নেই সিটি স্ক্যান, ডিজিটাল এক্স-রে, ডায়ালিসিস ইউনিট। নেই পৃথক থ্যালাসেমিয়া কেয়ার ইউনিটও। চালু হয়নি ট্রমা ইউনিট। ‘কোল্ড অপারেশন’-এর সংখ্যাও কম। ব্লাড ব্যাঙ্কে কোনও স্থায়ী চিকিত্সক নেই। রক্ত সংগ্রহের কিটের অভাবে নিত্যদিন সঙ্কটে থাকে সেই ব্লাড ব্যাঙ্কও।
মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় ‘জেলা হাসপাতাল’ হিসেবে ঘোষণা করার দেড় বছর পরেও এমনই হাল রামপুরহাট মহকুমা হাসপাতালের।
সমস্যা শুধু এখানেই থেমে নেই। সঙ্কট হাসপাতালের শয্যা থেকে চিকিত্সক-কর্মীর সংখ্যাতেও। অথচ মুখ্যমন্ত্রীর সেই ঘোষণার পরে গত বছর ২১ ফেব্রুয়ারিতেও এসএনসিইউ বিভাগের উদ্বোধন করতে এসে, এই হাসপাতালকে ‘মাল্টি ফাংশনাল সুপার স্পেশালিটি হাসপাতাল’-এ রূপান্তরিত করার কথা ঘোষণা করেছিলেন তত্কালীন স্বাস্থ্য প্রতিমন্ত্রী চন্দ্রিমা ভট্টাচার্যও। উন্নয়নের সেই ঘোষণাও কেবল ‘ঘোষণা’ই রয়ে গিয়েছে।
এ দিকে উত্তরবঙ্গ থেকে দক্ষিণবঙ্গ সর্বত্রই এখন শোনা যাচ্ছে, ‘উন্নয়নের পথে, সকলের সাথে’। উপলক্ষ, রাজ্য সরকারের দু’বছর পূর্তি। কোটি কোটি টাকা খরচ করে রাজ্য জুড়ে শুরু হয়েছে ‘প্রগতি মেলা’। রাজ্য সরকারের উন্নয়নমূলক নানা কার্যকলাপের তালিকা তুলে ধরা হচ্ছে সেখানে। রামপুরহাট শহরও তার ব্যতিক্রম নয়। সেখানে প্রাণিসম্পদ বিকাশ দফতর সরকারের নানা সাফল্যের কথা তুলে ধরেছে। কিন্তু মুখ্যমন্ত্রী ও তত্কালীন স্বাস্থ্য প্রতিমন্ত্রীর ঘোষণার এত দিন পরে কী হাল এই হাসপাতালের? রোগী থেকে ওই হাসপাতালের সঙ্গে যুক্ত অনেকেরই অভিযোগ, এখন রামপুরহাট মহকুমা হাসপাতালের পরিষেবার মান কার্যত নিম্নমুখী। কারণ, জেলা হাসপাতাল পর্যায়ের পরিকাঠামো রামপুরহাট মহকুমা হাসপাতালে তো গড়েই ওঠেনি, উপরন্তু সামান্য কিছু ক্ষেত্রে পরিকাঠামো গড়ে উঠলেও সাধারণ মানুষ এখনও পর্যন্ত সেই পরিষেবা থেকে বঞ্চিত। |
জেলার মুখ্য স্বাস্থ্য আধিকারিক গুরুদাস পাত্র কিন্তু দাবি করছেন, “জেলা হাসপাতাল ঘোষণার পরে ওই হাসপাতালে একজনকে সিএমওএইচ হিসেবে নিযুক্ত করা হয়েছে। হাসপাতালে ন্যায্য মূল্যের ওষুধের দোকান চালু হয়েছে। পরিকাঠামো আরও বাড়ানোর চেষ্টা চলছে।”
কিন্তু তাতেও কি কিছু বদলেছে?
নিজের হাসপাতালের একের পর এক সমস্যার কথা তুলছেন খোদ হাসপাতাল সুপার হিমাদ্রি হালদারই। তিনি জানিয়েছেন, জেলা হাসপাতালের জন্য ৫০০ শয্যা দরকার। সেখানে এখানে রয়েছে মাত্র ২৮৬টি। কিন্তু ‘জেলা হাসপাতাল’ ঘোষণার পরেও শয্যা বাড়েনি। তাঁর কথায়, “রোগীদের চাপের কথা ভেবে হাসপাতালের শিশু বিভাগের শয্যা সংখ্যা ১০ থেকে বাড়িয়ে ৪০ করা হয়। কিন্তু স্বাস্থ্য ভবন থেকে এখনও পর্যন্ত তার অনুমতি মেলেনি।” হিমাদ্রিবাবু আরও জানান, সদ্যোজাত শিশুদের জন্য (অপেক্ষাকৃত সুস্থ এক মাসের শিশুদের ক্ষেত্রে) একটি নতুন ভবন নির্মাণ করে সেখানে ২০টি শয্যা করা হয়েছে। স্বাস্থ্য ভবন থেকে প্রয়োজনীয় নার্স, চতুর্থ শ্রেণির কর্মী না পাওয়ার জন্য সেই নতুন বিভাগ এখনও চালু করা যায়নি।
হাসপাতাল সূত্রে জানা গিয়েছে, সার্জিক্যাল বিভাগে দৈনিক প্রায় ৩০ জন রোগী ভর্তি হন। প্রথমত, ৬০ নম্বর রানিগঞ্জ-মোরগ্রাম জাতীয় সড়কের প্রাই দিন দুর্ঘটনা ঘটে। দ্বিতীয়ত, মহকুমার নলহাটি, মুরারই, রামপুরহাট ছাড়াও লাগোয়া ঝাড়খণ্ডের পাথর শিল্পাঞ্চলে দুর্ঘটনার কবলে পড়া রোগীরাও রামপুরহাটে এসে ভর্তি হন। সেই ৩০ জন রোগীর মধ্যে আবার ১৫ জনেরই অর্থোপেডিক সংক্রান্ত পরিষেবারও দরকার পড়ে। অথচ ২০১১ সালের মাঝামাঝি সময় থেকে এমন একটি গুরুত্বপূর্ণ বিভাগে কোনও স্থায়ী বিশেষজ্ঞ চিকিত্সক নেই। এমনকী চুক্তির ভিত্তিতে নিযুক্ত ‘ন্যাশনাল রুরাল হেলথ্ মিশন’ থেকে পাওয়া একমাত্র অর্থোপেডিক চিকিত্সকও সম্প্রতি কাজ থেকে ইস্তফা দিয়েছেন। এর ফলে অর্থোপেডিক বিভাগ কার্যত চিকিত্সক শূন্য। রোগীর চাপ ঠেকাতে অর্থোপেডিক চিকিত্সক না থাকার কথা বিভাগের বহির্বিভাগে নোটিসও টাঙিয়ে দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেয়েছেন হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ। এই পরিস্থিতিতে হাসপাতালের শল্য চিকিত্সক সৌরভ মাঝি-র প্রশ্ন, “অর্থোপেডিক চিকিত্সক না থাকায় আমাকে একাই ৬০ জন রোগীকে দেখতে হচ্ছে। এটা কি বাস্তবে সম্ভব?” |
সমস্যা যেখানে |
• মোট চিকিত্সক ৩২। দরকার ৭০ জন।
• শিশুবিভাগে প্রয়োজন ৪, আছে ১।
• সার্জিক্যাল ওয়ার্ডে আছে ২, প্রয়োজন ৪।
• অর্থোপেডিকে বর্তমানে কোনও চিকিত্সক নেই। দরকার ২।
• স্ত্রীরোগ বিশেষজ্ঞ প্রয়োজন ৪, আছে ২ জন।
• নার্স আছে ৬৬ জন, প্রয়োজন ১২৫ এবং চতুর্থ শ্রেণির কর্মী দরকার ২৫০, আছে ৫৬।
• ফার্মাসিস্ট আছে ৬, দরকার ১২।
• শয্যা দরকার ৫০০, আছে ২৮৬। |
|
হাসপাতাল সূত্রে আরও খবর, ২০১১ সালের জুন মাসে রাজ্য সরকারের জারি করা নির্দেশ অনুযায়ী এই ধরনের হাসপাতালের জরুরি বিভাগে দু’জন করে চিকিত্সক থাকার কথা। সেখানে ২৪ ঘণ্টার জন্য ডিউটি দেবেন নার্স ও ফার্মাসিস্টরা। ‘জেলা হাসপাতাল’ হওয়া দূর অস্ত, প্রয়োজনীয় চিকিত্সক, নার্স, ফার্মাসিস্ট ও কর্মীর অভাবে তিন বছর আগের সেই নির্দেশই কার্যকর হয়নি, এই হাসপাতালে। হাসপাতালের সহকারী সুপার সুদীপ্ত মণ্ডল জানিয়েছেন, ঠিক একই কারণে জেলা হাসপাতাল ঘোষণার পরে জরুরি বিভাগে ৪ শয্যার ‘অবজার্ভেশন ওয়ার্ড’ তৈরি হয়েও তা এখনও রোগীদের জন্য চালু করা যায়নি।
সম্প্রতি নার্সের অভাবে সংক্রামক বিভাগটিও বন্ধ হয়ে গিয়েছে। সুদীপ্তবাবু বলেন, “২৮৬টি শয্যার জন্য ৪ঃ১ অনুপাতে ৭৩ জন নার্স থাকার কথা। কিন্তু হাসপাতালের স্বার্থে শয্যা বাড়ানোয় বেশ কিছু বিভাগে অতিরিক্ত নার্স পাঠাতে হয়েছে। ফলে অন্যান্য বিভাগে নার্স নিয়ে চাপ তৈরি হয়েছে। সংক্রামক বিভাগটিকেও আপাতত বন্ধ রাখতে হয়েছে।” তিনি জানিয়েছেন, শিশু বিভাগে শয্যা সংখ্যা বাড়ানোর জন্য সেখানে অতিরিক্ত নার্স পাঠাতে হয়েছে। এসএনসিইউ বিভাগ চালু হওয়ার পর সেখানে ১০ জন নার্স প্রয়োজন ছিল। পাওয়া গিয়েছে ৬ জন। বাকি ৪ জন নার্স হাসপাতালের জন্য নিযুক্তদের মধ্যে থেকে দিতে হয়েছে। এ ছাড়া কয়েকজন নার্সকে তাঁদের পড়াশোনার জন্যও ছাড়তে বাধ্য হয়েছেন হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ।
হাসপাতালের এই সামগ্রিক বেহালের কথা স্বীকার করে নিয়েছেন দায়িত্বপ্রাপ্ত নতুন মুখ্য স্বাস্থ্য আধিকারিক রাধানাথ মাড্ডি। তিনি বলেন, “হাসপাতালের নানা ক্ষেত্রে বেশ কিছু সমস্যা রয়েছে। এই পরিকাঠামোতেও আমরা ভাল পরিষেবা দেওয়ার চেষ্টা করছি। তবে পরিকাঠামোর উন্নয়ন ঘটলে পরিষেবার মান আরও বাড়বে। আমরা এ বিষয়ে ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের দৃষ্টি আকর্ষণ করছি।”
|
পুরনো খবর: চালু হল এসএনসিইউ |