এক দফা যুদ্ধ শেষ। এ বার দুই শিবিরে শুরু হয়ে গিয়েছে পরবর্তী লড়াইয়ের প্রস্তুতি।
শুক্রবার রায় শোনার পরেই রাজ্য সরকারের তরফে জানানো হয়, এই রায়ের বিরুদ্ধে সোমবারেই তারা ডিভিশন বেঞ্চে যাবে। এ দিন পঞ্চায়েতমন্ত্রী এবং আইনমন্ত্রী সে কথা আরও এক বার স্পষ্ট করে দেন। বিপরীত শিবিরেও তখন পাল্টা প্রস্তুতি শুরু হয়ে গিয়েছে। শনিবার রাতে আইনজীবী সমরাদিত্য পালের বাড়িতে গিয়ে তাঁর সঙ্গে আলোচনা করেন রাজ্য নির্বাচন কমিশনার মীরা পাণ্ডে এবং কমিশন সচিব তাপস রায়। কমিশন সূত্রে বলা হচ্ছে, ডিভিশন বেঞ্চে আইনি যুদ্ধের প্রস্তুতি নিয়ে কথা হয়েছে দু’পক্ষে।
এ দিন মূলত দু’টি প্রশ্ন ঘুরছিল প্রশাসনের অন্দরে। প্রথমত, হাইকোর্টের নির্দেশ মেনে রাজ্য কি কমিশনের কাছে তথ্য পাঠাবে? দ্বিতীয়ত, তথ্য না পাঠালে কি আদালত অবমাননার দায়ে পড়বে না রাজ্য?
কলকাতা হাইকোর্ট রায় ঘোষণা করে শনিবারের মধ্যে কেন্দ্রীয় বাহিনী ও পর্যবেক্ষক সংখ্যা জানানোর যে নির্দেশ দিয়েছিল, তাকে কোনও গুরুত্ব দিতেই নারাজ রাজ্য। পঞ্চায়েতমন্ত্রী সুব্রত মুখোপাধ্যায়ের কথায়, “বাস্তবে এটা কখনওই সম্ভব নয়।” এর পরেই তিনি বলেন, “চ্যালেঞ্জ করছি, বিচারপতি দায়িত্ব নিয়ে নিজে গিয়ে করুন। পারবেন না করতে।” কিন্তু সম্ভব নয় কেন? সুব্রতবাবুর যুক্তি, “কেন্দ্রীয় বাহিনীর জন্য দিল্লিকে চিঠি লিখে প্রস্তাব পাঠাতে হয়। তারা ঠিক করে কত বাহিনী পাঠাবে। এই কাজ কোনও মতেই এক দিনে করা সম্ভব নয়।” কংগ্রেসের আইনজীবী নেতা অরুণাভ ঘোষ পাল্টা প্রশ্ন তোলেন, “এক দিনে করা সম্ভব না হলে আদালতের কাছে সময় চাইতে পারত রাজ্য। সরকার তা করেনি কেন?” রাজ্য স্বরাষ্ট্র দফতরের এক কর্তারও দাবি, এই কাজ সময়সাপেক্ষ। নির্বাচন কমিশনের এক মুখপাত্রের অবশ্য বক্তব্য, ভোটের প্রক্রিয়া অনেক দিন ধরে চলছে। কাজেই বাহিনী কত পাওয়া যাবে, তা রাজ্যের আগেই জেনে রাখা উচিত ছিল।
এর পরেই প্রশ্ন ওঠে, এ দিন সরকার কোনও তথ্য না দেওয়ায় কি আদালত অবমাননা হবে না? পঞ্চায়েতমন্ত্রীর জবাব, “আমরা তো হাইকোর্টের রায়ের বিরুদ্ধেই সোমবার ডিভিশন বেঞ্চে যাচ্ছি। তাই এটায় আদালত অবমাননার প্রশ্ন ওঠে না।” প্রাক্তন বিচারপতি ভগবতীপ্রসাদ বন্দ্যোপাধ্যায়ের মতো কেউ কেউ কিন্তু মনে করেন, এর ফলে আদালত অবমাননা হবে। ভগবতীবাবু বলেন, “রাজ্য যদি ঠিকই করে নেয় রায়কে চ্যালেঞ্জ জানাবে, তা হলে কোর্টকে তাদের বলা উচিত, আপনি নির্দেশ জারির উপরে স্থগিতাদেশ দিন।”
শনিবার রাতে আইনজীবী সমরাদিত্য পালের সঙ্গে মীরা পাণ্ডের বৈঠকেও এই বিষয়টি নিয়ে আলোচনা হয়। ঠিক হয়, কমিশন আদালতকে জানাবে, নির্দেশ সত্ত্বেও রাজ্য কোনও চিঠি পাঠায়নি।
তবে রাজ্য সরকারের একাংশই মনে করছে, পঞ্চায়েত নির্বাচন নিয়ে বিচারপতি বিশ্বনাথ সমাদ্দারের রায় শেষে শাপে বর হতে পারে তাদের।
কী ভাবে? অনেকেই বলছেন, এই রায়ের ফলে আইনি লড়াই শেষ হওয়ার বদলে দ্বিতীয় পর্বে চলে যাচ্ছে। বিচারপতি সমাদ্দারের রায়কে যে চ্যালেঞ্জ করা হবে, সেটা শুক্রবারেই জানিয়েছিলেন পঞ্চায়েতমন্ত্রী। শনিবার সুব্রতবাবু তো বটেই, আইনমন্ত্রী চন্দ্রিমা ভট্টাচার্যও অভিযোগ করেছেন, কলকাতা হাইকোর্টের রায় দেশের যুক্তরাষ্ট্রীয় ব্যবস্থার বিরোধী। একই মত শাসকদলের সর্বভারতীয় সাধারণ সম্পাদক মুকুল রায়ের। ডিভিশন বেঞ্চে যাওয়ার কথা বলেন দুই মন্ত্রীই। |
অর্থাৎ, আরও এক দফা আইনি লড়াই। তাতেও শেষ নয়। ডিভিশন বেঞ্চ যত দ্রুতই রায় দিক, যে হারবে সে যে সেই রায়ের বিরুদ্ধে সর্বোচ্চ আদালতে যাবে, তা মোটামুটি নিশ্চিত। দু’পক্ষ অন্তত এই ব্যাপারে একমত।
এই দীর্ঘ আইনি লড়াইয়ের ফলে যে দিন নষ্ট হবে, তাতে নির্ধারিত সময়ের মধ্যে ভোট করা অসম্ভব। সরকারি ভাবে জানানো হয়েছে, আগামী ২৬ জুনের মধ্যে রাজ্যের বেশির ভাগ গ্রাম পঞ্চায়েতে নতুন বোর্ড গঠন করতে হবে (কিছু পঞ্চায়েতে অবশ্য বোর্ড গঠনের জন্য সময় মিলবে জুলাই ও অগস্ট মাস পর্যন্ত)। এর অর্থ, তার আগেই নির্বাচন পর্ব শেষ করতে হবে। এবং তা করতে গেলে চলতি মে মাসের তৃতীয় সপ্তাহের মধ্যে পঞ্চায়েত নির্বাচনের বিজ্ঞপ্তি জারি করা প্রয়োজন।
কারণ, নির্বাচনের দিন থেকে কমপক্ষে ৩০ দিন আগে বিজ্ঞপ্তি জারি করতে হবে। কিন্তু প্রথমে ডিভিশন বেঞ্চ এবং তার পরে সুপ্রিম কোর্টে এই মামলা চললে যত দ্রুতই শুনানি হোক না কেন, জুন মাসের মধ্যে নির্বাচন প্রক্রিয়া কাজ শেষ করা কার্যত অসম্ভব বলে মনে করছেন রাজ্যের পঞ্চায়েত দফতরের অফিসাররা।
প্রশাসনের এক কর্তা অবশ্য জানালেন, ডিভিশন বেঞ্চ যদি মামলা গ্রহণ করে বলে: শুনানি চলুক, পাশাপাশি নির্বাচন প্রক্রিয়াও চলুক, তা হলে কী হবে বলা খুব মুশকিল। তখন রাজ্যকে আইনজ্ঞদের পরামর্শ নিয়ে পরবর্তী পদক্ষেপ করতে হবে।
আর এক কর্তার পাল্টা বক্তব্য, ভোটের প্রাথমিক প্রক্রিয়া নিয়েই তো সংঘাত দু’পক্ষের। বিচারপতি সমাদ্দারের রায় মেনে প্রক্রিয়া যদি চালাতেই হয়, তা হলে আর ডিভিশন বেঞ্চে আবেদন করা হচ্ছে কেন!
এই দীর্ঘ আইনি লড়াইয়ের মধ্যে মেয়াদ-উত্তীর্ণ পঞ্চায়েত পরিচালনার ভার প্রশাসকের হাতে যাওয়াই ভবিতব্য বলে মনে করছে প্রশাসন। সংবিধান এবং রাজ্যের পঞ্চায়েত আইন বলছে, মেয়াদ শেষের আগে নির্বাচন প্রক্রিয়া শেষ করতে হবে। কিন্তু তা না হলে কী হবে, সে সম্পর্কে স্পষ্ট করে কিছু বলা নেই আইনে। ফলে অনিবার্য ভাবেই প্রশাসক নিয়োগ করে পঞ্চায়েত পরিচালনা করা ছাড়া অন্য কোনও বিকল্প নেই বলে মনে করেন সুব্রতবাবু। তাঁর কথায়, “অন্ধ্রপ্রদেশ এবং মহারাষ্ট্রেও প্রশাসক দিয়ে পঞ্চায়েত চালানো হচ্ছে। আমাদের এখানেও তা করা হতে পারে।”
মামলার মধ্যে কী ভাবে প্রশাসক নিয়োগ করা হবে? সুব্রতবাবুর কথায়, “সে ক্ষেত্রে জুন মাসে আমরা আদালতের কাছে আবেদন জানিয়ে পরিস্থিতিটা ব্যাখ্যা করব। ধরে নেওয়া যায়, অন্য কোনও বিকল্প ব্যবস্থা না থাকলে আদালত প্রশাসক নিয়োগের কথা বলবে। অন্য রাজ্যেও এমন উদাহরণ আছে। ফলে তেমন নির্দেশ পেলে অর্ডিন্যান্স করে প্রশাসক নিয়োগ করবে রাজ্য সরকার।” কত দিনের জন্য প্রশাসক নিয়োগ করা হতে পারে? প্রশাসনের বক্তব্য, সাধারণ ভাবে প্রশাসক নিয়োগ করা হয় ছ’মাসের জন্য। তবে রাজ্য চাইলে অর্ডিন্যান্সে তেমন কোনও সময়সীমা না-ও ধার্য করতে পারে। রাজ্যের প্রধান দুই বিরোধী দল সিপিএম এবং কংগ্রেসের অভিযোগ, সারদা-কাণ্ডের জেরে আদালতে লড়াই জারি রেখে আসলে পঞ্চায়েত নির্বাচনই এড়াতে চাইছে রাজ্য সরকার। নির্দিষ্ট সময়ে পঞ্চায়েত ভোট না হলে গ্রামবাংলায় প্রশাসন পরিচালনার ক্ষেত্রে অচলাবস্থা তৈরি হবে এবং সে ক্ষেত্রে রাজ্য সরকারই দায়ী থাকবে বলে দাবি তাদের। সরকারের পাল্টা দাবি, গত বছর শীত থেকেই তারা ভোট চেয়ে আসছে। ভোটের কাজের জন্য কমিশনকে একশো কোটি টাকা দেওয়াও হয়েছে। কিন্তু কমিশন অনমনীয় মনোভাব নেওয়ায় জটিলতা তৈরি হয়েছে।
|