তাঁর মালিকানায় থাকা সংবাদপত্র এবং চ্যানেলগুলি বিক্রি করে সংস্থার আর্থিক অবস্থা ফেরানোর শেষ চেষ্টা করেছিলেন সারদা-কর্তা সুদীপ্ত সেন। কিন্তু সেই চেষ্টা সফল হয়নি। কারণ, কয়েক জন রাজনৈতিক নেতা ওই কাজে বাধা দেন। রবিবার জেরার মুখে এমনই দাবি করেছেন তিনি।
সারদা-কর্তাকে এ দিন দফা দফায় জেরা করেছে বিশেষ তদন্তকারী দল। জেরা করা হয়েছে দেবযানী মুখোপাধ্যায়, সারদা নির্মাণ সংস্থার সিইও কর্নেল সৌমিত্র রায় এবং সংস্থার অন্য কর্মীদেরও। প্রাক্তন সেনা অফিসার সৌমিত্রবাবুর কাছে সারদার নির্মাণ ব্যবসা সংক্রান্ত তথ্য জানতে চান গোয়েন্দারা।
পুলিশ সূত্রের খবর, পূর্ব মেদিনীপুরের কাঁথি ও দক্ষিণ ২৪ পরগনার বিষ্ণুপুরে সারদা গোষ্ঠীর আবাসন তৈরি হওয়ার কথা ছিল। এ জন্য ওই দু’জায়গায় জমিও কিনেছিলেন সুদীপ্তবাবু। যদিও ওই জমিগুলিতে বিশেষ কোনও কাজ হয়নি বলেই গোয়েন্দাদের দাবি। এক তদন্তকারী অফিসার জানান, বিষ্ণুপুরে প্রায় ৫০০ বিঘা জমি রয়েছে সারদার। এর আর্থিক মূল্য (ডিড ভ্যালু) প্রায় ৫০০ কোটি টাকা। এত দামি জমিতে কেন প্রকল্প তৈরি করা হল না, তা জানতে সৌমিত্রবাবুকে ডেকেছিলেন গোয়েন্দারা। পুলিশ সূত্রের খবর, সংস্থার আর্থিক অবস্থা খারাপ হওয়ার কারণেই ওই প্রকল্পগুলি বাস্তবায়িত হয়নি বলে সৌমিত্রবাবু জানিয়েছেন।
তদন্তকারীরা অবশ্য জানিয়েছেন, সারদার বিভিন্ন কর্মীকে জেরা করে বিষ্ণুপুরের জমিতে মালিকানা সংক্রান্ত সমস্যার কথা জানা গিয়েছে। এই কারণেই ওই জমিতে আবাসন প্রকল্প গড়তে সমস্যা হচ্ছিল। কিন্তু সৌমিত্রবাবুর কাছ থেকে তেমন কোনও তথ্য পাওয়া যায়নি বলেই পুলিশ সূত্রে জানা গিয়েছে।
সারদা কর্তাও তাঁর সংস্থার এই পরিণতির জন্য আর্থিক অবস্থা খারাপ হওয়ার কথাই গোয়েন্দাদের বার বার বলেছেন। তিনি দাবি করছেন, সংস্থার বেহাল দশার জন্য যেমন তাঁর এজেন্টদের একাংশ দায়ী, তেমনই রাজনৈতিক নেতারাও তাঁকে ডুবিয়ে ছেড়েছেন।
কী ভাবে?
তদন্তকারী অফিসারদের সুদীপ্তবাবু বলেছেন, লগ্নিকারীদের সার্টিফিকেট দেওয়ার সফটওয়্যারের ‘আইডি এবং পাসওয়ার্ড’ সংস্থার ৫০ জন পদস্থ এজেন্টের কাছে থাকত। তা দিয়ে ওই কর্মীরাই সার্টিফিকেট দিতেন। সুদীপ্তবাবুর দাবি, সাব এজেন্টদের কাছে ‘আইডি-পাসওয়ার্ড’ ফাঁস করে দেন কয়েক জন কর্মী। এর পর থেকে ভুয়ো সার্টিফিকেট তৈরি হতে থাকে। তার ফলেই সংস্থার আয়ে ঘাটতি পড়ে। গোয়েন্দাদের তিনি জানিয়েছেন, জানুয়ারি মাসে এটা তিনি জানতে পারেন। কিন্তু বিষয়টি পাঁচকান করেননি। কারণ, তাঁর আশঙ্কা ছিল, এই কথা সবাই জেনে গেলে সংস্থা হঠাৎ বন্ধ হয়ে যাবে।
তদন্তকারীদের একাংশ বলছেন, রাজ্য ছেড়ে পালানোর পর দিল্লি থেকে দেবযানী মারফত সংস্থার কয়েক জন উচ্চপদস্থ কর্তাকে বৈঠকের জন্য ডেকে পাঠিয়েছিলেন সারদা-কর্তা। কিন্তু ওই কর্মীরা তাতে সাড়া দেননি। জেরায় সুদীপ্তবাবু পুলিশকে জানান, এত দিনের সাম্রাজ্যের শেষ সেনাপতিরাও তাঁকে ছেড়ে চলে গিয়েছেন এই সত্যটা তখন তিনি হাড়ে হাড়ে বুঝতে পারেন। এর পর ১৫ এপ্রিল মিডল্যান্ড পাকে সারদার কর্মী-এজেন্টরা বিক্ষোভ দেখালে সুদীপ্তবাবু তাঁদের আশ্বস্ত করেন বলেও পুলিশ জানিয়েছে।
তদন্তকারীদের দাবি, ২০১০ সালে একটা সময় শিলিগুড়িতে সারদা গোষ্ঠীর দেওয়া চেক বাউন্স করতে শুরু করেছিল বলে সংস্থার এজেন্টরা জানান। তা নিয়ে আমানতকারীদের ক্ষোভের মুখে পড়তে হয় এজেন্টদের। এর পর থেকে নগদ টাকায় লেনদেন শুরু হয়। কিন্তু চলতি বছরের মার্চ মাসে বেশ কিছু আমানতকারী ও এজেন্টকে আবার ‘চেক’ দেওয়া হয়। সেই চেকগুলির কী অবস্থা, সে সম্পর্কে খোঁজ নিতে শুরু করেছে পুলিশ।
বিশেষ তদন্তকারী দল জানতে পেরেছে, অফিস বন্ধ হওয়ার আগে কর্মীদের চল্লিশ থেকে পঞ্চাশ শতাংশ হারে বেতন বৃদ্ধি করে সারদা গোষ্ঠী। শিলিগুড়িতে ২০১০ সালে যে ইংরেজি মাধ্যম স্কুলটি কিনেছিল সারদা, তার কর্মীদের বেতনও দ্বিগুণ করা হয়।
|