|
|
|
|
হার মেনেছে লিউকেমিয়াও |
অসম লড়াইয়ে বিজয়ী ব্যতিক্রমী পড়ুয়ারা |
সাবেরী প্রামাণিক • কলকাতা
পরমা দাশগুপ্ত • কলকাতা |
বোর্ডের পরীক্ষায় উতরে যাওয়াটা ওদের আসল পরীক্ষা ছিল না মোটেই। সেখানে তো পাশের হার ৯৫ থেকে ৯৮ শতাংশ। ওদের পরীক্ষা ছিল অনেক কঠিন। যেখানে সাফল্যের হার হাতে গোনা। আর সেই অসম লড়াইয়ে জিতে ওরা অবশ্যই ব্যতিক্রমী।
যেমন, ঐন্দ্রিলা দেব। ক্যালকাটা পাবলিক স্কুলের ওই ছাত্রীর দু’চোখে দৃষ্টি স্বাভাবিকের মাত্র ১০ শতাংশ। তা নিয়েই এ বার আইসিএসই-তে ৬৫ শতাংশ নম্বর পেয়েছে সে। ২০০৫ সালে ড্রাগ অ্যালার্জির শিকার হয়ে চোখের দৃষ্টি হারাতে বসেছিল ফুলবাগানের বাসিন্দা ঐন্দ্রিলা। তখন সে তৃতীয় শ্রেণির পড়ুয়া। তার বাবা অসীমকুমার দেব জানালেন, ওষুধের প্রভাবে তার কর্নিয়া শুকিয়ে যায়। চিকিৎসা করিয়ে কোনও রকমে এই ক্ষীণ দৃষ্টিটুকু রয়েছে তার। ২০০৯ সাল অবধি তাই নিয়েই সে পড়াশোনা চালিয়ে যাচ্ছিল বই-খাতার সঙ্গে চোখ ঠেকিয়ে। ২০০৯-এর পর থেকে তার সঙ্গী একটি যন্ত্র। হাতে ধরা সেই যন্ত্রের স্ক্রিনে বড় হরফে অক্ষর দেখে এখন সে পড়াশোনা করে। তবে একটানা পারে না। অনেকটাই ভরসা করতে হয় বাবা-মায়ের উপরে। তাঁরাই ঐন্দ্রিলার বই পড়ে যান। শুনে মনে রাখার চেষ্টা করে তাঁদের মেয়ে। এ বার আইসিএসই-ও টপকালো সে ভাবেই।
ইতিমধ্যেই চার বার অস্ত্রোপচার হয়েছে ঐন্দ্রিলার চোখে। তবুও হতাশায় হাল ছেড়ে দেওয়ার কথা ভাবতে পারে না সে। বরং পড়াশোনার পাশাপাশি সমানতালে চালিয়ে গিয়েছে গান, নাচ, ছবি আঁকা। গানের ক্লাসে নোট নেয় না, কেবল কানে শুনেই গান তোলা। নাচের সময় তার হাত ধরে মুদ্রা শিখিয়ে দেন গুরুজি। আর আঁকার খাতায় প্রায় চোখ লাগিয়ে রেখা টানে। তাতেই অবশ্য বিভিন্ন সময়ে যোগ দিয়েছে নানা প্রতিযোগিতাতেও।
ঐন্দ্রিলা বলে, “৬৫ শতাংশ নম্বরে আমি খুশি। তবে আর একটু হয়তো আশা করেছিলাম। এ বার বাণিজ্য নিয়ে পড়ব। আগামী দিনে আইন পড়ে নিজের পায়ে দাঁড়াতে চাই।”
সেন্ট্রাল মডার্ন স্কুল থেকে আইএসসি দিয়ে পেয়েছেন ৬৩ শতাংশ নম্বর পেয়েছে রুবি মল্লিক। ওই নম্বর দেখে কিন্তু রুবির সাফল্যের পরিমাপ করা যাবে না। আট বছর বয়সেই লিউকেমিয়ায় আক্রান্ত হয় রুবি। মা গায়ত্রী মল্লিক জানান, এখনও চলছে কেমোথেরাপি, রক্ত দেওয়া। ওষুধপত্র তো আছেই। মনের জোরে সেই নিয়েই পড়াশোনা এবং পরীক্ষার প্রস্তুতি চালিয়ে গিয়েছেন রুবি। হার না-মানা জেদে লিউকেমিয়ার মতো এক কালান্তককেও বাধা হতে দেননি তিনি। বলা বাহুল্য, লিউকেমিয়ার মোকাবিলায় রুবির মার্কশিট নজর কাড়ার মতো।
এম পি বিড়লা ফাউন্ডেশন স্কুলের সৌম্যরূপ মুখোপাধ্যায়ের ঐন্দ্রিলা বা রুবির মতো সমস্যা ছিল না। দিব্যি সুস্থ শরীরে আইএসসি পরীক্ষা দিচ্ছিল সে। প্রথম কয়েকটা পরীক্ষার পরেই আচমকা এক রাতে বাড়িতে পা পিছলে পড়ে জ্ঞান হারায় সৌম্যরূপ। হুঁশ ফেরে দু’দিন পরে, তখন সে হাসপাতালের আইসিইউ-তে। সৌম্যরূপের কথায়, “কম্পিউটার সায়েন্স পরীক্ষাটাই দিতে পারিনি। প্র্যাক্টিক্যাল দেওয়া ছিল, তাই রক্ষে। ইংরেজি সাহিত্যের পরীক্ষা দিয়েছি হাসপাতালের বিছানায় শুয়েই। বাকিগুলোতে ভরসা ছিল এক জন রাইটার।” সৌম্যরূপ আইএসসি-তে পেয়েছে ৮৪ শতাংশ নম্বর।
হেরিটেজ স্কুলের আদিত্য জয়সোয়ালও আইএসসি পরীক্ষা দিতে শুরু করেছিল সুস্থ শরীরে। অঙ্ক পরীক্ষা দিতে দিতেই শুরু হয় পেটব্যথা। যন্ত্রণা বাড়তে থাকায় হাসপাতালে ভর্তি করতে হয় তাকে। তার পরে অস্ত্রোপচার। যার ৩৬ ঘণ্টা পরে হাসপাতালে শুয়েই ইংরেজি প্রথম পত্রের পরীক্ষা দিয়েছে সে। আদিত্যর কথায়, “তখনও যন্ত্রণা। দাঁড়াতেই পারছিলাম না। দিনে বরাদ্দ ছিল প্রায় ৩০টা ওষুধ। কোনও রকমে রাইটারের সাহায্য নিয়ে বাকি পরীক্ষাগুলো দিই।” এ ভাবে পরীক্ষা দিয়েও শেক্সপিয়র সরণির বাসিন্দা আদিত্যর মার্কশিটে কিন্তু ৮৩.২৫ শতাংশ নম্বর।
বোর্ডের পরীক্ষার চেয়েও অনেক কঠিন পরীক্ষা পেরিয়ে এখন আত্মবিশ্বাসী ওরা। |
|
|
|
|
|