ধাপায় খুন তৃণমূল নেতাই, পুরপিতাকে ধরার নির্দেশ
ধাপার মাঠপুকুর এলাকার একটি বিতর্কিত জমিতে বহুতল নির্মাণ ঘিরে গণ্ডগোলে বুধবার খুন হলেন তৃণমূলের এক নেতা। অধীর মাইতি ওরফে ‘গুলেপচা’ (৬১) নামে ওই নেতাকে খুনের দায়ে যিনি প্রধান অভিযুক্ত, সেই শম্ভুনাথ কাও কলকাতা পুরসভার ৫৮ নম্বর ওয়ার্ডের তৃণমূল কাউন্সিলর। তৃণমূলের গোষ্ঠী-দ্বন্দ্বের চেহারা আরও এক বার স্পষ্ট হয়ে গিয়েছে এই ঘটনায়। দলের ভাবমূর্তি উদ্ধারে তড়িঘড়ি নামতে হয়েছে তৃণমূল নেত্রী তথা মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে। শম্ভু-সহ অভিযুক্তদের অবিলম্বে গ্রেফতারের নির্দেশ দিয়েছেন তিনি। যদিও বুধবার গভীর রাত পর্যন্ত অভিযুক্ত কাউন্সিলরের খোঁজ পায়নি পুলিশ।
শম্ভুনাথ কাও
অধীর মাইতি
ঘটনা প্রসঙ্গে এ দিন দুপুরে বাঁকুড়ায় মুখ্যমন্ত্রী বলেন, “ওখানে (ধাপায়) জমি নিয়ে একটা গণ্ডগোল হয়েছে। সেই গণ্ডগোলে এক জন মারা গিয়েছেন। তিনি সম্ভবত অসুস্থ ছিলেন। তৃণমূল কাউন্সিলর শম্ভুনাথ কাওয়ের নেতৃত্বে এ সব হয়েছে। আমি ওকে গ্রেফতার করতে বলেছি। আরও কয়েক জন ছিল। সবাইকে ধরতে বলেছি। আইন আইনের পথে চলবে। কাউকে ছাড়া হবে না। সরকার সব রকম ব্যবস্থা নেবে।” বাঁকুড়ার জনসভাতেও একই কথা বলেন মুখ্যমন্ত্রী। বলেন, “ধাপা-র খবরটা শুনেই বলেছি, তাকে (অভিযুক্তকে) প্রথমেই গ্রেফতার করতে হবে। সে কার নির্দেশে এটা করেছে জানি না। অন্যায়কে প্রশ্রয় দেব, আমি সে লোক নই। যদি কেউ অন্যায় করে, তা হলে সে যেখানেই থাক, গ্রেফতার করতে হবে। তাকে দলও সাসপেন্ড করবে। আর যদি কাউকে ফাঁসানো হয়, তা হলে দল সব সময় তাঁর পাশে থাকবে। এটাকেই বলা হয় ‘গুড গভর্নমেন্ট।”
গত জানুয়ারিতে ভাঙড়ে তৃণমূলের প্রাক্তন বিধায়ক আরাবুল ইসলাম খুনের চেষ্টার অভিযোগে গ্রেফতার হয়েছিলেন। ১২ ফেব্রুয়ারি গার্ডেনরিচে পুলিশ অফিসার খুনের অভিযোগে জড়িয়ে পড়ে গ্রেফতার হয়েছেন তৃণমূল কাউন্সিলর ও বরো চেয়ারম্যান মহম্মদ ইকবাল। তার পর ফের এক কাউন্সিলরের বিরুদ্ধে দলীয় নেতাকেই খুনের অভিযোগ দায়ের হওয়ায় চূড়ান্ত অস্বস্তিতে তৃণমূল। ফলে আরাবুল বা ইকবালের ক্ষেত্রে যা করা হয়নি, দলের ভাবমূর্তি উদ্ধারে এ বার তা-ই করেছেন মুখ্যমন্ত্রী। ঘটনার কয়েক ঘণ্টার মধ্যেই অভিযুক্ত কাউন্সিলরকে গ্রেফতারের নির্দেশ দিয়েছেন। পুলিশকে মুখ্যমন্ত্রীর এই তড়িঘড়ি নির্দেশ দেওয়ার প্রসঙ্গে তৃণমূলের শীর্ষ নেতাদের একাংশের বক্তব্য, “ভাঙড় থেকে গার্ডেনরিচ পরপর বেশ কয়েকটি ঘটনা ঘটেছে। তা নিয়ে বিরোধীরা নানা বিতর্ক তৈরি করেছে। এ বার মাঠপুকুরের ঘটনা নিয়ে দিদি কোনওরকম টালবাহানা চাননি। পুলিশকে দ্রুত ব্যবস্থা নেওয়ার নির্দেশ দিয়েছেন। রাজধর্ম পালন করেছেন।” যদিও অনেকের মতে, রাজধর্মের মোড়কে দলে গোষ্ঠী-দ্বন্দ্বে রাশ টানতেই মুখ্যমন্ত্রী পুলিশকে কড়া নির্দেশ দিয়েছেন।
স্বামীকে হারিয়ে কান্না মিনু মাইতির। —নিজস্ব চিত্র
কী হয়েছিল মাঠপুকুরে?
যে জমিটি নিয়ে গণ্ডগোল, সেখানে কাউন্সিলর শম্ভুনাথবাবু তাঁর ঘনিষ্ঠ প্রোমোটারকে দিয়ে বহুতল বানাতে চাইছিলেন বলে পুলিশের কাছে অভিযোগ করেছেন নিহত অধীরবাবুর পরিবার এবং এলাকার অনেক বাসিন্দা। তাঁরা জানান, ১৫ কাঠার ওই জমিটি আগে চিনাদের সমাধিস্থল ছিল। পরে সেখানে খাটাল গড়ে ওঠে। সম্প্রতি সেটিও পরিত্যক্ত হয়। অধীরবাবুরা চাইছিলেন, ওই জমির একাংশে পাড়ার লোকেদের জন্য একটি মন্দির তৈরি করে দেওয়া হোক। প্রথমে শম্ভুনাথবাবু তাতে রাজিও হন। কিন্তু পরে তিনি মত বদলান বলে প্রাথমিক তদন্তে পুলিশ জেনেছে।
অধীরবাবুকে নানা ভাবে হুমকি দিয়ে রাজি করানোর চেষ্টা হয়েছিল বলে স্থানীয়দের দাবি। তাঁদের অনেকেরই অভিযোগ, অধীরবাবুকে শাসাতে এ দিন কয়েকটি গাড়িতে জনা পঞ্চাশেক সঙ্গী নিয়ে হাজরাবাগানে হাজির হন শম্ভুনাথবাবু। অধীরবাবুকে ডেকে পাঠানো হয় ওই জমিতে। অধীরবাবুর পরিবারের অভিযোগ, শম্ভুনাথের ফোন পেয়েই এ দিন সকাল সাড়ে ৯টা নাগাদ বাড়ি থেকে বেরিয়েছিলেন তিনি। পুলিশকে প্রত্যক্ষদর্শী কয়েক জন যুবক জানিয়েছেন, জমি নিয়ে কাউন্সিলরের সঙ্গে অধীরবাবুর কথা কাটাকাটি হয়। এর পরেই কাউন্সিলর অধীরবাবুর বুকে জোরে ধাক্কা মারেন। তিনি ধাক্কা মারার পরেই তাঁর সঙ্গী গব্বর, ছোট তারক এবং অজয় ঘুষি মারতে থাকে অধীরবাবুর বুকে। মার খেয়ে পড়ে যান অধীরবাবু। পাড়ার লোকেরা অধীরবাবুকে বেলেঘাটার একটি নার্সিংহোমে নিয়ে যান। বেলা সাড়ে ১০টা নাগাদ চিকিৎসকেরা তাঁকে মৃত বলে ঘোষণা করেন। খুনের ঘটনায় কাউন্সিলর শম্ভুনাথ কাও-সহ ন’জনের বিরুদ্ধে এফআইআর দায়ের করেছেন অধীরবাবুর জামাই শান্তি বাগ।
ধাপার ঘটনা নিয়ে এ দিন বিধানসভায় বিরোধীদের দাবি মেনে বিবৃতি দেন পরিষদীয় মন্ত্রী পার্থ চট্টোপাধ্যায়। তাতে অবশ্য গোষ্ঠী-দ্বন্দ্বের কোনও উল্লেখ নেই। মুখ্যমন্ত্রী যে এক তৃণমূল কাউন্সিলরকে গ্রেফতারের নির্দেশ দিয়েছেন, তা-ও বলা হয়নি। পার্থবাবু বিবৃতিতে বলেন, “বেলা ১১টা নাগাদ ধাপার মাঠ সংলগ্ন খাটালের জমি মাপজোককে ঘিরে অশান্তি হয়। তা থেকে বচসা বাধে।
অধীর মাইতি নামে এক ব্যক্তি অসুস্থ বোধ করলে তাঁকে হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হলে মৃত ঘোষণা করা হয়। সন্দীপ মাইতি নামে আরও এক জন অসুস্থ। মুখ্যমন্ত্রী নির্দেশ দিয়েছেন, যে দুষ্কৃতকারীরা জড়িত, তাদের গ্রেফতার করতে হবে। পূর্ণাঙ্গ তদন্ত হবে। তার পরেই আর যা বলার বলব।”
ঘটনাস্থলে জাভেদ খান। সঙ্গী স্বর্ণকমল সাহা। —নিজস্ব চিত্র
পরিষদীয় মন্ত্রীর এই বিবৃতির পরে বিরোধী দলনেতা সূর্যকান্ত মিশ্র প্রশ্ন করতে চাইলেও তা অনুমোদিত হয়নি। পরে সূর্যবাবু বাইরে বলেন, “ধাপায় সংঘর্ষ হচ্ছে, প্রায় রণক্ষেত্রে পরিণত হয়েছে। খবর এসেছে, সংঘর্ষ একই দলের দুই গোষ্ঠীর মধ্যে। মুখ্যমন্ত্রী যে কাউন্সিলরকে গ্রেফতারের নির্দেশ দিয়েছেন, সেটা এখানে বলা হল না। মুখ্যমন্ত্রীর বক্তব্যের সঙ্গে মন্ত্রীর বিবৃতি সঙ্গতিপূর্ণ নয়।” তৃণমূলের গোষ্ঠী-দ্বন্দ্বের প্রসঙ্গ তুলেই সূর্যবাবুর মন্তব্য, “এই জন্যই কেন্দ্রীয় বাহিনী দিয়ে পঞ্চায়েত ভোট করার কথা বলা হচ্ছে। নইলে তৃণমূলের হাত থেকে তৃণমূলের লোকজনকে বাঁচানো যাবে না!” প্রায় একই সুরে কংগ্রেসের বিধায়ক মানস ভুঁইয়াও বলেন, “শাসক দলের অন্তর্দলীয় সংঘর্ষ বেড়ে চলেছে। এ নিয়ে মন্তব্য করতে চাই না। কিন্তু রাজ্যের সার্বিক আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি ভয়ঙ্কর খারাপ। তাই পঞ্চায়েত নির্বাচন তিন দফায় কেন্দ্রীয় বাহিনী রেখে করানোর জন্য আমরা দাবি করেছি।”
পরে পার্থবাবু ব্যাখ্যা দেন, তিনি বিবৃতিতে যা বলেছেন, প্রশাসনের কাছ থেকে লিখিত রিপোর্ট না-পাওয়া পর্যন্ত তার চেয়ে বেশি কিছু বিধানসভাকে জানানো সম্ভব ছিল না। গোষ্ঠী-দ্বন্দ্ব প্রসঙ্গে তাঁর বক্তব্য, “যদি সেটা হয়ে থাকে, মুখ্যমন্ত্রী তো নির্দেশ দিয়েছেন সকলকে গ্রেফতার করতে। কোনও রং না-দেখে গ্রেফতার করা হবে। কাউন্সিলর এই সভার সদস্য নন বলে তাঁর কথা এখানে বলিনি।”
অভিযুক্ত কাউন্সিলরকে এখনও ধরা না গেলেও এফআইআরের ভিত্তিতে বাবলু সোনা ওরফে ‘পেটকাটা’ নামে শম্ভুনাথের এক সঙ্গীকে গ্রেফতার করেছে পুলিশ। এ ছাড়া শম্ভু হালদার, বাচ্চা তারক, কানা বিকাশ, মিকু, জ্যোতি, শ্যামল এবং অজয়ের নামে খুনের অভিযোগ দায়ের হয়েছে। তারা ট্যাংরা ও ধাপা এলাকার বাসিন্দা।
এ দিন অধীরবাবুর মৃত্যুর পরেই এলাকায় চাঞ্চল্য ছড়িয়ে পড়ে। তৃণমূলের ব্লক কার্যালয়ে চড়াও হয়ে বিক্ষোভ দেখাতে শুরু করেন এলাকার মানুষ। ধাপা রোড অবরোধও করা হয়। ভাঙচুরের আশঙ্কায় এলাকায় প্রচুর পুলিশ মোতায়েন করা হয়। প্রগতি ময়দান, ট্যাংরা, তপসিয়া থানার বাহিনী ছাড়া র্যাফ-ও নামানো হয়।
পরিস্থিতি সামাল দিতে বেলা একটা নাগাদ ধাপা রোডে পৌঁছন মেয়র শোভন চট্টোপাধ্যায়। কিছু ক্ষণ পরে যান দমকলমন্ত্রী জাভেদ খানও। এলাকায় দাঁড়িয়ে তৃণমূলের স্থানীয় কর্মীদের তাঁরা বলেন, অধীরবাবুর খুনে জড়িত সকলের বিরুদ্ধে আইনি ব্যবস্থা নেওয়ার নির্দেশ দিয়েছেন মুখ্যমন্ত্রী। তাই এলাকার মানুষ যেন নিজেদের হাতে আইন তুলে না নেন। রাতে নিহতের বাড়িতে যান তৃণমূল সাংসদ মুকুল রায়।
এলাকার বাসিন্দাদের একাংশের দাবি, বিতর্কিত জমিটি নিয়ে দিন কয়েক আগে অধীরবাবু মেয়রের সঙ্গে আলোচনা করেছিলেন। আবার মঙ্গলবার পুরসভায় গিয়ে মেয়রের সঙ্গে বৈঠক করেছিলেন শম্ভুনাথও। পুরসভার অন্দরের খবর, খাটালের ব্যাপারটি তিনি ‘বুঝে নেবেন’ বলে ওই বৈঠকের পরে শম্ভুনাথ মেয়রকে জানিয়ে দিয়েছিলেন। মেয়র অবশ্য সেই খবর উড়িয়ে দিয়ে বলেছেন, “মঙ্গলবারের বৈঠকে আমার সঙ্গে শম্ভুনাথের ওই জমি নিয়ে কোনও আলোচনা হয়নি।” তাঁর দাবি, ওই জমি পুরসভার নয়। জমিটিতে পুরসভার কোনও প্রকল্প নির্মাণের পরিকল্পনাও নেই। তবে বিতর্কিত জমিটির অদূরে অপেক্ষাকৃত বড় অন্য একটি জমি রয়েছে। সেই জমিটি পুরসভার দখলে নেওয়ার ব্যাপারে ইদানীং কিছু বৈঠক হচ্ছিল। স্থানীয় কাউন্সিলর হিসেবে সেই বৈঠকগুলিতেই শম্ভুনাথবাবু ছিলেন। তবে অধীরবাবু যে তাঁর কাছে জমি দখলের বিরুদ্ধে অভিযোগ জানাতে এসেছিলেন, তা মেনে নিয়েছেন মেয়র।
মেয়র আরও বলেন, “অভিযোগ পেয়েছি, শম্ভুনাথ স্থানীয় কাউন্সিলর হিসেবে এলাকায় গিয়েছিলেন। অধীর মাইতি অসুস্থ ছিলেন। তিনি দুর্ভাগ্যজনক ভাবে মারা যান। বিষয়টা খতিয়ে দেখছি।” তবে তাঁদের এ সব যুক্তি শুনতে নারাজ নিহতের পরিবার। অধীরবাবুর স্ত্রী মিনু মাইতি বলেছেন, “কাউন্সিলর আমার স্বামীকে ফোন করে ডেকে নিয়ে খুন করেছেন। আমরা এর বিচার চাই।”

অভিযুক্ত শম্ভুর মেজদার মৃত্যু
ধাপা-মাঠপুকুরে তৃণমূল নেতা অধীর মাইতির হত্যাকাণ্ডে অভিযুক্ত তৃণমূল কাউন্সিলর শম্ভুনাথ কাও-এর মেজদা বিশ্বনাথ কাও (৫২)-এর অস্বাভাবিক মৃত্যু হয়েছে। রেল পুলিশ সূত্রের খবর, মাঠপুকুরের ঘটনার খবর পেয়ে বুধবার রাতে তিনি ঘাটালের বাড়ি থেকে ট্রেনে কলকাতায় আসছিলেন। ট্রেনেই অসুস্থ হয়ে পড়েন। আরপিএফ জওয়ানেরা তাঁকে বি আর সিংহ হাসপাতালে নিয়ে যান। চিকিৎসকেরা তাঁকে মৃত বলে ঘোষণা করেন। তাঁরা প্রাথমিক ভাবে জানান, হৃদ্রোগে আক্রান্ত হয়েই তাঁর মৃত্যু হয়েছে।
 
 
 


First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.