জোর করিয়া বিবাহ দেওয়াকে ফৌজদারি অপরাধ হিসাবে গণ্য করা হইল ইংল্যান্ডে। যদি কোনও মাতা-পিতাকে দেখা যায় একটি বিবাহ-সম্পর্কে আবদ্ধ করিবার জন্য সন্তানের উপর কোনও প্রকার জোর খাটাইতেছেন, তাঁহাদের গ্রেফতার করা হইবে। মূলত ভারতীয়, বাংলাদেশি ও পাকিস্তানি অভিবাসীগণের প্রবণতা নিবারণের উদ্দেশ্যে এই আইন প্রণয়ন, কারণ এই অভ্যাস প্রাচ্যে অধিক, পাশ্চাত্যে প্রায় নাই বলিলেই চলে। আধুনিক মানুষের নিকট ইহা স্বতঃসিদ্ধ: বিবাহে পাত্রপাত্রীর মতামতই সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ। প্রাচ্য কিন্তু ইহার সম্পূর্ণ বিপরীত অবস্থানটিকেই সযত্নে লালন করিয়া আসিয়াছে। প্রাচীন মোড়লকে সাক্ষী মানিলেই জানা যাইবে, বিবাহের সহিত পাত্রপাত্রীর ইচ্ছা বা পছন্দের কোনও সম্পর্কই নাই, বরং অভিভাবকগণ, পরিবার, প্রতিবেশী, প্রৌঢ় খুল্লতাতের পক্বকেশ বিবেচনা ও সিদ্ধান্তের সম্পর্ক অধিক। প্রেম এই স্থানে কোনও যুক্তি নহে। ওই উদ্ভট খেয়ালটি ব্যক্তির বাড়াবাড়ি মাত্র। সমাজ-চলনে প্রতিটি ক্ষেত্রে ব্যক্তির বুকে বাঁশ ডলিয়া গোষ্ঠীর ধ্বজা ঊর্ধ্বে উত্তোলন প্রাচ্যের প্রতিজ্ঞা। তাই বিবাহ, প্রাচ্যে, দুইটি ব্যক্তির মধ্যে ঘটে না। ইহা দুইটি পরিবারের মিলন। গুরুজনদিগের ব্যবস্থাপনায় ঘটনাটি একটি নর ও নারীকে, তাঁহাদের স্ব স্ব পরিবারের অংশ হিসাবে শিরোধার্য ও হজম করিতে হয়। সমষ্টির যূপকাষ্ঠে ব্যক্তির বলিপ্রদানে অতি-অভ্যস্ত প্রাচ্য তাই, সহসা ব্যক্তিস্বাধীনতা আসিয়া স্কন্ধে পড়িলে, হাঁ করিয়া তাকায়। এই আইনে সেই হাঁ আরও বৃহত্ হইবে। সন্তানের হিতার্থে তাহার চুল টানিয়া কান মলিয়া পদে পদে নিজ সিদ্ধান্ত তাহার উপর চাপাইয়া তাহাকে বড় করিয়া তুলিলাম, আর তাহার জীবনের সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ ঘটনাটিতে আমাদের উচ্চ অভিরুচির তুলনায় তাহার জৈবিক আকাঙ্ক্ষা ও আকর্ষণকে অগ্রাধিকার দিব!
ইংল্যান্ড খুব অ-সহনশীল দেশ নহে। সেই রাষ্ট্রের মধ্যে সকল সংস্কৃতির প্রতি শ্রদ্ধা না হউক, একটি ভদ্র ঔদাসীন্য বজায় রাখিবার অভ্যাস নিহিত। কিন্তু সেই দেশে বসিয়া, ব্যক্তির নিজস্ব মতানুযায়ী কাজ করিবার স্বাধীনতাকে বিঘ্নিত করিলে, তাহা সোনামুখ করিয়া মানিয়া লওয়া দেশের নীতিকারদের পক্ষে কঠিন। সকল সংস্কৃতি তাহার নিজস্ব বৈশিষ্ট্য অনুযায়ী, নিজের মতো বিকশিত হউক বলা সহজ, কিন্তু, ধরা যাক, এক সংস্কৃতি অনুযায়ী প্রতি বুধবার নারীদের প্রকাশ্যে চাবুক মারা হইতেছে, ইহা দেখিয়া সহনশীলতায় অটল থাকা সহজ নহে। তাহাকে সহনশীলতা বলা যায় কি না তাহাও প্রশ্ন। এই প্রশ্নেরই উত্তর রহিয়াছে এই সাম্প্রতিক আইনে। এই দেশের মূল মূল্যবোধগুলিকে সম্পূর্ণ অস্বীকার করিয়া যাহা পালিত হইতেছে, তাহাকে মানিয়া লওয়া নিজ প্রত্যয়কে অসম্মান করিবার শামিল। আপেক্ষিকতাকে আত্যন্তিক সমীহ করিতে গেলে খুনিকেও শাস্তি দেওয়া যাইবে না, তাহার ঐতিহ্য অনুযায়ী হয়তো ঋণের অঙ্ক ফিরত না দিলে খুন করারই প্রচলন। ব্যক্তিস্বাধীনতাকে সর্বোচ্চ প্রাধান্য প্রদান যদি একটি দেশের অভীষ্ট ও ভিত্তিনীতি হয়, তাহার পক্ষে জুলুম-বিবাহ মানিয়া লওয়ার অপেক্ষা তাহা দমন করিবার মধ্যে গৌরব ও আত্মপ্রতিষ্ঠা অধিক। বিবাহ কথাটির মধ্যে, প্রায় সমগ্র পৃথিবীতেই, একটি সুখী স্বনির্বাচনের দ্যোতনা উপস্থিত। কিন্তু ভারতে বালিকা মা-বাবার মতানুযায়ী বিবাহ করিতে অস্বীকার করিলে তাহাকে পুড়াইয়া মারার প্রচেষ্টা চলে। অন্য বহু ক্ষেত্রে সরাসরি মারা না হইলেও দগ্ধাইয়া তাহার জীবন অতিষ্ঠ করিবার জোগাড় দেখা যায়। ইংল্যান্ড সেই অগ্নি নির্বাপণের পথে এক কদম অগ্রসর হইল, হয়তো প্রাচ্যের সভ্যতা বিষয়ে কিছু সঙ্গত বিতৃষ্ণা লালন করিবার পথেও। |