রবিবাসরীয় প্রবন্ধ ২...
জাস্ট যাচ্ছি
চার পাশে জল থাকলে তবেই দ্বীপ বলা উচিত। ইউরাল-এর এক পাশে চওড়া ডি নদীর চর। মাথার ওপর আইরিশ সি, সেখানে একটা সত্যিকারের দ্বীপ আছে, নাম আইল অব মান, ফেরি যায়। ওখানে শ্রাবন্তী মজুমদার থাকেন। ডান দিকে মার্সি নদী, তার ও পারে লিভারপুল শহর। ইউরাল-এর আর সব দিকে বিলেতের বড় বড় শহর, সেখানে থাকে আমার বাঘা বাঘা ডাক্তার বন্ধুরা। কথা হয়। দেখা হয়। তারা তুলে নিয়ে যায় আমাকে। দেখতে পাই ইংল্যান্ডের ঝলক। তখন ঝিলিক মারে চোখে, বাকি সময়টা বড় ঠান্ডা, লম্বা একটা সময় বন্দি থাকি বিডস্টন রোডে লাল বাড়ির দোতলার ছোট্ট ফ্ল্যাটে। ইউরাল আসলে পেনিনসুলা হলেও আমার কাছে দ্বীপ। শূন্যতার সমুদ্রে মোড়া আর একটা দ্বীপে থাকি আমি। যার সামনে সব সময় একটা ল্যাপটপের নিস্তব্ধ স্ক্রিন। পাশে সাদা ফ্রেমের জানলা। গাছপালা। প্রচুর পাখি। তারা উড়ে যায় ভোরবেলা। ফিরে আসে সন্ধ্যায়। তত ক্ষণে আমিও আলো জ্বেলে দিই ঘরে।
ইউরালের কোথাও যাইনি বিশেষ। ঘণ্টা খানেক হেঁটেছি পাতা ঝরা ফুটপাত দিয়ে, রংবেরঙের কার্ডবোর্ডের মডেলের মতো দেখতে পর পর বাড়ির সামনে দিয়ে। কখনও বিডস্টন হিলের পরিত্যক্ত উইন্ডমিল পর্যন্ত, কখনও অ্যারো পার্কের কাছে টেসকো অবধি, বাজার করব বলে। উপায় না থাকলে চেপে বসেছি নীলচে সবুজ রঙের ৪৩৭ নম্বর বাসের দোতলার প্রথম সিটে। চলে গেছি পশ্চিম দিকে ওয়েস্ট কার্বি পর্যন্ত। অথবা ডান দিকে বার্কিনহেড হয়ে মার্সি নদীর তলার টানেল দিয়ে লিভারপুলে। যাতায়াতের খরচ অনেক। টাকাপয়সা ফুরিয়ে এসেছে। আরও কয়েক সপ্তাহ কাটাতে হবে, যেমন করেই হোক। তার পর দেশে ফেরা। কত দিন অনুভব করিনি কলকাতার ভ্যাপসা গরমটা। কত দিন শুনিনি অর্ধঝুলন্ত মিনিবাসের কনডাক্টরের বিকট চিৎকার।
ছবি: শুভময় মিত্র
মাখন সস্তা, মোটা করেই লাগালাম বিলিতি পাউরুটিতে, ভরে দিলাম সেল-এ কেনা শশা-টমেটো, স্যান্ডউইচ ভরে নিলাম ঝোলা ব্যাগে। এক বোতল জলও রইল। পাওয়া গেল একটা আপেল। একটাই কালো কোট আছে আমার, পকেটের ভেতরটা ছেঁড়া, হাত ঢুকিয়ে রেখে রেখে এই অবস্থা। জুতোর সোলটা চটিতে এসে থেমেছে। রাস্তার ঠান্ডা টের পাওয়া যায়। নামলাম রাস্তায়, ঘুরব সারা দিন। অন্যমনস্ক ছিলাম, খেয়াল ছিল না এটা শশধর বোস লেন নয়। হর্ন না বাজিয়ে দু’বার হেডলাইট ফ্ল্যাশ করে সাঁ করে বেরিয়ে গেল একটা কালো বেন্টলি, না দেখে রাস্তা পেরোনোর তাল করাটাকে একটু বকুনি দিল আর কী, অভিজাত ইংলিশ স্টাইলে।
ফটর ফটর করতে করতে ঢালু রাস্তায় নেমে এলাম বার্কেনহেড মার্কেট পর্যন্ত। ছাপোষাদের বাজার আছে একটা, ফ্লি মার্কেট, ঢুকলাম সেখানে। হকার্স কর্নার গোছের জায়গা। ফ্লোরিস্ট-এর দোকানের বাইরে রাখা দামের টিকিট লাগানো তাজা ফুলগুলোতে এক বার আঙুল ছোঁয়ালাম। কেউ কিছু বলল না। মার্সি নদীর পাড় দিয়ে নিশ্চিন্ত রাস্তা, গাড়ি চলে না, বেঞ্চে বসে খবরের কাগজ পড়ছে কেউ কেউ। হাঁটছিলাম, বার্কেনহেড-বেলফাস্ট জাহাজটার সঙ্গে সঙ্গে, আমিও সমুদ্রের দিকেই যাব। অল্পবয়সি দু’টো মেয়ে সোনালি পনিটেল উড়িয়ে জগিং করতে করতে পেরিয়ে গেল আমাকে। কানে হেডফোন। চেঁচিয়ে বলল, ‘ঘুড়ি উড়ছে নিউ ব্রাইটনে।’
বিশাল ঘুড়িগুলো দূর থেকেই দেখা যাচ্ছিল, কোনওটা ড্রাগন, কোনওটা ডলফিন। এরা পটের বিবির মতো সেজেগুজে হাওয়ায় এ দিক ও দিক করে, কাটাকুটির ব্যাপার নেই, তাই মাঞ্জাও নেই। সমুদ্রের অঢেল হাওয়ায়, খালি ফরফর ফুরফুর হাসি। সবুজ মাঠে ঘুড়িবাজ, দর্শক ভর্তি। গোলাপি শিশু ভীষণ খুশি ফানুস ঘুড়ি দেখে, এ বারে আমাকে দেখতে পেয়েছে সে। আঙুল ঘুরিয়ে দেখাচ্ছে তার মা’কে। খেয়াল হল, চুল কাটিনি অনেক দিন। এক দিকে গাড়ির দু’পাশের ডালা খুলে খাবারদাবার আইসক্রিম বিক্রি হচ্ছে। লাইটহাউস দেখতে পাচ্ছি, টানছে আমাকে। বাতিঘর দেখলেই মনে হয় এক স্নেহময় পুরুষ, নিশ্চিন্ত লাগে।
হাঁটছি, একাই হাঁটছি সমুদ্রের ধারের পাথর-বাঁধানো পাড় ধরে। সমুদ্রে অল্প জল আছে, ঢেউ নেই, দেখলে স্লেট মনে হয়। পুরীর মতো দিগন্তে ময়লা পালতোলা নৌকো নেই, শুধু এক-আধটা অয়েল ট্যাঙ্কারের লাল কালো চিমনি সরে যাচ্ছে দিগন্তে। দূরে দূরে বাড়িঘর। বন্ধুরা আমাকে ইংলিশ পাবে নিয়ে গিয়ে মগ-ভর্তি বিয়ার তুলে দেয় হাতে, মহা খুশি ওরা। আমি ইউ কে-তে এসেছি বলে। আমারও আনন্দ ধরে না। কিন্তু আনন্দটা ধরে রাখতে পারি না কিছুতেই। সুখ চলে যায় তলানি হয়ে, ওপরে বুড়বুড়ি কাটে মিথ্যে ফুর্তির বুদবুদ চোখে পড়ল অজস্র সিগাল, আকাশ কখন যেন নীল হয়ে গেছে। ছোট হয়ে গেছে আমার ছায়াটা।
ওয়ালসি, লিসো গল্ফ ক্লাবের বেড়া-দেওয়া সবুজ জমি পেরিয়ে মিয়্যাল-এর কাছে এসে জোর খিদে পেয়ে গেল। আকাশ কালো করে এসেছে। কাঠের পাটাতনের ওপর দিয়ে হেঁটে টুপ করে নেমে পড়লাম, একটা নৌকার গলুইতে। কেউ নেই, বের করলাম স্যান্ডউইচ। অর্ধেক খাব। তাকালাম ওপরে, এসে গেছে সিগালরা, ডাকাডাকি করছে আমাকে। একটু খাই, একটু ছিঁড়ে ছুড়ে দিই নীল আকাশে। ছোঁ মেরে নিয়ে যায় তারা হাসতে হাসতে। পুরো স্যান্ডউইচ উড়িয়ে দিলাম আকাশে, আসলে ওদের ভাল লেগে গেল খুব। ওরা তো সবাই আসলে জোনাথন লিভিংস্টোন সিগাল।
অবাক হলাম, ক্লান্ত লাগছে না মোটেই। ঠান্ডা লাগছে পায়ের পাতায়। লম্বা লম্বা ঘাসের বন। তার মধ্যে দিয়ে শুনলাম ট্রেনের আওয়াজ। ছোট্ট ইলেকট্রিক হর্ন। নিশ্চয়ই হোয়লেক স্টেশন। চললাম ট্রেন দেখতে। ব্রিটিশ রেল বলে কথা!
এর পর রাস্তা ঘুরে যাবে বাঁ দিকে, ওয়েস্ট কার্বির দিকে। একটা সাইনবোর্ড চোখে পড়ল। সেলুন। দামও লেখা আছে। ভয়ানক সস্তা। ঢুকলাম। ট্যাবলয়েড পড়ছে এক বুড়ো। রানির ছবি খোদাই করা কয়েন গুনে গুনে দিয়ে দিলাম তার হাতে। তার পর কোনও কথা না বলে আঙুল দিয়ে নিজের মাথা দেখালাম। আয়নাওয়ালা দেওয়ালের সামনে একটু উঁচু চেয়ারে বসানো হল আমাকে। কাঁধে হালকা চাপড় মেরে, যত্ন করে। পরে যাতে বেশি না চাইতে পারে, তাই আগেই পেমেন্ট করে দেওয়া, বুড়ো অবশ্য একটু অবাকই হয়েছে বলে মনে হল।
শুরু হল খাস ইংলিশ চুল কাটা, কিন্তু তার আগেই বুড়ো জিগ্যেস করল, ‘কত নম্বর?’ এই নম্বর দিয়েই চুলের কাট ও স্টাইল বোঝানো হয়। আমার ও সব জানা নেই। তাই উদার মুখ করে হাতের মুদ্রায় বুঝিয়ে দিলাম তোমার ওপর আস্থা আছে। শুরু হল চুল কাটা। সঙ্গে বকবক। নানা আক্ষেপ। সমস্ত ফ্রি সার্ভিস উঠে যাচ্ছে, ভাতা বন্ধ হয়ে যাচ্ছে, দাম বাড়ছে জিনিসের এ দিকে আয়নায় দেখতে পাচ্ছি ঠুক ঠুক করে এসেছে এক বুড়ি। হাসিমুখে সে-ও কথা বলছে আয়নার মধ্যে থেকে। বুড়োকেও বলছে এটা-সেটা, একটু জোরে। বুড়ো কানে ভাল শোনে না। তবে চুলটা কাটছে ভারী চমৎকার। এর মধ্যেই বুড়ি সস্নেহে আমাকে বলেছে: আমাকে দেখেই বোঝা যাচ্ছে, খুব ক্লান্ত। ধরা ধরা গলা, আমার ঠাকুমার মতো, যিনি চমৎকার লেস-এর কাজ করতে পারতেন। আমিও বলে ফেললাম, ভারতবর্ষে থাকি, কলকাতায়। আজ ঘুরতে বেরিয়েছি প্রেন্টন থেকে, তার পর নিউ ব্রাইটন হয়ে হাঁটতে হাঁটতে এ দিকে চুল কাটা শেষ। বুড়ি একগাল হাসল। ফোকলা নয়, বলল সস্নেহে, ‘আ, তোমার বয়স কুড়ি বছর কমে গেল। অন্তত কুড়ি।’ বুড়ো, সব সেরে, শেষ বারের মতো আমার মাথায় ব্রাশ চালিয়ে ছাঁটা চুল সেট করে হঠাৎ সামনে এসে দাঁড়াল। তার পর ভয়ানক অবাক হয়ে বলল, ‘ইন্ডিয়া থেকে হেঁটে হেঁটে এই অবধি এসেছ!’


First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.