শাসক দলের আশ্রিত যুবকদের দাবি মিটিয়ে ১০ হাজার টাকা দিতে পারেননি বৃদ্ধা। এই অপরাধে তাঁর বাড়িতে পুরসভার পানীয় জলের সংযোগ দেওয়ার কাজ বন্ধ করে দিয়েছে ওই তোলাবাজেরা। খাস কলকাতার বুকে এমন ঘটনায় হতবাক, বিস্মিত এবং ক্ষুব্ধ কলকাতা হাইকোর্ট।
মুচিপাড়া থানার গোবিন্দ সরকার লেনের বাসিন্দা মিনতি ঘোষ নামে ওই বৃদ্ধা দেওয়ানি আদালতে মামলা করেছিলেন। বুধবার রায় দিতে গিয়ে হাইকোর্টের বিচারপতি জয়ন্ত বিশ্বাস বলেন, “আমি অত্যন্ত বিচলিত বোধ করছি।” তাঁর মন্তব্য, এটা দুর্ভাগ্যজনক যে একটি রাজনৈতিক দলের আশ্রিত তোলাবাজদের দাপটে ৬৬ বছরের এক অসহায় দরিদ্র বৃদ্ধার বাড়িতে পানীয় জলের সংযোগ দেওয়ার কাজ বন্ধ হয়ে গিয়েছে। এটা প্রমাণিত যে, প্রশাসন বিশেষত পুলিশের নিষ্ক্রিয়তা তোলাবাজদের উৎসাহিত করছে। এক দরিদ্র বৃদ্ধাও তাদের হাত থেকে রেহাই পাচ্ছেন না।
কিন্তু এই আদালত বৃদ্ধার কষ্টের কোনও সুরাহা করতে পারছে না বলে জানিয়ে বিচারপতি বলেন, প্রশাসন বা পুলিশও তাঁর সমস্যার সমাধান করবে না। আবেদনকারিণীকে ফৌজদারি আদালতে যেতে হবে। তারাই বৃদ্ধাকে স্বস্তি দিতে পারে। |
মিনতিদেবীর বাড়ি মুচিপাড়ার ২ নম্বর গোবিন্দ সরকার লেনে। এক সময় এই বাড়িতেই দাদার সঙ্গে থাকতেন তিনি। পরে দাদা-বোনের মধ্যে বাড়ির মালিকানা ভাগ হয়। এই ভাগাভাগির পরে কলকাতা পুরসভা বাড়িটিকে দু’টি আলাদা হোল্ডিং হিসাবে চিহ্নিত করে। আলাদা ভাবে দুই বাড়ির কর নির্ধারিত হয়। ভাগাভাগির পরে দেখা যায়, বাড়ির পানীয় জলের লাইনটি পড়েছে দাদার অংশে। বাধ্য হয়ে নতুন জলের লাইনের জন্য পুরসভার কাছে আবেদন করেন মিনতিদেবী। ২০১২ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে ওই আবেদন করা হয়েছিল। আবেদনপত্র খতিয়ে দেখে নতুন জলের সংযোগ দেওয়ার জন্য মিনতিদেবীকে ৩৮৩৭ টাকা জমা দিতে বলে পুরসভা। তারা জানিয়ে দেয়, পুরসভার অনুমোদিত কলের মিস্ত্রিই জলের পাইপ বসানোর কাজ করবেন। এ জন্য তাঁকে ৪০০০ টাকা মজুরি দিতে হবে।
গত বছরের ১৪ মার্চ পুরসভার মিস্ত্রি গিয়ে যখন মাটি খোঁড়ার কাজ শুরু করেন, তখনই সেখানে হাজির হয় জনা কয়েক যুবক। মিনতিদেবী জানান, তারা এসেই কাজ বন্ধ করে দেয়। বলে, কাজ শুরু করতে হলে আগে তাদের ১০ হাজার টাকা দিতে হবে। মিনতিদেবী হাতজোড় করে জানান, তিনি খুব গরিব। টাকা দেবেন কী করে! এ দিকে, বাড়িতে এক ফোঁটা জল নেই। এই বয়সে রাস্তার কল থেকে জল আনাও সম্ভব নয়। ওই তোলাবাজেরা তখন আরও এক ধাপ এগিয়ে শাসানি দেয়, দেরি করলে কিন্তু ১০ হাজারেও কাজ হবে না।
গোটা ঘটনাটা জানিয়ে পুরসভার কাছে আবেদন করেন মিনতিদেবী। পুরসভার জল সরবরাহ বিভাগের এগজিকিউটিভ ইঞ্জিনিয়ার তাঁকে জানান, এতে তাঁদের কিছু করার নেই। তোলাবাজদের বিষয়টা মিনতিদেবীকেই মেটাতে হবে। পুরসভার কলের মিস্ত্রি কাজ করতে পারলে তবেই তিনি জল পাবেন। বাধ্য হয়ে বৃদ্ধা যান মুচিপাড়া থানায়। সেখানে অভিযোগ দায়ের করেন (জিডি নম্বর ১৬৫, তারিখ ১৪ মার্চ, ২০১২)। পুলিশ তাতে কর্ণপাত করেনি বলে অভিযোগ।
এ দিন সন্ধ্যায় মিনতি দেবীর বাড়ি গিয়ে দেখা যায়, ঢোকার মুখে আলো নেই। নীচের দালান অন্ধকার। মিনতিদেবীর ছোট ছেলে শুভঙ্কর বাড়িতে ছিলেন। মিনতিদেবী ছিলেন উপরের ঘরে। তিনি অসুস্থ, নীচে নামতে পারেন না। তাঁর স্বামী কিঙ্করময় ঘোষও অসুস্থ।
মোবাইলের আলোর ভরসায় ভাঙাচোরা সিঁড়ি দিয়ে উপরে উঠে দেখা গেল, পাশাপাশি দুটো ঘরের একটায় মিনতিদেবী বসে রয়েছেন। বড় ছেলে দীপঙ্করের সামান্য উপার্জন। দারিদ্রের ছাপ সর্বত্র। বৃদ্ধা বললেন, “সংসারই ঠিক মতো চলে না। ১০ হাজার টাকা কোথায় পাব বলুন তো?” সত্তর বছরের কিঙ্করময় বিছানায় শুয়েছিলেন। সন্ধ্যায় অচেনা লোক দেখে তাঁর চোখে মুখে আতঙ্কের ছাপ। শুভঙ্কর বলেন, “ওই ঘটনার পর থেকে বাবাও খুব ভয়ে থাকেন। ভাবেন, আবার কেউ হুজ্জুতি করতে আসছে না তো?”
টানা এক বছর ধরে বাথরুমে জল নেই। বাড়ির নীচে একটা কল দিয়ে তিরতির করে জল পড়ে। মিনতিদেবী বলেন, “খাবার খেয়ে নীচে গিয়ে কলে হাত ধুয়ে আসার মতো শক্তি আমার নেই। ছেলেরা জল তুলে না দিলে স্নান পর্যন্ত করতে পারি না।” শুভঙ্করবাবু জানান, কিছু দিন আগে পড়ে গিয়ে মা আর ঠিক মতো হাঁটতে পারেন না। মাস কয়েক আগে ম্যালেরিয়া হওয়ার পরে তিনি এখন কানেও ভাল শুনতে পান না।
শাসক দলের লোক বলে পরিচিত পাড়ার কয়েক জন ‘দাদা’ কাজ বন্ধ করে দিতে বলার পর শুভঙ্করেরা কারও কাছে গিয়েছিলেন কি? শুভঙ্কর বলেন, “স্থানীয় তৃণমূল কাউন্সিলর সঞ্চিতা মণ্ডলের কাছে গিয়েছিলাম। তিনি বলে দেন, তাঁর কিছু করার নেই। যারা এসেছিল তাদের সঙ্গে বুঝে নিতে হবে।”
ওই কাউন্সিলর অবশ্য অভিযোগ অস্বীকার করে বলেন, “আমাকে কেউ কিছু জানায়নি। কেউ লিখিত ভাবে জানালে খোঁজ নিয়ে দেখব।” তাঁর বক্তব্য শুনে মিনতিদেবীর বড় ছেলে দীপঙ্করবাবুর প্রতিক্রিয়া, “ঘটনার দিনই আমরা থানায় গিয়েছিলাম। তার পরে দু’বার কাউন্সিলরের কাছে যাই। উনি অভিযোগ শোনেন। এখন অস্বীকার করলে কিছু বলার নেই।”
এ দিন আদালতে মিনতিদেবীর আইনজীবী শীর্ষণ্য বন্দ্যোপাধ্যায় (তৃণমূল সাংসদ কল্যাণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের ছেলে) অভিযোগ করেন, এক জন ৬৬ বছরের বৃদ্ধা এক বছরের বেশি সময় ধরে পানীয় জলের সংযোগ পেতে এক দরজা থেকে অন্য দরজায় ঘুরেছেন। তিনি পুরসভার টাকা জমা দিয়েছেন, কর দিয়েছেন, কলের মিস্ত্রির মজুরিও মিটিয়েছেন। কিন্তু তোলাবাজদের তোলা দিতে পারেননি। তাই বাড়িতে তাঁকে জল ছাড়াই দিন কাটাতে হচ্ছে। তাঁর অভিযোগ, “তোলাবাজেরা সব সময়েই শাসক দলের আশ্রিত হয়। কিন্তু পুলিশ ও পুরকর্তাদের গা-ছাড়া মনোভাবই তোলাবাজদের শক্তিশালী করছে।”
সব শুনে বিচারপতি জয়ন্ত বিশ্বাস বলেন, “আমি ওই অসহায় বৃদ্ধার কষ্টের কোনও সুরাহা করতে পারছি না বলে নিজে কষ্ট পাচ্ছি। ফৌজদারি আদালত ছাড়া এই বৃদ্ধাকে সাহায্য করতে পারে, এমন কোনও সংস্থা আমি দেখতে পাচ্ছি না।” অপেক্ষা আরও কত দিনের, জানা নেই মিনতিদেবীর! |