|
|
|
|
প্রবন্ধ... |
আনন্দে আছি, আনন্দেই থাকিব |
অসংখ্য ‘অলাভজনক’ প্রয়াসে উপেন্দ্রকিশোরের বিপুল প্রতিভার
স্ফুরণ আমাদের অভিভূত করে।
সার্ধশতবর্ষে লিখছেন
ইন্দ্রজিত্ চৌধুরী |
বাইশ নম্বর সুকিয়া স্ট্রিটের বাড়ির ‘বাঁ দিকে একটা গলি। সে-ধারে ছাপাখানার শিক-দেওয়া একটা ছোটো জানলা ছিল।... রোজ বিকেলে একপাল ছোটো ছেলে ওই জানলার বাইরে প্রত্যাশী হয়ে দাঁড়িয়ে থাকত। ... লক্ষ্মী হয়ে অপেক্ষা করলে, একজন রাগী প্যাটার্নের ভদ্রলোক ছোটো জানলাটি খুলে সকলকে একটা করে রঙিন ছবি দিতেন।’ (সুকুমার, লীলা মজুমদার)।
‘রাগী প্যাটার্নের ভদ্রলোক’টিকে ঘিরে গল্পের শেষ নেই। বিবেকানন্দ আর দ্বিজেন্দ্রলাল রায়ের সঙ্গে একই বছরে জন্ম তাঁর, রবীন্দ্রনাথ ও প্রফুল্লচন্দ্রের থেকে দু’বছরের ছোট। মাত্র বাহান্ন বছর বেঁচে ছিলেন, কিন্তু উনিশ শতকে বাংলার নবজাগরণের অন্যতম প্রধান ব্যক্তিত্ব উপেন্দ্রকিশোর রায়চৌধুরীর (১৮৬৩-১৯১৫) মতো বর্ণময় চরিত্রের জুড়ি মেলা ভার। জীবনের শেষ দুই দশকে তিনি এক দিকে বাঙালির কারিগরি উদ্যোগকে একা হাতে, কোনও প্রথাগত প্রশিক্ষণ ছাড়াই আন্তর্জাতিক মানে তুলে নিয়ে গিয়েছিলেন, অন্য দিকে গানবাজনা, শিশুসাহিত্য রচনা, শিশুপত্রিকা সম্পাদনা, বই ও পত্রিকা অলংকরণ, চিত্রশিল্প, মুদ্রণ ও প্রকাশনা এত বিচিত্র পথে হাঁটলেন পথ তৈরি করে নিলেন আর পরবর্তী পথিকদের জন্য পথ করে দিলেন যা শুধু বিস্মিত করে না, অভিভূত করে। এর মধ্যে একমাত্র কারিগরি উদ্যোগ তাঁকে অবশ্যই কিছুটা আর্থিক সাফল্য এনে দিয়েছিল, বাকিটা ঘরের খেয়ে বনের মোষ তাড়ানো। এত ‘অলাভজনক’ প্রয়াসে এত বিপুল প্রতিভার স্ফুরণ এ তো ‘অপচয়’ বলেই গণ্য হয়। যেমন হয়েছিল হাসিখুসি-র লেখক যোগীন্দ্রনাথ সরকারের ক্ষেত্রে। উপেন্দ্রকিশোরের থেকে দু’বছরের ছোট এই মানুষটিই প্রথম নীতিশিক্ষার আগড় ভেঙে শিশুদের আনন্দ দিতে সারা জীবন লেখালিখি আর বই প্রকাশ করেন। আত্মীয়-শুভাকাঙ্ক্ষীরা তাঁকে বড়ভাই ডাক্তার নীলরতন সরকারের সঙ্গে তুলনা করে ছোট করতেন। |
|
উপেন্দ্রকিশোরের বেলায় কী ঘটেছিল? ব্রাহ্মদের সঙ্গে মেলামেশা থেকে শেষে ব্রাহ্মধর্ম নেওয়া, পিতৃশ্রাদ্ধ না করা এ সবের জন্য পারিবারিক ও সামাজিক প্রতিকূলতার সামনে তাঁকে পড়তে হয়েছিল। কিন্তু মুন্সি শ্যামসুন্দর যেমন বিধবাবিবাহ সমর্থন করতে দ্বিধা করেননি এবং তারপরেও তাঁকে একঘরে করতে কেউ সাহস পায়নি, ছেলে উপেন্দ্রকিশোরও সামাজিক বন্ধন ছিন্ন না করেও নিজের সিদ্ধান্তে অটুট থাকতে পেরেছেন। কলকাতায় ব্রাহ্মসমাজ তাঁকে বেড়ে ওঠার যে পরিসর দিয়েছিল, সেখানে তাঁর স্বচ্ছন্দ বিকাশে কোনও সমস্যা হয়নি। ১৩ নম্বর কর্নওয়ালিস স্ট্রিটের বিশাল বাড়িতে এক দশক কাটিয়েছেন উপেন্দ্রকিশোর। সমাজতাড়িত ব্রাহ্মরা অনেকেই এখানে ছিলেন। থাকতেন অবলাবান্ধব দ্বারকানাথ গঙ্গোপাধ্যায় আর তাঁর স্ত্রী কাদম্বিনী, তাঁদেরই মেয়ে বিধুমুখীর সঙ্গে উপেন্দ্রকিশোরের বিয়ে হয়। তাঁর ছয় ছেলেমেয়ের পাঁচজনের জন্মই এখানে। মেয়ে পুণ্যলতার স্মৃতিকথা ছেলেবেলার দিনগুলি থেকে জানা যায় ছোটদের পড়ায় আনন্দ কী ভাবে মিশিয়ে দিতেন উপেন্দ্রকিশোর। বইয়ের বাইরে মনগড়া অদ্ভুত জীবের গল্প শোনাতেন, “মোটা ‘ভবন্দোলা’ কেমন হেলেদুলে থপথপিয়ে চলে, ‘মন্তুপাইন’ তার সরু লম্বা গলা কেমন পেঁচিয়ে গিঁট পাকিয়ে রাখে, গোলমুখ ভ্যাবাচোখো ‘কোম্পু’ অন্ধকার বারান্দার কোণে দেওয়ালের পেরেকে কেমন বাদুড়ের মতো ঝুলে থাকে।” কচিকাঁচাদের আনন্দ-কোলাহল এতই লেগে থাকত যে লোকে বলত, ‘এই বাড়িটা যেন সবসময় হাসছে’।
আর এই ভাবেই ছোটদের কল্পনার জগত্কে প্রসারিত করে দিয়েছিলেন উপেন্দ্রকিশোর। এক দিকে ছোটদের মনভোলানো উপকথা ও ছড়া, পুরাণ-রামায়ণ-মহাভারতের গল্প, অন্য দিকে প্রাগৈতিহাসিক জীবজন্তু আর কোটি যোজন দূরের নভোমণ্ডলের বৃত্তান্ত। দূরের কথা জানতে গিয়ে ঘাসের উপর শিশিরবিন্দু না হারিয়ে যায় শিশুর ঘরের গল্প প্রতিবেশীর গল্প বেড়ানোর গল্প কিছুই বাদ দেননি তিনি, এমনকী তার আধো আধো বুলিও যে লেখার বিষয় হতে পারে এমনটি আর কে-ই বা ভেবেছেন! কলম-তুলির টানে যেন শিশুদের চার পাশের সব দেওয়াল সরিয়ে দিলেন উপেন্দ্রকিশোর। বুদ্ধদেব বসুর কথায় দেখি তারই প্রতিধ্বনি: ‘‘সুখের চরম ছিলো সেই দুটি বই ‘ছোট্ট রামায়ণ’ আর ‘ছেলেদের মহাভারত’বার-বার ফিরে এসেছি তাদের কাছে; যেমন মা, যেমন মাঝে-মাঝে খাওয়া আর ঘুমোনোএও তেমনি অনতিক্রম্য।” |
|
শুধু পড়ানো কি লেখা নয়, সময়, পরিশ্রম, এমনকী অর্থব্যয়ে অকুণ্ঠিত উপেন্দ্রকিশোর পরম ধৈর্যে ও যত্নে ছোটদের সংগীত শেখাতেন। ‘প্রবাসী’ সম্পাদক রামানন্দ চট্টোপাধ্যায়ের ছেলে কেদারনাথ যে লিখেছিলেন, ‘তিনি ছোটদের আনন্দে এতদূর সন্তুষ্ট হইতেন যে অন্য কিছু লাভের কথা তাঁহার মনে স্থানও পাইত না’, তা নিছক প্রশস্তিবাক্য ছিল না। ‘সন্দেশ’ পত্রিকা প্রকাশ করে তাঁর আদৌ লাভ হয়নি, বরং নিজেরই অর্থব্যয় করতে হয়েছিল। কিন্তু রোগশয্যাতেও যত দিন পেরেছেন লিখে, ছবি এঁকে সন্দেশকে সাজিয়েছেন। গিরিডিতে বেড়াতে গিয়ে উশ্রীর বালুচরে ছোট ছেলেমেয়েদের নিয়ে খেলায় মেতে উঠতেন, যেন তিনি ওদের সমবয়সী বন্ধু। এমনকী রবীন্দ্রনাথের অনুরোধে তাঁর ‘নদী’ কবিতার যে অলংকরণ করেছিলেন, সেখানেও সেই আনন্দের নির্ঝরিণী স্বপ্রকাশ (সঙ্গের ছবি)।
হাফটোন ছবি মুদ্রণে স্বশিক্ষিত মানুষটি আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি পেলেও সব উদ্ভাবনের পেটেন্ট পাননি। যেমন ৬০ ডিগ্রি ক্রসলাইন স্ক্রিন তৈরি করান উপেন্দ্রকিশোর, আর পেটেন্ট নেন শুলত্জে। অথচ ‘পেনরোজ’ পত্রিকায় এই বৃত্তান্ত যখন লেখেন তিনি, সেখানে কোনও তিক্ততা ছিল না। তাঁর কথায়, কোনও বিশেষ উদ্ভাবনের জন্য কে স্বীকৃতি পেল সেটা বড় কথা নয়। যান্ত্রিক দক্ষতাটা বাড়ল, সেটাই আসল। মুদ্রণের পার্থক্য যেখানে শতকরা এক শতাংশ লোকও বুঝবে কি না সন্দেহ, সেখানেও তিনি পরীক্ষা চালিয়েছেন। তাঁর আনুগত্য ছিল শুধু কাজের প্রতি।
আর সেই জন্যেই বোধহয়, মৃত্যুর ঠিক আগেও উপেন্দ্রকিশোর বলতে পেরেছিলেন, ‘আমার জন্য তোমরা শোক করিও না আমি আনন্দে আছি, আনন্দেই থাকিব।’ |
চিত্রসূত্র। প্রতিকৃতি: ‘কারিগরি কল্পনা ও বাঙালি উদ্যোগ’, সিদ্ধার্থ ঘোষ। দে’জ, ১৯৮৮। ‘নদী’র অলংকরণ: অভীককুমার দে-র সৌজন্যে। |
|
|
|
|
|