|
|
|
|
|
|

|
পরীক্ষার দিন
|
হেনরি স্লেসার (আমেরিকা) |
ডিকির বারো বছর হওয়ার আগে পর্যন্ত তার মা-বাবা কক্ষনও, এক বারও, পরীক্ষাটার কথা বলেননি। ওর বারো বছরের জন্মদিনের দিনই মিসেস জর্ডন ওর সামনে প্রথম বললেন। তাঁর গলার স্বরের মধ্যে এমন একটা ভয় ছিল, সেটা উড়িয়ে দিতেই বোধহয় মিস্টার জর্ডন বেশ রুক্ষ ভাবে বললেন, ‘ছাড়ো তো, ও ঠিকই ভাল করবে।’
ব্রেকফাস্টের টেবিলে বসেছিল ওরা, ডিকি একটু অবাক হয়েই প্লেট থেকে মুখ তুলে তাকাল। সে বেশ চটপটে ছেলে। চোখের দৃষ্টি উজ্জ্বল। হঠাৎ মা-বাবার এ রকম টেনশন হওয়ার কারণটা সে ঠিক বুঝতে পারছে না। জন্মদিনে সে কোনও ঝামেলা চায় না। ছোট্ট অ্যাপার্টমেন্টে কোথাও উপহারগুলো রাখা আছে, একটু পরেই খোলা হবে। ওয়াল-কিচেনের অটোমেটিক স্টোভে মা স্পেশাল রান্না করছেন। সে চায় আজ খুব হুল্লোড় হোক, তা নয়, মায়ের ছলছলে চোখ আর বাবার কপালে ভ্রুকুটি।
‘কী পরীক্ষা?’ সে জিজ্ঞেস করল।
মিসেস জর্ডন তার দিকে না তাকিয়ে টেবিলক্লথটার দিকে চেয়ে বললেন, ‘সে রকম কিছু না। বাচ্চাদের বারো বছর বয়স হলে, সরকার থেকে একটা পরীক্ষা নেওয়া হয়। বুদ্ধির পরীক্ষা। ওরা সামনের সপ্তাহে তোমারও পরীক্ষা নেবে। ভয় পাওয়ার কিছু নেই।’
‘স্কুলের পরীক্ষার মতো?’
‘অনেকটা সেই রকমই’, তার বাবা চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়ালেন, ‘এখন যাও। কমিক্স পড়ো গিয়ে।’
ঘরের যে জায়গাটা ছোটবেলা থেকে ‘ডিকির জন্যে’ ঠিক করে দেওয়া আছে, সেখানে গিয়ে ও বইয়ের পাঁজা থেকে একটা চমৎকার কমিক্স তুলে নিল বটে, কিন্তু পড়তে ইচ্ছে করল না। জানলা দিয়ে বিষণ্ণ চোখে বাইরে তাকিয়ে থাকল। ‘ধুর, আজই কেন বৃষ্টি হতে হল’, বলল সে, ‘আজ না হয়ে কালকে হলেই পারত!’
মিস্টার জর্ডন আর্মচেয়ারে বসে সরকারি খবরের কাগজটার পাতা ওলটাচ্ছিলেন। ডিকির কথা শুনে বিরক্ত গলায় বললেন, ‘বৃষ্টি হচ্ছে কারণ বৃষ্টি হচ্ছে। আজকে না কালকে, অত তো তোমার দরকার নেই। আর বৃষ্টি হলে তো ভালই। ওতে ঘাস বাড়ে।’
‘কেন বাবা?’
‘সব কেন-র উত্তর হয় না। বাড়ে, তাই বাড়ে।’
ডিকি ভুরু কুঁচকে বলল, ‘আচ্ছা, ঘাস সবুজ হয় কীসে, বাবা?’
‘জানি না। কেউ জানে না’, কর্কশ স্বরে বললেন বাবা। তার পর তাঁর একটু খারাপ লাগল আচমকা এই ভাবে কথাটা বলার জন্য।
খানিক ক্ষণ বাদে অবশ্য জন্মদিন শুরু হল। উপহারের ঝলমলে রঙের প্যাকেটগুলো দেওয়ার সময় মায়ের মুখটা হাসিখুশি দেখাচ্ছিল। এমনকী বাবাও একটু কষ্ট করে হলেও মুখের হাসিটা বজায় রাখলেন, ডিকির চুলগুলো ঘেঁটে দিলেন। মা’কে চুমু খেল ডিকি। বাবার সঙ্গে হাত মেলাল। তার পর জন্মদিনের কেক কাটা হল।
|
 |
ঘণ্টাখানেক বাদে জানলা দিয়ে তাকিয়ে ডিকি দেখল মেঘের ফাঁক দিয়ে রোদের ঝলক দেখা যাচ্ছে। ‘বাবা’, বলল ডিকি, ‘সূর্য এখান থেকে কত দূরে?’
‘পাঁচ হাজার মাইল’, বললেন বাবা। ডিকি ব্রেকফাস্ট টেবিলে বসেই দেখল মায়ের চোখে জল। সে বুঝতেই পারছিল না একটা পরীক্ষার জন্য মা এত কাঁদছেন কেন! আচমকা তার বাবা মুখ খুললেন। ‘ডিকি’, বললেন তার বাবা। তাঁর ভুরুটা অসম্ভব কুঁচকে আছে। ‘আজকে, মানে, তোমার সেই পরীক্ষার দিন। ঘাবড়ানোর কিছু নেই। প্রতি দিন হাজার হাজার ছেলেমেয়ে এই পরীক্ষাটা দেয়। এটা আর কিছুই না, সরকার দেখতে চায় তোমরা কতটা বুদ্ধিমান, বুঝেছ?’ ‘কিন্তু স্কুলে তো আমি ভালই করি,’ ডিকি বলল একটু থেমে থেমে। ‘এটা একটু আলাদা একটা পরীক্ষা। স্পেশাল। ওরা তোমাকে একটা পানীয় খেতে দেবে। তার পর একটা ঘরে নিয়ে যাবে, যেখানে একটা মেশিন থাকবে...’ ‘কী রকম পানীয় বাবা?’ ‘ওই তো, খেতে পেপারমিন্টের মতো। ওটা খেলে তুমি সব ঠিক ঠিক বলবে। তার মানে এই নয় যে, সরকার ভাবছে তুমি মিথ্যে বলবে। কিন্তু ওটা খেলে নিশ্চিত হওয়া যাবে যে তুমি সত্যিটা বলবেই।’
ডিকির মা কেমন একটা হেসে বললেন, ‘সব ঠিক হয়ে যাবে সোনা।’
‘সে তো বটেই’, বললেন বাবা। ‘তুমি তো ভাল ছেলে। তুমি পরীক্ষায় ভাল করবে। তার পর আমরা বাড়ি চলে আসব, আনন্দ করব। ঠিক আছে?’ নির্দিষ্ট সময়ের পনেরো মিনিট আগেই তারা সরকারি শিক্ষাভবনে ঢুকল। বড় বড় থামওয়ালা মার্বেলের মেঝে পেরিয়ে, বড় একটা খিলানের তলা দিয়ে স্বয়ংক্রিয় এলিভেটরে উঠল, সেটা তাদের পৌঁছে দিল পাঁচ তলায়।
ভেতরটা ঠান্ডা আর গম্ভীর, ঠিক আদালতের মতো। অনেকগুলো বেঞ্চ, ধাতুর টেবিল। বেশ কয়েকটি ছেলে বসে আছে তাদের বাবাদের সঙ্গে। সরু ঠোঁটের রোগাপাতলা এক মহিলা তাদের হাতে হাতে কাগজ বিলি করছে। মিস্টার জর্ডন ফর্মটা ভর্তি করে মহিলাকে ফেরত দিলেন। তার পর ডিকিকে বললেন, ‘ওরা তোমার নাম ডাকলেই, ঘরের ও মাথায় যে দরজাটা আছে, সেটা দিয়ে ঢুকে যাবে।’
একটা লাউডস্পিকার গমগম করে উঠল। নাম ডাকা হল। ডিকি দেখল একটা ছেলে তার বাবার পাশ থেকে উঠে ধীরে ধীরে দরজার দিকে চলে গেল।
এগারোটা পাঁচে ডিকির ডাক পড়ল। ‘বেস্ট অব লাক’, বাবা তার দিকে তাকালেন না। ‘পরীক্ষা হয়ে গেলেই আমি তোমাকে ডাকব।’
ডিকি দরজা খুলে ভেতরে ঢুকল। ভেতরটা এত আবছা যে প্রথমে ও কিছু দেখতেই পাচ্ছিল না। তার পর দেখল ধূসর টিউনিক পরা লোকটাকে। ‘বোসো, তুমিই তো রিচার্ড জর্ডন?’ ‘হ্যাঁ স্যর।’
লোকটা ডেস্ক থেকে একটা প্লাস্টিকের কাপ এগিয়ে দিল ডিকির দিকে। তাতে ঘোলের মতো কী একটা রয়েছে। তবে খেতে মোটেই পেপারমিন্টের মতো নয়।
ডিকি চুপ করে বসে ছিল, ঘুম-ঘুম পাচ্ছিল। লোকটা ব্যস্ত হয়ে কাগজে কী সব লিখছিল। তার পর ঘড়ি দেখল। উঠে দাঁড়িয়ে, পকেট থেকে একটা পেনের মতো জিনিস বের করে, আলো ফেলল ডিকির চোখে। ‘ঠিক আছে রিচার্ড, আমার সঙ্গে এসো’, বলল লোকটা।
ঘরের শেষ প্রান্তে শুধু একটা কাঠের চেয়ার, যার সামনে রয়েছে অনেকগুলো ডায়ালওয়ালা একটা মেশিন। চেয়ারের বাঁ হাতলে একটা মাইক্রোফোন। ডিকি চেয়ারে বসে দেখল মাইক্রোফোনটা এসে গিয়েছে তার মুখের একদম সামনে। ‘শরীরটা একদম আলগা করে দাও, রিচার্ড। তোমাকে কয়েকটা প্রশ্ন করা হবে। তুমি খুব ভাল করে ভাববে। ভেবে উত্তরটা মাইক্রোফোনে বলবে। বাকি কাজটা মেশিনই করে দেবে।’ ‘হ্যাঁ স্যর।’ ‘তা হলে আমি যাচ্ছি। তোমার সময় হলে মাইক্রোফোনের সামনে বলবে ‘রেডি’। ঠিক আছে?’ ‘হ্যাঁ স্যর।’
কাঁধ ঝাঁকিয়ে চলে গেল লোকটা। ‘রেডি’, ডিকি বলল।
মেশিনে অনেকগুলো আলো জ্বলে উঠল। কী সব আওয়াজ শুরু হল। তার পর একটা কণ্ঠস্বর বলে উঠল, ‘যে সংখ্যাগুলো বলছি, তার পরের সংখ্যাটা কী হবে? এক, চার, সাত, দশ...’ মিস্টার আর মিসেস জর্ডন তাঁদের বসার ঘরে বসেছিলেন স্থির হয়ে। কেউ কোনও কথা বলছেন না। বিকেল চারটে নাগাদ ফোনটা বাজল। ‘মিস্টার জর্ডন?’ কেজো, খসখসে গলায় কেউ বলল ও পাশ থেকে। ‘হ্যাঁ, বলছি।’ ‘সরকারি শিক্ষাদফতর থেকে বলছি। আপনার ছেলে রিচার্ড এম জর্ডন, ক্লাসিফিকেশন নম্বর ৬০০-১১৫, সরকারি পরীক্ষা শেষ করেছে। আমরা দুঃখের সঙ্গে জানাচ্ছি যে, আপনার ছেলের বুদ্ধিমত্তার মান, নতুন নিয়মাবলির ৮৪ নম্বর ধারা ও সেকশন ৫ অনুযায়ী সরকার নির্ধারিত সীমা অতিক্রম করেছে।’
ঘরের ও পাশে বুকফাটা কান্নায় ভেঙে পড়েছেন মিসেস জর্ডন। স্বামীর মুখের ভাবদেখেই তিনি যা বোঝার বুঝে গিয়েছেন। ‘এ বার বলুন’, সেই কণ্ঠস্বর নির্বিকার ভাবে বলল, ‘ওর সৎকারের ব্যবস্থা কি আপনারা করবেন, না সরকার? সরকারি খরচে কবর দিলে খরচ পড়বে দশ ডলার।’ |
(সংক্ষেপিত)
ছবি: সায়ন চক্রবর্তী
|
|
|
 |
|
|