মাত্র ছ’মাস আগে বিরোধী দলের আপত্তি, অন্যান্য আইপিএস অফিসারদের ক্ষোভ অগ্রাহ্য করেই রঞ্জিত সিন্হাকে সিবিআইয়ের দায়িত্ব দিয়েছিল মনমোহন সিংহের সরকার। আর সেই রঞ্জিত সিন্হাই এখন মনমোহন সরকারকে সবথেকে বেশি বিপাকে ফেলে দিয়েছেন! এক দিকে সুপ্রিম কোর্টে তাঁর দেওয়া হলফনামার ধাক্কায় গদি খুইয়েছেন আইনমন্ত্রী অশ্বিনী কুমার। সিবিআই তদন্তে সরকার যে নাক গলিয়েছিল, তা খোলসা করে দিয়ে স্পষ্ট ভাষায় বলছেন, শীর্ষ আদালত যে সিবিআইকে ‘খাঁচার তোতা’ বলেছে, তা একদম ঠিক। সিবিআইয়ের কাজে বরাবরই নাক গলানো হয়। অন্য দিকে রেলের উচ্চপদে নিয়োগ সংক্রান্ত দুর্নীতিতে সিবিআই তদন্তের জেরেই
|
রঞ্জিত সিন্হা |
পদত্যাগ করতে হয়েছে রেলমন্ত্রী পবন বনশলকে। এখানেই না থেমে রেল মন্ত্রকে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের জমানায় নিয়োগের ক্ষেত্রেও দুর্নীতি হয়েছে কি না, তা নিয়েও তদন্ত করতে চাইছেন সিবিআই-প্রধান। সিবিআই সূত্রে বলা হচ্ছে, এ বিষয়ে মুখ্যমন্ত্রীর সচিব গৌতম সান্যালের ভূমিকাও খতিয়ে দেখা হবে। গৌতমবাবু সে সময় রেলমন্ত্রীর ওএসডি (অফিসার অন স্পেশ্যাল ডিউটি) পদে ছিলেন। এই ঘটনায় ক্ষুব্ধ তৃণমূল নেতৃত্ব দিল্লি-সহ দেশ জুড়ে আন্দোলনে নামার হুমকি দিয়েছেন।
বিহার ক্যাডারের এই আইপিএস অফিসারকে নিয়ে বিতর্ক অবশ্য প্রথম নয়। তিনি প্রথম আলোয় আসেন লালুপ্রসাদের পশুখাদ্য কেলেঙ্কারির সময়। পশুখাদ্য কেলেঙ্কারির তদন্তভার তখন সিবিআইয়ের যুগ্ম-নির্দেশক উপেন বিশ্বাসের কাঁধে। রঞ্জিত সিন্হা তখন সিবিআই-এর ডিআইজি, পটনায় নিযুক্ত। অভিযোগ ওঠে, তদন্তে লালুপ্রসাদকে সুবিধা করে দিতে চেয়েছিলেন সিন্হা। তিনি লালুপ্রসাদের বিরুদ্ধে রিপোর্ট লঘু করে দিতে চেয়েছিলেন বলেও অভিযোগ। রঞ্জিত সিন্হার রিপোর্টের বিরুদ্ধে আদালতে উপেন বিশ্বাস সরব হন। সিবিআই সদর দফতরেও সিন্হার বিরুদ্ধে অভিযোগ জানান উপেন।
এর পরেও অবশ্য লালুপ্রসাদের সঙ্গে সিন্হার ঘনিষ্ঠতা কমেনি। লালু তাঁকে দিল্লিতে বিহার ভবনে নিয়োগ করেন। সিবিআইতে তাঁর বিরুদ্ধে যাবতীয় মামলায় সিন্হা যাতে প্রভাব খাটাতে পারেন, সে জন্যই লালু এমনটা করেছিলেন বলে বিজেপি নেতাদের অভিযোগ। তাঁদের দাবি, এই সবের বিনিময়েই ইউপিএ-জমানায় রেলমন্ত্রী হওয়ার পরে লালু আরপিএফ-এর ডিজি-র পদে নিয়ে আসেন সিন্হাকে। নর্থ ব্লকের অলিন্দে কানাঘুষোয় শোনা যায়, ইউপিএ-সরকারের রাজনৈতিক ও প্রশাসনিক স্তরেও অনেকের সঙ্গে সিন্হার ঘনিষ্ঠতা রয়েছে।
মমতা রেলমন্ত্রী হওয়ার পরে সিন্হার বিরুদ্ধে অভিযোগের ভিত্তিতে তাঁকে ওই পদ থেকে সরিয়ে দেন। তৃণমূলের নেতাদের অভিযোগ, মমতার বিরুদ্ধে বদলা নেওয়ার জন্যই এখন তাঁর আমলে রেলের নিয়োগ নিয়ে তদন্ত করতে চাইছেন সিবিআই প্রধান। এর জন্য কংগ্রেসেরও দুষছেন তাঁরা। বর্ধমানের জনসভাতেও এই অভিযোগ তুলেছেন মমতা। তৃণমূল নেতৃত্বের অভিযোগ, মমতাকে কালিমালিপ্ত করতেই গৌতম সান্যালের নাম টেনে আনা হচ্ছে। কেন্দ্রীয় সেক্রেটারিয়েট সার্ভিসের অফিসার গৌতমবাবুকে প্রথম রেল মন্ত্রকে নিয়ে আসেন বরকত গনিখান চৌধুরী। গৌতমবাবু এখন মুখ্যমন্ত্রীর সচিব হিসেবে রাজ্য সরকারের গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্বে রয়েছেন। তাই তাঁকে আক্রমণ করার অর্থ রাজ্য সরকারকেও আক্রমণ করা। গৌতম সান্যালের মতামত ছাড়াই তাঁর বিরুদ্ধে খবর প্রকাশের জন্য সংবাদমাধ্যমগুলির বিরুদ্ধেও মামলা করা হবে বলে জানিয়েছেন তৃণমূল নেতা ফিরহাদ হাকিম। পশ্চিমবঙ্গে সারদা-কাণ্ডে সিবিআই তদন্তের দাবি জানিয়ে আসছে বিরোধীরা। এখনও পর্যন্ত সেই দাবি মানেননি মমতা। তবে তৃণমূল নেতৃত্ব জানিয়ে দিয়েছেন, এই ঘটনায় যদি আদালতের নির্দেশে শেষ পর্যন্ত সিবিআই তদন্ত হয়, তা হলেও রঞ্জিত সিন্হার নেতৃত্বে তদন্ত হতে দেওয়া যাবে না। এখন যাঁকে নিয়ে এত বিতর্ক, সেই রঞ্জিত সিন্হা কী বলছেন? সরাসরি গৌতম সান্যালের নাম না করলেও সিবিআই প্রধান জানিয়েছেন, গত চার বছরে রেলে নিয়োগ সংক্রান্ত যাবতীয় ফাইল খতিয়ে দেখা হচ্ছে। শুধু রেল বোর্ডে মহেশ কুমারের নিয়োগ এবং তার বিনিময়ে পবন বনশলের ভাগ্নেকে ঘুষ দেওয়ার মধ্যেই সিবিআই তদন্ত সীমাবদ্ধ থাকছে না। সিবিআইয়ের সন্দেহ, আরপিএফে নিয়োগের ক্ষেত্রে বাহিনীর অফিসারদের সংগঠন ও দালালদের একটি চক্র কাজ করছিল। যারা ঘুষ নিয়ে আরপিএফে চাকরির বন্দোবস্ত করে দিত। সূত্রের খবর, বিশেষ করে আরপিএফ-এর ডিজি পদে পি কে মেহতার নিয়োগও খতিয়ে দেখা হচ্ছে। মেহতার বিরুদ্ধে অভিযোগ, তিনি ২৮ জন সিনিয়র আইপিএস অফিসারকে টপকে আরপিএফের ডিজি পদে বসেন।
যিনি অন্যদের নিয়োগে দুর্নীতি রয়েছে কি না দেখছেন, সেই রঞ্জিত সিন্হার সিবিআই পদে নিয়োগও বিতর্কের ঊর্ধ্বে নয়। গত নভেম্বরে ইন্দো-টিবেটান বর্ডার পুলিশ (আইটিবিপি)-র ডিজি-র পদ থেকে যখন রঞ্জিত সিন্হাকে সিবিআই প্রধানের পদে নিয়োগ করা হয়, তখন প্রবল আপত্তি তুলেছিল বিজেপি। সুষমা স্বরাজ ও অরুণ জেটলি প্রধানমন্ত্রীকে চিঠি লিখে এই ব্যাপারে আপত্তি জানিয়েছিলেন। সিন্হার নিয়োগ নিয়ে সে সময় কেন্দ্রীয় প্রশাসনিক ট্রাইব্যুনালে মামলাও করেছিলেন বর্তমানে দিল্লির পুলিশ কমিশনার নীরজ কুমার। নীরজের অভিযোগ ছিল, তাঁকে তিন জনের প্রাথমিক বাছাই তালিকাতেই রাখা হয়নি। সে কারণেই বাকি দু’জনকে টপকে সিবিআই প্রধান হয়ে যান সিন্হা।
এত কিছু সত্ত্বেও কিন্তু এখনই সিন্হাকে সরানো সম্ভব হচ্ছে না কেন্দ্রের পক্ষে। কারণ তা হলে ফের সুপ্রিম কোর্টের তোপের মুখে পড়তে হতে পারে সরকারকে। তা ছাড়া অভিযোগ উঠতে পারে কয়লা খনি ও রেলের দুর্নীতি ধামাচাপা দিতেই সিন্হাকে সরানো হল। সিবিআইকে স্বাধীনতা দেওয়ার জন্য সুপ্রিম কোর্ট সরকারকে নির্দেশ দিয়েছে। এ বিষয়ে পি চিদম্বরমের নেতৃত্বে মন্ত্রী-আমলাদের যে গোষ্ঠী তৈরি হয়েছে, সেখানেও সিন্হার ভূমিকা রয়েছে। তাই রঞ্জিত সিন্হাকে এখনই সরিয়ে বিরোধীদের হাতে আর নতুন অস্ত্র তুলে দিতে চাইছে না কংগ্রেস।
|