সারা দিন একের পর এক তালিবানি হানায় রক্তাক্ত হয়েও জিতে গেল ভোট উৎসব।
পাকিস্তানের এ বারের ভোটে যে রেকর্ড-ভাঙা ভিড় হতে পারে, প্রচার পর্বেই তা আঁচ করেছিলেন বিশেষজ্ঞরা। আজ সকাল ৮টা থেকে সন্ধে ৬টা (কোনও কোনও জায়গায় ৭টা) পর্যন্ত বিভিন্ন শহরে ভোটকেন্দ্রের বাইরে ধৈর্যশীল লম্বা লাইন সেই ভবিষ্যদ্বাণী মিলিয়ে দিয়েছে। ২০০৮-এর নির্বাচনে ভোট পড়েছিল ৪৪ শতাংশ। আর আজ বিকেলের দিকে নির্বাচন কমিশনের সচিব ইশতিয়াক আহমদ খান জানিয়েছেন, ভোটদানের হার ৬০ শতাংশ পেরিয়ে যাচ্ছে বলেই তিনি আশাবাদী। লাহৌর-ইসলামাবাদের মতো বড় শহরে তরুণদের সঙ্গে সমান তালে ভোটের লাইনে ভিড় করেছেন প্রবীণরা। মহিলাদের উৎসাহও ছিল চোখে পড়ার মতো।
|
ভোট দিতে লাইন। কোয়েটার এক বুথে। শনিবার। |
ঐতিহাসিক ভোট বানচাল করতে তালিবানের চেষ্টাও কম ছিল না। হামলার হুমকি দিয়েই রেখেছিল তারা। সেই মতো সারা দিনে থেকে থেকেই বিভিন্ন এলাকায় ঘটেছে বিস্ফোরণ।
কখনও করাচি, কখনও পেশোয়ার, কখনও কোয়েটা। সারা দেশে জঙ্গি হামলায় অন্তত ২৪ জন প্রাণ হারিয়েছেন। এ বারেও তালিবান অধ্যুষিত কিছু এলাকায় মহিলাদের ভোট দিতে দেওয়া হয়নি। তবে সে সব ছাপিয়ে আলোচনার কেন্দ্রে উঠে আসছে ভোট নিয়ে দেশজোড়া উদ্দীপনা। করাচির আওয়ান কলোনিতে বন্দুকধারীরা বুথ দখলের পর ভোটদাতারা রাস্তায় নেমে বিক্ষোভও দেখিয়েছেন। সেটাই সম্ভবত ভোট-উৎসবের সব চেয়ে বড় বিজ্ঞাপন।
রাত গড়াতে শুরু হয়েছে ভোট গণনাও। সর্বশেষ পাওয়া খবর বলছে, নওয়াজ শরিফ ইতিমধ্যেই সারগোডা আসনে জিতে গিয়েছেন, ইমরান খান জিতেছেন পেশোয়ারে। দু’জনেই একাধিক কেন্দ্র থেকে দাঁড়িয়েছেন। প্রাক্-ভোট সমীক্ষায় দেখা গিয়েছিল, একক বৃহত্তম দল হিসেবে শরিফের পিএমএল(এন)-এরই উঠে আসার সম্ভাবনা। যদিও একাধিক পাক চ্যানেলের দাবি, গণনার প্রথম দফায় মোট ২৭২টি আসনের মধ্যে ৫০টিতে ইমরানের তেহরিক-ই-ইনসাফ এগিয়ে রয়েছে। অনেকেই বলছেন, ভোটের লাইনে নবীনদের ভিড় টানতে ভালই কাজে দিয়েছে ইমরানের ‘নয়া পাকিস্তান’ স্লোগান। পঞ্জাব প্রদেশে যে বিপুল ভোট পড়েছে, তাতে দু’পক্ষই আশাবাদী (দু’পক্ষ কারণ শাসক পিপিপি-র কাছে এই ভোটে মুখরক্ষাই বড় কথা)। মোট আসন সংখ্যার অর্ধেকেরও বেশি রয়েছে পঞ্জাবে। |
আত্মবিশ্বাসী শরিফ আজ সকালে ভোট দিয়ে বলেছিলেন, “আমরাই একমাত্র দল, যাদের ভবিষ্যৎ কর্মসূচি রয়েছে। আশা করছি, রাতের দিকে সুখবর আসতে শুরু করবে।” তবে একই সঙ্গে শরিফ বলেছিলেন, “যার হাতেই ক্ষমতা যাক না কেন, আল্লাহ্ করুন, তাতে যেন পাকিস্তানের মঙ্গল হয়। একটা সরকার মেয়াদ পূর্ণ করার পর আরও একটা সরকার নির্বাচিত হতে চলেছে। এটা আমার স্বপ্ন ছিল।” হাসপাতালে ভর্তি ইমরানের আর ভোট দেওয়া হয়নি। তবে সেনাপ্রধান আশফাক কিয়ানি, প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী রাজা পারভেজ আশরফ, মুখ্য নির্বাচনী আধিকারিক ফখরুদ্দিন জি ইব্রাহিম সকাল-সকালই ভোট দিয়ে যান।
ভোট নির্বিঘ্ন করতে পাঁচ হাজার সেনা-সহ প্রায় ৭৫ হাজার নিরাপত্তা কর্মী মোতায়েন করা হয়েছিল। চোরাগোপ্তা হামলা অবশ্য পুরো রোখা যায়নি। করাচি আর পেশোয়ারে অন্তত তিনটি করে বিস্ফোরণ হয়েছে। কোয়েটায় হয় একটি বিস্ফোরণ। সব জায়গাতেই হামলার লক্ষ্য মূলত এএনপি এবং পিপিপি-র নেতা-কর্মীরা। |
পেশোয়ারে পিপিপি-র চার কর্মীকে গুলি করে মারে জঙ্গিরা। কিছু কিছু জায়গায় রাজনৈতিক সংঘর্ষও হয়েছে। রিগিংয়ের অভিযোগ তুলে জামাত-এ-ইসলামি ভোট বয়কট করেছে। অভিযোগ খতিয়ে দেখার আশ্বাস দিয়েছে নির্বাচন কমিশন। এ দিনই পাকিস্তানের এক সংবাদপত্রে প্রকাশিত হয় মালালা ইউসুফজাইয়ের চিঠি। সে লিখেছে, ‘মা ও বোনদের আমার অনুরোধ, নিজেদের ভোটটা দিন। ভোটই পারে সব বদলাতে।’ তবু উত্তর-ওয়াজিরিস্তান ও পঞ্জাবের কিছু এলাকায় মহিলাদের ভোট দেওয়া আটকে গিয়েছে তালিবানি ফতোয়ায়। লিখিত হুমকি আগেই বিলি হয়ে গিয়েছিল, আজ সকালে উত্তর-ওয়াজিরিস্তানের মিরানশাহে মাইকে ঘোষণা করে সে কথা মনে করিয়ে দেওয়া হয়। অন্তত তিনটি ভোটকেন্দ্রের কথা জানা গিয়েছে, যেখানে সমস্ত মহিলা ভোটারই গরহাজির ছিলেন।
এই হতাশার ছবিতেও কিন্তু আশা রয়েছে। কারণ, গত ভোটে মহিলাদের জন্য নির্দিষ্ট ২৮ হাজার বুথের মধ্যে ৫৬৪টা দিনভর ফাঁকা ছিল। এ বার আপাতত মাত্র তিনটির হিসেব পাওয়া যাচ্ছে। ব্যালট যা-ই বলুক, একটা বদল কি সত্যিই আসছে না পাকিস্তানে!
|