে বাহন করতে পেরেছি। ব্যক্তি রবীন্দ্রনাথ আমাদের ছেড়ে চলে গিয়েছেন ৭২ বছর হল। কিন্তু যে কবি ছেড়ে যায়নি, সে হল আমাদের মনে ‘রবীন্দ্রনাথের ধারণা’। একটি মুষ্টিমেয় ধারণা কী করে বলতে পারে যে বাকি ধারণাগুলো অপসংস্কৃতি, বেআইনি?
নতুনরা কত সুন্দর কাজ করছে। গাবুদার ‘এলার চার অধ্যায়’-এ রবীন্দ্রনাথের গান আমাদের প্রিয়। ঠিক যেমন রাশিদ খানের অস্পষ্ট উচ্চারণে, অথচ দৈব কণ্ঠের জাদুতে নতুন মাত্রা পেয়েছে ‘আজি ঝড়ের রাতে’ গানটি। শ্রাবণী সেন, প্রমিতা মল্লিক আর মোহন সিংহ আমাদের এই সময়ের প্রিয় গায়ক-গায়িকা কারণ ‘দে ইন্টারপ্রেট হিজ কম্পোজিশনস দেয়ার ওয়ে।’
আমরা সুনিধি চহ্বানের সঙ্গে একটা রবীন্দ্রনাথের অ্যালবাম রেকর্ড করেছি। নাম ‘টেগোর অ্যান্ড উই পার্ট টু’। নিষ্ঠাভরে যতদূর সম্ভব আমরা নতুন ভাবে রবীন্দ্রনাথের গানকে উপস্থাপনা করেছি এখানে।

ছবি: কিংশুক চক্রবর্তী



First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.