তাড়াতাড়ি অভিযোগ জমা দিয়েই বাড়ির পথ ধরার কথা ভেবেছিলেন জনাইয়ের মন্টু সাঁতরা। কিন্তু বেলা ১১টা নাগাদ সারদা কেলেঙ্কারির তদন্তে গড়া কমিশনের অফিসে পৌঁছে তাঁর চক্ষু প্রায় চড়কগাছ! প্রতিটি কাউন্টারেই থিকথিক করছে ভিড়। দূর থেকে দেখলে মনে হবে, কয়েকটা ময়াল সাপ এঁকেবেঁকে শুয়ে রয়েছে।
হতভম্ব মন্টুবাবু সাত-পাঁচ না-ভেবে লাইনে দাঁড়িয়ে পড়েন। ঘণ্টা তিনেক পরে অভিযোগ জমা দিয়ে বাড়ি ফেরার পথে তাঁর প্রতিক্রিয়া, “উফ্! এত ভিড় হবে জানলে ভোরবেলা এসে হত্যে দিতাম।”
শুধু মন্টুবাবু নন, সোমবার নিউ টাউনে শ্যামল সেন কমিশনের অফিসে অভিযোগপত্র জমা দেওয়ার জন্য এমন ভিড় দেখে অবাক হয়েছেন অনেকেই। কমিশন সূত্রের খবর, এ দিন ৩৮,৫০০টি অভিযোগপত্র জমা পড়েছে। এক দিনে অভিযোগ পেশের নিরিখে এটা রেকর্ড। অভিযোগ নেওয়ার জন্য এ দিন বিকেল সাড়ে ৫টা পর্যন্ত ৩৯টি কাউন্টার খোলা ছিল। আগে খোলা হয়েছিল ৩৪টি কাউন্টার। এ দিন ভিড় সামলাতে আরও পাঁচটি কাউন্টার খোলা হয়। এ-পর্যন্ত কমিশনে প্রায় সওয়া লক্ষ অভিযোগপত্র জমা পড়েছে। শিলিগুড়ির অফিসে এ দিন জমা পড়েছে প্রায় দেড় হাজার অভিযোগ। এই নিয়ে উত্তরবঙ্গ থেকে মোট ২১০০টি অভিযোগ পেল কমিশন। |
শ্যামল সেন কমিশনের অফিস থেকে অভিযোগে ঠাসা ট্রাঙ্ক সরাচ্ছেন পুলিশকর্মীরা। —নিজস্ব চিত্র |
নালিশের ঠেলায় কমিশনের হাঁসফাঁস দশা। কয়েক দিন ধরেই প্রচুর সংখ্যায় অভিযোগপত্র আসছে। শনিবার সংখ্যাটি ছিল ২২,৬৬০। শুক্রবার প্রায় ২৯ হাজার অভিযোগপত্র জমা পড়ে। পুলিশ জানায়, কমিশনে এজেন্টরা এসে হত্যে দিচ্ছেন। সাধারণ আমানতকারীরাও আসছেন। আমানতকারীদের কাজ এক দিনে মিটে গেলেও এজেন্টদের দিনের পর দিন আসতে হচ্ছে। কেন?
কৌশিক বিশ্বাস নামে সারদার এক এজেন্ট বলেন, “এক দিনে এক জনের কাছ থেকে ২৫টির বেশি অভিযোগপত্র জমা নেওয়া হচ্ছে না। আমার কাছে শতাধিক আমানতকারীর অভিযোগপত্র রয়েছে। ফলে তিন দিন ধরে আমাকে আসতে হচ্ছে।” অভিযোগ জমা দেওয়ার জন্য বনগাঁর বাসিন্দা কৌশিকবাবু এখন কসবায় এক আত্মীয়ের বাড়িতে রয়েছেন। তিনি বলেন, “মঙ্গলবারেও আমাকে কলকাতায় থাকতে হবে।”
সারদা গোষ্ঠীর আর্থিক কেলেঙ্কারি নিয়ে সিবিআই তদন্ত হবে কি না, তা নিয়ে আজ, মঙ্গলবার শুনানি রয়েছে। মহাকরণ ও পুলিশি সূত্রের খবর, ওই মামলায় একটি নথি পেশ করবে সরকার। সেই নথিতে বিধাননগর কমিশনারেটের গোয়েন্দারা তদন্তের অগ্রগতির কথা তুলে ধরছেন। পুলিশি সূত্রের খবর, তদন্তের শুরু থেকে এ দিন পর্যন্ত কত টাকা ও সম্পত্তি-নথি বাজেয়াপ্ত করা হয়েছে, কাকে কাকে জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়েছে, কে কে বিচারকের কাছে গোপন জবানবন্দি দিয়েছেন, কী ভাবে সম্পত্তির খোঁজ চলছে, তা জানিয়ে ৯০ পাতার একটি রিপোর্ট স্বরাষ্ট্র দফতরে পাঠিয়েছেন কমিশনারেটের কর্তারা। এক পুলিশকর্তার দাবি, সিবিআই যে-ভাবে এই ধরনের ঘটনার তদন্ত করে, বিধাননগর পুলিশের তদন্তকারীরাও সেই পথেই এগোচ্ছেন। এ কথা নথিতে উল্লেখ করা হয়েছে। কমিশনে কত অভিযোগ জমা পড়ছে, তা-ও জানানো হয়েছে ওই নথিতে। অনেকেই মনে করছেন, সিবিআইয়ের হাতে তদন্তভার দেওয়ার বিরোধিতায় এই নথিকে হাতিয়ার করতে পারে রাজ্য সরকার।
এ দিনও সারদার এক প্রাক্তন কর্তাকে জেরা করেছে পুলিশ। পুলিশ জানায়, সুবীর দাস নামে ওই ব্যক্তি সারদা রিয়েলটি-র ‘সিইও’ ছিলেন। তবে ২০০৮ সালে তিনি চাকরি ছেড়ে দেন। তদন্তকারীরা জেনেছেন, সুবীরবাবু এবং অন্য এক ব্যক্তির হাত ধরেই সুদীপ্ত সেন নির্মাণ ব্যবসায় নামেন। রবিবার জেরা করা হয়েছিল, সারদা নির্মাণ সংস্থার প্রাক্তন কর্তা কর্নেল সৌমিত্র রায়কে। কেন বিষ্ণুপুর ও কাঁথির জমিতে প্রকল্প রূপায়ণ করা হয়নি, তা জানতে চাওয়া হয়েছিল। পুলিশ জানায়, এর উত্তরে সংস্থার বেহাল দশাকে দায়ী করেন সৌমিত্রবাবু। এবং এই কারণেই তিনি গত ডিসেম্বরে চাকরি ছাড়েন।
তবে তদন্তে এখনও অনেক তথ্য পায়নি পুলিশ। এক গোয়েন্দা অফিসার জানান, সেই সব তথ্যের জন্য সুদীপ্তের পরিবারের খোঁজ চলছে। পুলিশ জানায়, সুদীপ্তের দুই স্ত্রী মধুমিতা ও পিয়ালি, ছেলে শুভজিৎ-সহ গোটা পরিবারই ফেরার। একটি সূত্রের খবর, তাঁরা ভিন্ রাজ্যে আছেন। তবে সেটা কোথায়, তা পুলিশ জানাতে চায়নি। বিধাননগর কমিশনারেটের এক শীর্ষ কর্তা বলেন, “তদন্তের স্বার্থেই এটা বলা যাবে না। তবে সুদীপ্তের পরিবার যাতে দেশ ছেড়ে পালাতে না-পারে, তার ব্যবস্থা করা হয়েছে।” এ দিন দুপুরে বনগাঁয় সারদা লগ্নি সংস্থার অফিস সিল করে দেয় পুলিশ। উত্তর ২৪ পরগনার প্রতিটি থানার এক জন অফিসারকে সারদা কাণ্ডের জন্য নোডাল অফিসার হিসেবে নিয়োগ করা হয়েছে। তিনি জেলা এনফোর্সমেন্ট শাখার অধীনে কাজ করছেন। বনগাঁয় সারদার যে-সব জমি-বাড়ি রয়েছে, জেলা এনফোর্সমেন্ট শাখা তার সবই বাজেয়াপ্ত করতে উদ্যোগী হয়েছে।
|