দিব্যি ছিলেন জেলে। কাল হল ফোন করে।
জেলের মধ্যে বন্দিদের হাতে মোবাইল পৌঁছে যাওয়ার ঘটনা নতুন নয়। যে ভাবে অন্য বন্দিদের হাতে আসে, ঠিক সে ভাবেই মোবাইল পৌঁছে গিয়েছিল আলিপুর জেলে বন্দি তৃণমূল নেতা শম্ভুনাথ কাওয়ের কাছে। ফোন পেয়ে কী করবেন ভেবে না পেয়ে ফস করে নিজের দলেরই প্রভাবশালী মন্ত্রী-নেতাদের ফোন করতে শুরু করেন শম্ভুনাথ। জেলে আর ভাল লাগছে না, কী ভাবে জেল থেকে মুক্তি পাবেন, তাই নিয়ে কথা বলতে শুরু করেন তিনি। আর তাতেই বিপত্তি।
মন্ত্রিসভার কোনও এক প্রভাবশালী মন্ত্রী আচমকা জেল থেকে ফোন পেয়ে চমকে যান। কী করে শম্ভুনাথ মোবাইল ফোন হাতে পেলেন, তা জানতে তিনি বিষয়টি মুখ্যমন্ত্রীর দফতরের কয়েক জন কর্তাকে জানান। মুখ্যমন্ত্রীর দফতরের খবর আসতেই নড়েচড়ে বসেন রাজ্য প্রশাসনের কর্তারা। সঙ্গে সঙ্গে খবর যায় কারা দফতরের কাছে। কারা দফতর খবর পাঠায় আলিপুর জেলে। খোদ মুখ্যমন্ত্রীর দফতরের খোঁচা খেয়ে তড়িঘড়ি আলিপুর জেলে তল্লাশি চলে শম্ভুনাথের ওয়ার্ডে। উদ্ধার হয় আটটি মোবাইল ও সিম কার্ড।
অভিনব এই ঘটনায় তাজ্জব বনে গিয়েছেন রাজ্য প্রশাসনের শীর্ষ কর্তারা। বিব্রত রাজ্য কারা প্রশাসনও। আইজি (কারা) রণবীর কুমার বিষয়টি স্বীকারই করতে চাননি। তিনি বলেন, “এমন কোনও খবর আমার কাছে নেই।” এমনকী, আলিপুর জেল কর্তৃপক্ষও বিষয়টি নিয়ে মুখে কুলুপ এঁটেছেন। তবে জেল সূত্রের খবর, ঘটনার খবর আসার পরে জেলে হইচই পড়ে যায়। দফায় দফায় জেলের ভিতরে তল্লাশি চলে। এত কড়াকড়ি সত্ত্বেও কী ভাবে জেলের মধ্যে মোবাইল ঢুকল, তা নিয়েও তদন্ত শুরু হয়েছে। মহাকরণের এক কর্তার কথায়, “শম্ভুনাথের ফোনের ঘটনায় একেবারে তাজ্জব বনে গিয়েছে প্রশাসন। জেলে বেশ কয়েক বারই বিভিন্ন কয়েদির কাছ থেকে মোবাইল উদ্ধার হয়েছে। জেল থেকে তোলা আদায়, এবং হুমকি ফোনের অভিযোগও উঠেছে। কিন্তু এই ঘটনা একেবারেই অভিনব।”
জেলের মধ্যে ‘হাই প্রোফাইল’ বন্দিদের মোবাইল ফোনে বাইরে কথা বলার অভিযোগ অবশ্য নতুন নয়। গত অক্টোবরে জেলে বসে পাকিস্তানে স্ত্রী-র সঙ্গে মোবাইলে কথা বলা এবং ফেসবুক অ্যাকাউন্ট খোলার অভিযোগ ওঠে খাদিম কর্তা অপহরণ মামলা এবং আমেরিকান সেন্টারে হামলায় মূল অভিযুক্ত আফতাব আনসারির বিরুদ্ধে। গত বছরে শুধু কলকাতারই বিভিন্ন জেলে নানা সময়ে তল্লাশি চালিয়ে পাঁচশোরও বেশি মোবাইল ফোন উদ্ধার হয়েছে। এই অবস্থায় জেল কর্তৃপক্ষ এখন অন্তত কলকাতার চারটি জেলে জ্যামার ব্যবস্থা বসানোর পরিকল্পনা নিয়েছেন। কারা দফতরের এক কর্তার কথায়, “সর্ষের মধ্যেই ভূত থাকে। কারারক্ষীদের যোগসাজশ ছাড়া এ ভাবে জেলের মধ্যে মোবাইল ঢোকা সম্ভব নয়। তাই জেলের মধ্যে মোবাইল বন্ধ করতে হলে জ্যামার ব্যবহার ছাড়া অন্য উপায় নেই।”
তবে নিরাপত্তার কড়া বেষ্টনী থাকলেই সব কিছু এড়ানো যায়, এমনটা যে সত্যি নয়, তার প্রমাণ মিলেছে সম্প্রতি রাজ্য সরকারের সদর দফতর মহাকরণে। নাম ভাঁড়িয়ে মন্ত্রিসভার এক সদস্যের সঙ্গে দেখা করতে সটান মহাকরণের ভিভিআইপি এলাকায় ঢুকে পড়ে বালিগঞ্জের দাগি আসামি চুন্নু মিঞা। তিনতলায় এক মন্ত্রীর ঘরের বাইরে চেয়ারে বসে অপেক্ষা করছিলেন সে। আচমকা ওই পথ দিয়ে যাওয়ার সময়ে চুন্নুকে দেখে চিনতে পারেন রাজ্যের দমকলমন্ত্রী জাভেদ খান। সঙ্গে সঙ্গে তিনি খবর দেন পুলিশকে। ততক্ষণে জাভেদ খানকে দেখে বেগতিক বুঝে সেখান থেকে চম্পট দেয় চুন্নু মিঞাও।
এই ঘটনার পরে মহাকরণের নিরাপত্তা আরও কড়া করার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন রাজ্য পুলিশ প্রশাসনের কর্তারা। মন্ত্রী বা আমলাদের সঙ্গে দেখা করতে যাঁরা আসছেন, তাঁদের সম্পর্কে সবিস্তার খোঁজখবর নিয়ে তবেই এ বার থেকে ছাড়া হবে। অনেক সময়ে এক জনের নাম দিয়ে ‘প্লাস ওয়ান’ লিখে অনেকে ঢুকে যান। এ বার থেকে সেই সঙ্গীদেরও সবিস্তার নথি রাখার সিদ্ধান্ত নিয়েছে পুলিশ।
নিজের দলেরই কর্মী অধীর মাইতি হত্যাকাণ্ডের অন্যতম অভিযুক্ত কলকাতা পুরসভার ৫৮ নম্বর ওয়ার্ডের কাউন্সিলর শম্ভুনাথ কাও। ২০ মার্চ অধীর মাইতি খুন হন। তার পর থেকে পুলিশের চোখে ধুলো দিয়ে পালিয়ে বেড়াচ্ছিলেন শম্ভুনাথ। অবশেষে ৫ এপ্রিল উত্তরপ্রদেশের বালিয়া জেলার সিকান্দারপুর থেকে গ্রেফতার হন তিনি।
|