|
|
|
|
|
|
|
পুস্তক পরিচয় ২... |
|
সাম্রাজ্যবাদী দাম্ভিকতার পাপক্ষালন? |
অরুণকুমার বসু |
কবি এক জাগে/ গীতাঞ্জলি Gitanjali, প্রণতি মুখোপাধ্যায়। পুনশ্চ, ৭৯৫.০০ |
সাহিত্যিক নাম ‘দুটি পাতা একটি কুঁড়ি’; অবশ্য পুরোটা মিলিয়েই বিশ্বের সেই জনপ্রিয়তম পানীয়কে যেমন বোঝায়। তুলনাটা নেহাত বালসুলভ মনে হতেই পারে। কিন্তু প্রণতি মুখোপাধ্যায় তাঁর গীতাঞ্জলি-সংস্করণের নাম দিয়েছেন কবি এক জাগে/ গীতাঞ্জলি GITANJALI। একটি কাব্য ও তার অনুবাদের বহুমাত্রিক তেজস্ক্রিয়তা বোঝাতে এই নাম যেন অনিবার্য ছিল। এই গ্রন্থটি অবশ্যই রবীন্দ্রনাথের গীতাঞ্জলি-র এক দ্বিভাষিক সংস্করণ। তাই বলে ব্রহ্মসূত্রের টীকাসর্বস্ব শঙ্করভাষ্য নয়। এ এক বিশ্ব-কবির আত্মউন্মোচন আত্ম-আবিষ্কারের রহস্যসন্দর্ভও বটে। তাই ‘কবি এক জাগে’। আখ্যাপত্রে অবশ্য নাম-পরিচিতি গীতাঞ্জলি Gitanjali/ রূপে রূপান্তরে/ কবি একজাগে। ‘কবি’ তো বাংলা ভাষার অতি প্রাচীন এক শব্দ: কখনও নিছক পদ্যকার, ক্কচিৎ ‘শবদে শবদে বিয়া’ দেওয়ার মধুসূদনীয় অনুঘটক। তবে রবীন্দ্রনাথের ‘কবি’ ধারণাটি সম্ভবত বিহারীলালের ‘পঙ্খের কাজ-করা ঘরটি’ থেকে পাওয়া। বোধ করি বিহারীলালই এ কালের প্রথম কবি, যাঁর কবি-শব্দের কনসেপ্ট ছিল সারদা বা ভারতী-র কাছ থেকে শংসাপত্র-পাওয়া। ধারণাটি অবশ্যই ক্লাসিকাল; মধুসূনের মিউজ-এর সমবয়সী। ‘বিহারীবাবুর মতো কবি’ হওয়ার দুরাকাঙ্ক্ষার উনুনে নতুন বৌঠানের কৌতুকসন্দিগ্ধ বায়ুবীজনের কথাটাও আমাদের জানা আছে। কৈশোর থেকেই রবীন্দ্রনাথের কাব্য-ভাবনার চাতালে নিয়মিত একজন করে কবি এসে দাঁড়াতেন, ‘কবিকাহিনী’ থেকে যার শুরু। ‘ভাষা ও ছন্দে’ (কাহিনী ১৩০৬) নারদ তো সরাসরি ব্রহ্মলোক থেকে আনা ছাড়পত্র দিয়েই বলেছিলেন, ‘কবি, তব মনোভূমি রামের জনমস্থান, অযোধ্যার চেয়ে সত্য জেনো’। চিত্রা-র ‘১৪০০ সাল’ কবিতায় (রচনা ২ ফাল্গুন ১৩০২) আপন কবি-সত্তা সম্পর্কে কবির আত্মপ্রত্যয় রীতিমতো দৃঢ়মূল: ‘সেদিন উতলা প্রাণে হৃদয় মগন গানে,/ কবি এক জাগে/ কত কথা পুষ্পপ্রায় বিকশি তুলিতে চায়/ কত অনুরাগে/ একদিন শতবর্ষ আগে।’
বাংলা গীতাঞ্জলি রচনার যুগ পর্যন্ত বাংলা দেশে বাংলা সাহিত্যে রবীন্দ্রনাথের কবি অভিধা নিয়ে কোনও বিস্ময় ছিল না। তখন মধুসূদন বিহারীলাল হেমচন্দ্র নবীনচন্দ্রের পাশে তিনিও একজন ‘কবি’। ইংরাজিতে অনূদিত গীতাঞ্জলি পাঠ করে ও কবির আবৃত্তি শুনে বিস্মিত পুলকিত ইংরাজ বিদ্বজ্জনসভা যে কবি-র সঙ্গে পরিচিত হলেন, তিনি কি সেই সনাতন বাঙালি কবিটি? রটেনস্টাইনকে বলেই ফেললেন ব্রাডলে, ‘ইট লুক্স অ্যাজ দো উই হ্যাভ অ্যাট লাস্ট আ গ্রেট পোয়েট অ্যামংস্ট আস।’ প্রণতি তাঁর গ্রন্থে সেই গীতাঞ্জলি ও তার ইংরাজি রূপান্তর সম্পর্কেই ‘কবি এক জাগে’ এই প্রচ্ছদ-অভিজ্ঞান যুক্ত করেছেন।
কয়েক বছরের ব্যবধানে বাংলা ও ইংরাজি গীতাঞ্জলি-র ও নোবেল পুরস্কারের শতবর্ষপূর্তি উপলক্ষে দুই ভাষার গীতাঞ্জলি-র নানা সংস্করণ প্রকাশিত হয়েছে। অনূদিত গীতাঞ্জলি সংক্রান্ত বহু অজানা তথ্য গোচরে এসেছে, অনেক দুর্লভ পাণ্ডুলিপি চিত্র, পাণ্ডুলিপি-প্রতিলিপি, সংশ্লিষ্ট চিঠিপত্র প্রকাশ্যে এসেছে। হার্ভার্ড-এর হুটন লাইব্রেরিতে সংরক্ষিত রটেনস্টাইন-সংগ্রহভুক্ত মূল পাণ্ডুলিপি ও কাগজপত্র আজ আর দুষ্প্রাপ্য নয়। প্রণতি যাবতীয় প্রাপ্ত তথ্যের সদ্ব্যবহার করেছেন। তাই তাঁর এই দ্বিভাষিক সংস্করণটি পুনশ্চ মাত্র নয়, এটি পুনর্নির্মাণও। এই প্রথম পাওয়া গেল সটীক সংস্করণ, এবং তাই সঠিক সংস্করণের পথে খানিকটা এগিয়ে থাকাও গেল। এ গ্রন্থে ইংরাজি গীতাঞ্জলি-র সংশ্লিষ্ট বাংলা মূলগুলি এক পৃষ্ঠায়, বিপরীত পৃষ্ঠায় অনূদিত রূপ, পদপ্রান্তে টীকা-টিপ্পনি, নিষ্কর্ষ, ভাষ্য, অর্থভেদ ইত্যাদি। আশেপাশে মুদ্রিত দুই ভাষায় লিখিত কবির হস্তপাঠলিপি, প্রাসঙ্গিক চিঠিপত্র। তদতিরিক্ত সম্পদ লন্ডনে-তোলা রবীন্দ্রনাথের সেই দুর্লভ ফটোগ্রাফ। আছে ইংরাজি গীতাঞ্জলি ফ্রুট গ্যাদারিং ও ক্রেসেন্ট মুন-এ প্রথম মুদ্রিত দুর্লভ চিত্রগুলির সযত্ন পুনর্মুদ্রণ। ছবিগুলি যেহেতু কবিতার চিত্রায়ণ, তাই সংশ্লিষ্ট কবিতার পাশেই তারা ঠাঁই পেয়েছে, যা পাঠ-কে রোমাঞ্চিত করে।
প্রণতি মুখোপাধ্যায়ের এই গ্রন্থের দশ পৃষ্ঠা প্রস্তাবনায় ও চল্লিশ পৃষ্ঠার ভূমিকায় রবীন্দ্রনাথের নোবেল পুরস্কার-লাভ, বিশ্বখ্যাতি অর্জন, পাঠ-পরিচয়-বিস্ময়-স্বীকৃতি-মুগ্ধতার বহুস্তরিক ইতিহাস অনুপুঙ্খে বর্ণিত। গীতাঞ্জলি-র অনুবাদের পরিপূরক কবির গল্পাদির অনুবাদ-বিষয়ক শৌখিন প্রয়াস-বিষয়ে বহু তথ্যও বস্তুত উজ্জ্বল উদ্ধার।
তবে গীতাঞ্জলি-র এই বৈদেশিক খ্যাতির চিত্রনাট্যের ভিতর দিয়ে আর একটি ঐতিহাসিক চেতনার স্তরও নিঃশব্দে প্রবাহিত হচ্ছিল, এমন অনুমান অপরিহার্য হয়ে উঠতে চাইছে। প্রণতি তার সূত্রটি স্পষ্ট ধরতে পারেননি, তবে আবছা আভাস দিয়েছেন। রুডিয়ার্ড কিপলিঙ ক’বছর আগেই নোবেল পুরস্কার পেয়েছিলেন। ইংরেজ বুদ্ধিজীবী সমাজ কিপলিঙের কবিপ্রতিভায় উচ্ছ্বসিত ছিলেন, এমন উদাহরণ বিরল। কিপলিঙের দ্বারা প্রচারিত পূর্ব-পশ্চিমের অসেতুসম্ভব বিরোধ-বিচ্ছিন্নতার সাম্রাজ্যবাদী তত্ত্বটিকে রবীন্দ্রনাথ তাঁর যৌবন থেকেই ঘৃণা করতেন। ‘যে সময়ে শেলি কীটস টেনিসন ব্রাউনিং অন্তর্হিত এবং কিপলিঙ হইয়াছেন কবি’ ১৩১১-য় ‘সফলতার সদুপায়ে’ রবীন্দ্রনাথের মন্তব্য। ১৩১৩-র ‘বিশ্বসাহিত্য’ প্রবন্ধেও এই প্রসঙ্গ আছে। তাই অনুমান করতে ইচ্ছা হয় কিপলিঙের সাম্রাজ্যবাদী দাম্ভিকতা, পরাধীন ভারতবাসীকে ভৃত্যরাজকতন্ত্রের হীনম্মন্যতায় চিহ্নিত করা, রবীন্দ্রনাথ যে ইংরেজ সমাজকে ‘বড়ো ইংরেজ’ বলে বিশ্বাস করতেন, তাঁদের পক্ষে রুচিপ্রদ হয়নি।
গীতাঞ্জলি-র কবিকে বিলাতের কবি-সাহিত্যিকরা যে ভাবে অভিনন্দিত করেন, তার প্রবল প্রতিক্রিয়ায় রবীন্দ্রনাথ যা বললেন, আজ তার অন্তর্নিহিত সত্যটি নতুন করে বুঝে নিতে হবে। ইন্ডিয়া সোসাইটি ১৯১২-র ১০ জুলাই রবীন্দ্রনাথকে অনন্য কবিকৃতির জন্য অভিনন্দন জানায়। কবির প্রতিভাষণে যেন ইতিহাসের একটি রহস্যসূত্র সংহত আছে। নোবেল পুরস্কার সে দিন কারও কল্পনাতেও ছিল না। কিন্তু রবীন্দ্রনাথ তাঁর জীবনসত্যটি এই ভাষায় ঘোষণা করলেন, ‘পূর্ব পূর্বই, পশ্চিমও পশ্চিমই তা তো বিধিনির্দিষ্ট ভাবে চিরস্থির। কিন্তু তাদের মিলনের দিন এসেছে। ...বিভেদ রক্ষা করেও বিশ্ব-মানবের সাধারণ বেদির সামনে উভয়ের মাল্যবন্ধন সম্পন্ন হবে।’ (প্রশান্তকুমার পাল, রবিজীবনী ৬, ৩১৮)। কিপলিঙের নাম করা হল না, কিন্তু তাঁর সংকীর্ণ উক্তিটিকে নস্যাৎ করা হল। পাশাপাশি স্টপফোর্ড ব্রুকের পত্রাংশ পুনরুদ্ধার করেছেন প্রণতি, সেখানে কিপলিঙের বৈপরীত্যে যে ‘কোয়ায়েট অ্যান্ড সাইলেন্ট গ্রুপ অব ইংলিশ পিপ্ল’-এর স্বীকারোক্তি রয়েছে, জন বুল ইংরাজের উল্টো দিকে তাঁরাই রবীন্দ্রনাথের চোখে ‘বড়ো ইংরেজ’, গীতাঞ্জলি-র কবির কাছে যেন ক্ষমাপ্রার্থী।
কিপলিঙ আগেই নোবেল পেয়েছিলেন। সেই কমিটি ১৯১৩-য় রবীন্দ্রনাথকে নোবেল দিয়ে কিপলিঙের সাম্রাজ্যবাদী দাম্ভিকতার পাপক্ষালন করলেন, এমন ভাবাটা কি আজ অযৌক্তিক? ১৬ জুলাই ‘টাইমস’-এর সম্পাদকীয়তে কিপলিঙ-বিপ্রতীপ পূর্ব-পশ্চিম মৈত্রীভাবনা স্পষ্ট: ‘টু দেম [ভিন ভাষী পাঠককুল] হি ইজ নট আ বেঙ্গলি, বাট আ ব্রাদার পোয়েট, অ্যান্ড দে এনজয় হিজ ওয়ার্কস... বিকজ বিয়িং পোয়েট্রি, দে আর অব দ্য সেম নেচার অ্যাজ ওয়েল অ্যাজ অল আদার পোয়েট্রি ইস্টার্ন অর ওয়েস্টার্ন’ (প্রণতি, ৪৩)।
অনূদিত গীতাঞ্জলি-র পাণ্ডুলিপিতে ইয়েটস-এর সংস্কার/ সংশোধন/ সংযোজন ইত্যাদি নিয়ে বহু দিন বহু জল্পকল্প চলেছে। প্রণতির গ্রন্থে তাঁর চূড়ান্ত গবেষণায় ও স্বনির্ভর সিদ্ধান্ত-কৌমুদীতে গীতাঞ্জলি-র সংস্কার বিষয়ের শাপমোচন ঘটেছে। এখন কবি-কৃত Gitanjali-র সঠিক পাঠ-সম্মুখে বিশ্বাসের প্রদীপ নিয়ে অনায়াসে বলা যায় ‘বড়ো বিস্ময় লাগে হেরি তোমারে’। |
|
|
|
|
|