ভাগ্যিস স্কুলে ভর্তি হয়েছিল প্রার্থনা, তাই তো মৃত্যুকে পাশ কাটিয়ে জীবনে ফিরতে পারল! তেরো বছরের প্রার্থনার বাবা-মা, আত্মীয়-স্বজন, গোটা গ্রামের মুখে ঘুরছে একটাই কথা, “স্কুল আর সর্বশিক্ষা মিশনের দৌলতেই
ক্লাস এইটের মেয়ের কাছে হার মানল ক্যানসার!”
কোথায় সর্বশিক্ষা মিশন আর কোথায় ক্যানসার! পড়াশোনা করলে আবার ক্যানসার সারে নাকি?
কলকাতার চিত্তরঞ্জন ক্যানসার হাসপাতালের শয্যায় বসে একগাল হেসে মালদহের বেদরাবাদ হাইস্কুলের পড়ুয়া প্রার্থনা মণ্ডল বলে, “সারে তো! এত দিন জানতাম, ভাল পড়াশোনা করলে গাড়িঘোড়া চড়া যায়। এখন জানলাম, পড়াশোনা করলে অসুখও সারে।”
চোখের ক্যানসারে আক্রান্ত প্রার্থনা। চোখ থেকেই অসুখটা ছড়িয়ে গিয়েছে শরীরে। বাঁ চোখটা এখনও টেনিস বলের মতো ফুলে, পুঁজ হয়ে বুজে রয়েছে। তার এই মারণ রোগের চিকিত্সার ভার নিয়েছে সর্বশিক্ষা মিশন। রাজ্যে এই প্রথম কোনও ক্যানসার আক্রান্ত শিশুর চিকিত্সার পুরো দায়িত্ব নিয়েছে তারা। তাদেরই চেষ্টায় মালদহের বৈষ্ণবনগর থানার মির্জা চক গ্রামের হতদরিদ্র পরিবারের মেয়ে প্রার্থনা মৃত্যুকে ঠেকিয়ে দিতে পেরেছে বলে দাবি করেছেন চিকিত্সকেরা। হায়দরাবাদে অস্ত্রোপচারের পরে এখন তার কেমোথেরাপি হচ্ছে কলকাতায়। বেঁচে গিয়েছে প্রার্থনার একটা চোখ। এখনও পর্যন্ত সর্বশিক্ষা মিশনের খরচ হয়েছে প্রায় পঞ্চাশ হাজার টাকা। গত রবিবার কলকাতার হাসপাতালে গিয়ে প্রার্থনার সঙ্গে দেখা করে এসেছেন মিশন অধিকর্তা ছোটেন লামা। ক্যানসারে মারাত্মক ক্ষতিগ্রস্ত প্রার্থনার অন্য চোখের দৃষ্টি ফেরাতে চিকিত্সার ত্রুটি রাখা হবে না বলে জানিয়েছেন সর্বশিক্ষা মিশনের কর্তারা। |
কিন্তু কী ভাবে ক্যানসারের চিকিত্সার টাকা জোগাল সর্বশিক্ষা মিশন? নিয়ম ভেঙে অন্য কোনও খাতের টাকা কি প্রার্থনার জন্য ব্যয় হল?
মালদহের সর্বশিক্ষা মিশনের সমন্বিত শিক্ষা বিভাগের দায়িত্বপ্রাপ্ত অফিসার পঙ্কজকুমার দাস জানান, সর্বশিক্ষা মিশনে স্কুলপড়ুয়াদের চোখ ও কানের স্ক্রিনিং থেকে শুরু করে সার্জারি সবকিছু করানোর ব্যবস্থা রয়েছে। কিন্তু প্রার্থনার ক্ষেত্রে চোখের অসুখটা শুধু সাধারণ চোখের সমস্যায় আটকে ছিল না। ক্যানসার ছড়িয়ে স্টেজ-২তে পৌঁছে গিয়েছিল। প্রার্থনাদের পরিবার এত গরিব যে, সাহায্য না পেলে প্রার্থনা বিনা চিকিত্সায় বসে-বসে মারা যেত। সর্বশিক্ষা মিশনের অধিকর্তাদের সে কথা জানানোর পরে সিদ্ধান্ত হয়, স্কুলপড়ুয়াদের চোখের সার্জারির জন্য বরাদ্দ টাকাটাই প্রার্থনার চোখের ক্যানসারের চিকিত্সায় ব্যয় করা হবে।
ছোটেন লামার কথায়, “একটা জীবন বাঁচানোর জন্য নিয়মে এইটুকু বদল করাই যায়। প্রার্থনার ঘটনার পরে আমরা ঠিক করেছি, জটিল হৃদ্রোগ থেকে শুরু করে ক্যানসারের মতো মারণ রোগের চিকিত্সায় সর্বশিক্ষা মিশন স্কুলপড়ুয়াদের টাকা দেওয়ার ব্যবস্থা করবে। শুরুটা প্রার্থনাকে দিয়েই না হয় হল।”
হাসপাতালের শয্যাতেই মা-বাবার সঙ্গে ছেলেমানুষি খুনসুটির অবশ্য বিরাম নেই তেরো বছরের মেয়ের। পরনে সর্বশিক্ষা মিশনের কাকুদের কিনে দেওয়া ঝলমলে নতুন জামা। বাবা-মায়ের পরনেও নতুন কাপড়। একটা ছাড়া বাইরে পরার জামাকাপড়ই ছিল না পরিবারের কারও। বাবা মন্টু মণ্ডল জোগাড়ির কাজ করেন। মা বিড়ি বাঁধেন। একবেলা খাবার জোটে। ক্যানসার ধরা পড়ার পরে মন্টুবাবু ৫০০ টাকা আর একটা ভাল জামা প্রতিবেশীর থেকে ধার করে মেয়েকে এসএসকেএম হাসপাতালে নিয়ে এসেছিলেন। কিন্তু সেখানে এমআরআইয়ের খরচটুকুও দিতে পারেননি বলে ফিরে যেতে হয়েছিল।
তার পরের ঘটনাটা অনেকটা সিনেমার মতো। মেয়েকে বাঁচাতে পারবেন না ধরে নিয়ে ট্রেনে বসে হাপুস নয়নে কাঁদছিলেন মন্টু। সেই ট্রেনে তাঁর সহযাত্রী ছিলেন মালদহ টাউনের এক স্কুলের প্রধানশিক্ষক। সব কিছু জেনে তিনি যোগাযোগ করেন প্রতিমার স্কুল বেদরাবাদ হাইস্কুলের প্রধান শিক্ষকের সঙ্গে। তার পর দুই প্রধান শিক্ষক উদ্যোগী হয়ে সব জানান মালদহের সর্বশিক্ষা মিশনকে। বাদবাকিটা ইতিহাস এবং ক্যানসার আক্রান্ত চোখে প্রার্থনার স্বপ্ন দেখার শুরু। |