|
|
|
|
ফাইল চাইছে সিবিআই-ও |
শূন্য পদেই পোক্ত দুর্নীতি, আক্ষেপ রেলে
অমিতাভ বন্দ্যোপাধ্যায় • কলকাতা |
|
|
অভিভাবক কে, তা-ই অনেক সময়ে বোঝা যাচ্ছে না। জেনারেল ম্যানেজারের পদ ফেলে রাখা হচ্ছে মাসের পর মাস। ওই দীর্ঘ সময় ধরে যথাযথ কর্তৃত্বের অভাবে বেসামাল হয়ে পড়ছে ভারতীয় রেলের এক-একটা জোন!
আর এর ফলেই রেল-প্রশাসনের অলিন্দে দুর্নীতি বাসা বাঁধছে বলে অভিযোগ রেল মন্ত্রকের একাংশের। সম্প্রতি অভিযোগ উঠেছে, রেল বোর্ডের সদস্য (ইলেকট্রিক্যাল) পদ ‘পাইয়ে দেওয়ার’ বিনিময়ে পশ্চিম রেলের জেনারেল ম্যানেজার মহেশকুমারের কাছে দু’কোটি টাকা ঘুষ চেয়েছিলেন সদ্য প্রাক্তন রেলমন্ত্রী পবন বনশলের ভাগ্নে বিজয় সিংলা। উৎকোচ দাতা ও গ্রহীতা দু’জনেই সিবিআইয়ের জালে পড়েন। রেলে দুর্নীতির রমরমা নিয়ে শোরগোল শুরু হয়। পবন বনশল পদত্যাগ করতে বাধ্য হন। রেল-কর্তাদের একাংশ একে বিচ্ছিন্ন ঘটনা হিসেবে দেখলেও বড় অংশের দাবি, রেলওয়ে জোনকে অভিভাবকহীন করে রাখার ‘রাজনৈতিক প্রবণতার’ই ফলশ্রুতি হল এই জাতীয় ঘটনা। “জিএমের চেয়ারে লোক না-বসানোয় যে দুর্নীতি রয়েছে, মহেশকুমার ঘুষ-কাণ্ড তারই প্রতিফলন মাত্র।’’ মন্তব্য এক রেল-কর্তার।
বস্তুত মহেশকুমার-তদন্তের জেরে সিবিআই এখন এই দিকটিতেও নজর দিয়েছে। কোথায় কোথায় জিএমের পদ কত দিন ধরে ফাঁকা, সেই সংক্রান্ত ফাইল তারা চেয়ে পাঠিয়েছে বলে রেল-সূত্রের খবর।
উল্লেখ্য, সম্প্রতি তথ্যের অধিকার আইনে রেল বোর্ড জানিয়েছে, বিভিন্ন জোনে জিএমের পদগুলো প্রায় ছ’মাস খালি পড়ে থাকছে, যা কখনওই কাম্য নয়। নিয়ম অনুযায়ী, রেল পরিষেবায় অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ও ক্ষমতাশালী এই পদ এক দিনও শূন্য থাকবে না। এক জন জিএম বিদায় নেওয়ার আগে তাঁর উত্তরসূরি দায়িত্বভার বুঝে নেবেন। বোর্ড সদস্যদের বেলাতেও তা-ই। দু’টি ক্ষেত্রেই ফি বছর সিনিয়রিটি ও অভিজ্ঞতার ভিত্তিতে প্রার্থী-তালিকা তৈরি হয়। নির্দিষ্ট চাকরির মেয়াদসম্পন্ন (নূন্যতম এক বা দু’বছর) পদস্থ অফিসারেরা বিবেচিত হন। পদ যেমন যেমন খালি হয়, সেই মতো তালিকার ক্রমিক নম্বর অনুযায়ী নাম প্রস্তাব করা হয়। কিন্তু মন্ত্রকের একাংশের অভিযোগ, ইদানীং বহু ক্ষেত্রে রাজনৈতিক স্বার্থসিদ্ধির লক্ষ্যে সব নিয়ম-কানুন ওলটপালট করে দেওয়া হচ্ছে।
শীর্ষ কর্তার নিরন্তর নজরদারির সুযোগে জোনে-জোনে পোক্ত হচ্ছে দুর্নীতির আখড়া।
এই মুহূর্তে কলকাতা মেট্রো-সহ ভারতীয় রেলের অন্তত পাঁচটি জোনে স্থায়ী জিএম বলে কেউ নেই। বছর-বছর নিয়মিত তালিকা হলেও নিয়োগ হচ্ছে না। রাজনৈতিক নেতাদের পছন্দসই প্রার্থী ও ‘দর’ ঠিক না-হওয়াতেই খালি চেয়ারগুলোয় লোক বসানো হচ্ছে না বলে বাম প্রভাবিত একাধিক ইউনিয়ন অভিযোগ তুলেছে। এমনও অভিযোগ উঠেছে যে, যোগ্য প্রার্থী থাকা সত্ত্বেও একই লোককে একাধিক পদের অস্থায়ী ভার দেওয়া হচ্ছে। যেমন চিত্তরঞ্জন লোকোমোটিভের জিএম রাধেশ্যাম বছরখানেক যাবৎ কলকাতা মেট্রোর জেনারেল ম্যানেজারের বাড়তি দায়িত্ব সামলাচ্ছেন। ফলে দু’টোর একটাও ঠিকঠাক চলছে না বলে আক্ষেপ শোনা যাচ্ছে কর্মী-অফিসার-ইউনিয়নের বেশ কিছু মহলে।
কিন্তু জোনের দৈনন্দিন কাজকর্ম দেখভালের গুরুদায়িত্ব যাঁর হাতে, সেই জিএমের মতো অতীব প্রয়োজনীয় পদটি এ ভাবে ফাঁকা রাখা হচ্ছে কেন?
রেল-কর্তাদের একাংশের অভিমত, জেনারেল ম্যানেজারের পদের গুরুত্ব যতটা, দুর্নীতির সুযোগও ততটাই। চেয়ার খালি ফেলে রাখা মানে পদের দাবিদারদের সঙ্গে দরাদরির সুযোগ করে দেওয়া। রেল বোর্ডের সদস্য নির্বাচনের ক্ষেত্রেও একই কথা প্রযোজ্য। বোর্ড সূত্রের দাবি, এই দুর্নীতির বীজ পোঁতা হয়েছিল বছর সাতেক আগে, রেলমন্ত্রী যখন লালুপ্রসাদ। লালুর জমানায় ফাঁকা পদে নিয়োগ তো দূর, বিভিন্ন জোনের জিএম’কে সময়ের আগে বদলি করে দেওয়ায় প্রশাসনিক কাজকর্মে ডামাডোল শুরু হয়। মন্ত্রকের খবর, ওই সময়ে পূর্ব রেলের জিএম এসএস খুরানাকে আচমকা মেয়াদ ফুরনোর আগে বদলি করা হয়েছিল। অভিযোগ, মালদহের এক অনুষ্ঠানে লালুর পায়ে নোংরা লেগে যাওয়ায় ‘অদক্ষ’ তকমা লাগিয়ে খুরানাকে বিদায় করা হয়। যদিও শেষ পর্যন্ত তিনি রেল বোর্ডের চেয়ারম্যান হয়েছিলেন। আবার লালু-জমানায় এক জুনিয়র অফিসারকে ফিনান্স কমিশনের মাথায় বসানো শুধু নয়, তাঁকে দিয়ে বাজেট করানোরও দৃষ্টান্ত রয়েছে।
লালুর পরে রেলমন্ত্রী হয়েছিলেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। তুঘলকি আচরণের অভিযোগ তাঁর বিরুদ্ধেও মজুত। রেল-সূত্রের দাবি: পূর্ব রেলের এক অনুষ্ঠানে মমতার বক্তব্য পেশের আগেই নতুন ট্রেন ঘোষণা করে দিয়েছিলেন তদানীন্তন জিএম দীপক কৃষাণ, যার পরিণতিতে তাঁকে রাতারাতি বদলি করা হয়। পাশাপাশি অভিযোগ, যোগ্য প্রার্থী থাকা সত্ত্বেও মমতার আমলে বিবেক সহায়কে রেল বোর্ডের চেয়ারম্যান ও বোর্ড সদস্যের (ট্রেন চলাচল) দু’টি পদে এক সঙ্গে বসানো হয়। বিবেক বছরখানেক এ ভাবে চালিয়েছিলেন।
এবং এই রেওয়াজের মধ্যে দুর্নীতির সঙ্গে সঙ্গে বঞ্চনার দরজাও খোলা দেখতে পাচ্ছেন রেল-কর্তাদের অনেকে। রেলের অফিসার অ্যাসোসিয়েশনের বক্তব্য: পদ ফাঁকা ফেলে রাখা হলে পরের ধাপের কর্মীদেরও উন্নতির পথ আটকে যায়। বিশেষত যাঁরা জিএম কিংবা বোর্ড মেম্বার হওয়ার যোগ্যতা
রাখেন, সময়ের দৌড়ে তাঁরা পিছিয়ে যান, অনেকের সামনে থেকে পাকাপাকি ভাবে সরে যায় উন্নতির সিঁড়ি। যেমন হয়েছে বোর্ডের প্রাক্তন অতিরিক্ত সদস্য সুভাষরঞ্জন ঠাকুরের বেলায়। অভিযোগ, যোগ্যতা সত্ত্বেও স্রেফ চাকরির মেয়াদের অভাবে জেনারেল ম্যানেজারের সমতুল মর্যাদা থেকে তিনি বঞ্চিত হয়েছেন।
তবে অভিযোগ যতই থাকুক, রেল বোর্ডের খবর হল, এ সব সিদ্ধান্ত খোদ প্রধানমন্ত্রীর অফিস ও স্বরাষ্ট্র মন্ত্রকের অনুমোদনক্রমে গৃহীত হয়েছে। তাই দুর্নীতির শিকড় কত গভীরে, তা নিয়ে সংশয় দানা বেঁধেছে কেন্দ্রীয় শীর্ষ প্রশাসনের অন্দরে। বিশেষত মহেশকুমার-কাণ্ডের পরে প্রধানমন্ত্রীর অফিস নড়ে-চড়ে বসেছে। শুরু হয়েছে শূন্য পদ ও একাধিক দায়িত্বের খতিয়ান নেওয়া।
রেলের শীর্ষস্তরকে সন্দেহের কালিমামুক্ত প্রয়াস কতটা এগোয়, এখন সেটাই দেখার।
|
পুরনো খবর: ঘুষ-কাণ্ডে জড়ালেন রেলমন্ত্রীর আত্মীয় |
|
|
|
|
|