বুধবারের গোলমালের আগে পর্যন্ত কলকাতা পুরসভার ৫৮ নম্বর ওয়ার্ডের কাউন্সিলর শম্ভুনাথ ওরফে লালু কাওয়ের বিরুদ্ধে পুলিশের খাতায় কোনও অভিযোগ ছিল না। তবে এলাকায় তোলাবাজি থেকে শুরু করে বাইপাসের ধারে চাষিদের জমি কেনাবেচা, বেআইনি ভাবে ভেড়ি বিক্রি, ট্যাংরার পুরনো চামড়ার কারখানার জমি বেশি ভাড়ায় ‘লিজ’ পাইয়ে দিয়ে দালালদের ‘কাটমানি’ আদায় তাঁর বিরুদ্ধে সব রকম অভিযোগেই সরগরম ছিল এলাকা। এমনকী, ৫৮ নম্বর ওয়ার্ডের কোনও বাড়িতে অ্যাসবেস্টসের চাল বদলাতে হলেও শম্ভুনাথের সঙ্গীদের মোটা টাকা দিতে হত বলে স্থানীয়দের অভিযোগ। ওই কাউন্সিলরের ঘনিষ্ঠদের দাবি, ধাপা রোডে একটি বহুতলই হোক অথবা বাইপাসের ধারে নামী সংস্থার হোটেল নির্মাণ, শম্ভুনাথকে ‘খুশি’ করতে পারলে তবেই সম্ভব হত কোনও প্রকল্প গড়ে তোলা। এ দিনের ঘটনার পরে ফের সামনে আসতে শুরু করেছে এমন সব অভিযোগ।
ট্যাংরা, ধাপা রোড, বাসন্তী রোডের অনেক তৃণমূল-কর্মীই জানাচ্ছেন, দলের শীর্ষস্থানীয় এক নেতার ঘনিষ্ঠ শম্ভুনাথ। তৃণমূল সূত্রের খবর, ৫৭ নম্বর ওয়ার্ডের বাসিন্দা শম্ভুনাথ আগে কংগ্রেসের সোমেন মিত্রের অনুগামী ছিলেন। কংগ্রেসের টিকিটে তিনি এক বার এন্টালি বিধানসভা কেন্দ্রে দাঁড়িয়েছিলেন। ২০০৬ সালে তৃণমূলে যোগ দেন। ঘটনাচক্রে সোমেনবাবুও এখন তৃণমূলেরই সাংসদ। ২০১০ সালে পুরসভা নির্বাচনে ৫৮ নম্বর ওয়ার্ডটি তফসিলি জাতির জন্য সংরক্ষিত হয়। ওই ওয়ার্ডে তফসিলির কোনও ‘উপযুক্ত’ প্রার্থী না থাকায় ৫৭ থেকে শম্ভুনাথকে দাঁড় করায় তৃণমূল। ওই ওয়ার্ডের এক তৃণমূল নেতার অভিযোগ, ভোটে জেতার পর থেকেই সমাজবিরোধীদের সঙ্গে নিয়ে ওয়ার্ডে দাপট চালাতে শুরু করেন শম্ভুনাথ। |
স্থানীয় তৃণমূল সূত্রে খবর, আগে কংগ্রেসের সঙ্গে ঘনিষ্ঠতা থাকার কারণে কলকাতা পুরসভার নির্বাচনে তাঁকে প্রার্থী করা নিয়ে দলের অনেক নেতার আপত্তি ছিল। তা সত্ত্বেও দলের শীর্ষ নেতার ঘনিষ্ঠ হওয়ার সুবাদে তিনি ওই ওয়ার্ডে ভোটে লড়ার টিকিট পান। সে সুবাদেই তাঁর প্রভাব, প্রতিপত্তি বেড়েই চলেছে গত কয়েক বছর ধরে। এন্টালির তৃণমূল বিধায়ক স্বর্ণকমল সাহা এ দিন বলেন, “এলাকার অনেকেরই ওঁর সম্পর্কে ভাল ধারণা নেই। আমি বিধায়ক হওয়ার পরে ওঁকে চিনেছি। তার আগে থেকেই শম্ভুনাথ কাও ৫৮ নম্বর ওয়ার্ডের কাউন্সিলর।”
যে জমিতে বহুতল নির্মাণকে কেন্দ্র করে শম্ভুনাথ বুধবার খুনের মামলায় জড়িয়েছেন, সেই জমিটি বিতর্কিত বলে দাবি করছেন এলাকার লোকজন। স্থানীয় বাসিন্দারা বলছেন, ওই জমি ‘চিনা কবরস্থান’ বলে পরিচিত। বছর দশেক আগে সেখানে খাটাল ছিল। পরে খাটাল উঠে গিয়ে দুধ বিক্রির জায়গা হয় সেটি। পুলিশ স্থানীয় বাসিন্দাদের জিজ্ঞাসাবাদ করে জেনেছে, শম্ভুনাথ পাড়ার লোকজনকে বলেছিলেন, ওই জমি কলকাতা পুরসভার। পুর-কর্তৃপক্ষ সেখানে বহুতল নির্মাণ করবেন। কিন্তু মেয়র শোভন চট্টোপাধ্যায় বুধবার দাবি করেছেন, ওই জমি পুরসভার নয়।
তা হলে কীসের ভিত্তিতে শম্ভুনাথ ওই দাবি করলেন? তৃণমূল-কর্মীদের একাংশ একই প্রশ্ন তুলছে। তাঁদের অভিযোগ, কোনও ‘স্বার্থ’ রয়েছে বলেই শম্ভুবাবু এলাকার লোকজনকে ভুল বুঝিয়েছেন। তিনি প্রচার করেছিলেন, পুর-কর্তৃপক্ষ ধাপা রোড সম্প্রসারণ করলে স্থানীয় ব্যবসায়ীদের একাংশকে ওই জমিতে তৈরি হওয়া বহুতলে ঠাঁই দেওয়া হবে। কিন্তু পুলিশের দাবি, তারা তদন্তে নেমে জেনেছে, রাস্তা চওড়া হওয়ার সঙ্গে ব্যবসায়ীদের ঠাঁই দেওয়ার কোনও প্রশ্নই নেই। স্থানীয় সূত্রে খবর, বিতর্কিত জমিতে বহুতল নির্মাণের পাশাপাশি পাড়ার লোকের স্বার্থে সেখানে একটি মন্দির গড়ে দেওয়ার শর্ত চাপিয়েছিলেন অধীরবাবু। সে কারণেই তাঁকে খুন হতে হয় বলে পুলিশের অনুমান।
দলীয় কর্মী অধীর মাইতিকে খুনের ঘটনায় দলীয় কাউন্সিলর শম্ভুনাথ কাওয়ের নাম জড়িয়ে যাওয়ায় অস্বস্তি বেড়েছে তৃণমূলের অন্দরে। দলের নিচুতলার কর্মীরা অবশ্য দাবি করেছেন, পুরসভার শাসন ক্ষমতায় আসার পরে ওই এলাকায় দলের গোষ্ঠী-কোন্দল বাড়ার পিছনে দায়ী শম্ভুনাথই। তাই মুখ্যমন্ত্রী চান বা না চান, তার খেসারত দিতে হবে দলকেই। |