পুস্তক পরিচয় ১...
মুক্তি পেলেন রবীন্দ্রনাথ
বিচিত্রা: বৈদ্যুতিন রবীন্দ্র-রচনাসম্ভার (bichitra.jdvu.ac.in)।
দ্রলোক বাঙালির অন্যতম গৃহসজ্জা কোন সাংস্কৃতিক পণ্যটি? অনেকেই বলবেন রবীন্দ্ররচনাবলি। খণ্ডে খণ্ডে সাজানো থাকে, রসিকেরা আবার যত্ন করে বাঁধান, সোনার জলে নিজের নিজের নামও লিখে রাখেন। বংশপরম্পরায় সেই সম্পদ বাহিত হয়। তবে কে কতটুকু পড়েন বলা মুশকিল। না পড়ে, সাংস্কৃতিক চিহ্ন হিসেবে রবীন্দ্ররচনাবলি সাজিয়ে রাখার ‘দেখনদারিত্ব’ নিয়ে চমৎকার বাংলা ছোটগল্পও আছে। তবে এই না-পড়াটাই তো সব ছিল না। অনেকেই পড়তে চাইতেন। পড়ার জন্য রচনাবলির গ্রাহক হতেন। এঁদের পড়াটা আবার কেবল রচনাবলির পাতায় সীমাবদ্ধ থাকত না, জানতেন তাঁরা রবীন্দ্রনাথ নানা কাটাকুটি আর রদবদলের মধ্য দিয়ে গড়ে তুলেছেন তাঁর বহু রচনা। সেই সব কাটাকুটির কাছে অবশ্য সবার সবসময় যাওয়া হয়ে উঠত না। পাঠাগারের প্রাচীর ভেদ করার সময়, সুযোগ কি সবার হয়?
বই আর পাণ্ডুলিপির এই সাবেকি জগতের বাইরে প্রযুক্তির কুশল ব্যবহারে রবীন্দ্ররচনা পড়তে পারার অন্য একটা উপায় যে গড়ে উঠতে পারে তা ইদানীং টের পাওয়া যাচ্ছিল। বইয়ের শরীর তো আজকাল আর কেবল স্পর্শযোগ্য সুমুদ্রিত পাতার সমবায়ে গড়ে ওঠে না— ‘ই বুক’ বিষয়টির সঙ্গে নব্য বাঙালির সখ্য ও সামীপ্য তৈরি হচ্ছে ক্রমশ। যাত্রাপথে নিজস্ব কিন্ডেলে পড়ে ফেলছেন প্রিয় ‘টেক্সট’ এমন বাঙালি ও বাঙালিনি এখন বিরল নন। পুথি থেকে যখন ছাপা বইয়ের জগতে দ্রুত গতিতে ঢুকে পড়ছিল বাঙালি, সেই উনিশ শতকে মুদ্রণের সুবিধে নিয়ে নানা কাহন রচা হচ্ছিল পত্র-পত্রিকায়। ১৮১৮ খ্রিস্টাব্দে ‘দিগদর্শন’ লিখল ‘এবং প্রাচীন পুস্তক যে ছিল ছাপা সৃষ্টি হওয়াতে সে অবিনাশী হইল ও ... পুস্তকের মূল্য অল্প হইল এবং লোকেরা অধিক পড়িতে লিখিতে শিখিল’। তুলনামূলক কম দামে বই পড়া যাচ্ছে, বেশি মানুষ নিজে নিজে বই পড়তে পারছেন। মুদ্রণ-পূর্ব যুগের মতো শ্রুতির ওপর নির্ভর করতে বা কথকের ওপর ভরসা করতে হচ্ছে না আর। দুই পর্বের তুলনাটা অবশ্য এতো সাদামাটা নয় তবে পুথি থেকে বই যে জ্ঞান, প্রযুক্তি ও ক্ষমতা তিনের রূপান্তর পর্ব তা অস্বীকার করার উপায় নেই। মুদ্রিত পাতার সমবায়ে গড়ে ওঠা বইয়ের থেকে বৈদ্যুতিন পাঠ্যের (ই-টেক্সট) দিকে যাত্রাও তেমনই এক রূপান্তর পর্ব। আর যে রবীন্দ্রনাথের লেখাকে নিয়ে বাঙালির না-পড়া, পড়ার সংস্কৃতি গড়ে উঠেছে সেই রবীন্দ্ররচনা যখন বৈদ্যুতিন পাঠ্যের অবয়বে ধরা পড়ে তখন তো কথা ওঠা স্বাভাবিক। রবীন্দ্ররচনাকে বৈদ্যুতিন পাঠ্যের আকারে পরিবেশন করার উদ্যোগ নিয়েছিলেন ভাষা-প্রযুক্তি গবেষণা পরিষদ।
‘পশ্চিমবঙ্গ সরকারের তথ্য ও প্রযুক্তি বিভাগ প্রতিষ্ঠিত ভাষা প্রযুক্তি ও গবেষণা পরিষদ বাংলা ভাষা ও ভাষা গবেষণার লক্ষ্যে বাংলা সাহিত্য সম্ভার অনলাইনে পাঠ ও ব্যবহারের জন্য ইউনিকোডসম্মত ভাবে উপস্থাপিত করতে ব্রতী’ হয়েছিলেন। www.rabindra-rachanabali.nltr.org সাইটে রবীন্দ্রনাথ, বঙ্কিম ও শরৎচন্দ্রের রচনা পড়া যায়। ‘বিদ্যাসাগর, মীর মশার্রফ হোসেন থেকে শুরু করে’ অন্য আরও অনেকের রচনা তাঁরা ‘সারা পৃথিবীর বাংলা-পড়তে-পারা মানুষের জন্য’ সাইটবদ্ধ করতে চেয়েছিলেন। খুবই জরুরি উদ্যোগ।
সম্প্রতি যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের স্কুল অব কালচারাল টেক্সটস অ্যান্ড রেকর্ডস-এর সৌজন্যে ক্লিক করলেই পড়া যাচ্ছে ‘বিচিত্রা: বৈদ্যুতিন রবীন্দ্র-রচনাসম্ভার’। উপদেষ্টা শঙ্খ ঘোষ, প্রধান নির্দেশক সুকান্ত চৌধুরী। তাঁদের সঙ্গে ছিলেন মস্ত একটা দল। ভাষা-প্রযুক্তি গবেষণা পরিষদের চাইতে এই আয়োজন অনেক ব্যাপ্ত। এখানে পাবেন ‘রবীন্দ্রনাথের প্রায় সব পাণ্ডুলিপি (৪৭,৫২০ পাতা) এবং পত্রিকায় ও পুস্তকাকারে মুদ্রিত সব প্রামাণ্য পাঠের (৯১,৬৩৭ পাতা) বৈদ্যুতিন ছবি/ এই সব সংস্করণের সরল পাঠ। এ ছাড়া গবেষকদের জন্য শব্দ-অন্বেষণ, পাঠান্তর চয়ন এসবও রয়েছে। রবীন্দ্রনাথ তো শুধু বাংলায় লেখেননি, ইংরেজিতেও লিখেছিলেন রবীন্দ্রনাথের দুই ভাষার লেখাই এখানে রয়েছে। ধরা যাক আপনি রবীন্দ্র-কুতূহলী। আপনি বিচিত্রার সাইটে গিয়ে ‘রচনাসূচী’-তে ক্লিক করুন। পাণ্ডুলিপি এবং বাংলা, ইংরেজি রচনার বিষয় বিভাজিত বর্ণানুক্রমিক সূচি পাবেন। হয়তো পড়তে চান নাটক ‘অচলায়তন’, ভাঙতে চান জ্ঞান কুক্ষিগত করে রাখার ‘অচল’-প্রয়াস। আপনি এই সাইটে দেখতে পাচ্ছেন বিশ্বভারতীর একাদশ খণ্ড-এ (১৩৪৯) গৃহীত অচলায়তন, পাণ্ডুলিপি পাঠ, ‘প্রবাসী’ পত্রিকায় প্রকাশিত আশ্বিন ১৩১৮-র পাঠ, আদি ব্রাহ্মসমাজ যন্ত্র প্রকাশিত নাটকটির গ্রন্থপাঠ (১৩১৯)- অন্যান্য সংকলনে গৃহীত রূপ। অর্থাৎ রবীন্দ্রনাথের একটা লেখা কী ভাবে নানা পর্যায়ের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে সেই ইতিহাস-ভূগোল জানতে পারছেন সহজেই। বঙ্গদেশের বিভিন্ন পাঠাগারে যে পুরোহিতেরা বসে থাকেন, যাঁরা অনেক সময়েই নিতান্ত আলস্যবশত এবং খুঁজতে হবে বলে প্রয়োজনীয় পরিষেবা দেন না, বেশ কয়েকদিন ঘোরান এবং তারপরে হয়তো নিতান্ত করুণাপরবশ হয়ে ঈপ্সিত জিনিসটি দেখতে দেন তাঁদের সেই চক্কোর থেকে রবীন্দ্রনাথের ক্ষেত্রে অন্তত বিচিত্রা আপনাকে মুক্তি দিল। মুক্তি বোধহয় আরও দু-দিক থেকেও মিলল। এক রকম গবেষণা গুরুত্ব হারাবে। বঙ্গদেশে মাতৃভাষায় রবীন্দ্র-গবেষণা করতে গিয়ে অনেকেই বিশ্লেষণহীন তালিকা প্রণয়ন করেন। যেমন ধরা যাক একটি নাটকের দশখানা পাণ্ডুলিপির কোনটায় কী ছিল এবং ছিল না তার তালিকা দিয়েই কেউ ভাবতে পারেন গবেষণা শেষ। এই জাতীয় কাজের জন্য তো এখন আর গরু-খোঁজার (গো+এষণা) দরকার নেই। বিচিত্রা আছে। চাইলে কেউ নিজেই দেখতে পারেন। কোনও একটা গান গীতিমাল্যে কী চেহারায় ছিল, গীতবিতানে কী রূপে সংকলিত জানতে চান! আবারও বিচিত্রা। তাকে সাজানো রচনাবলির চাইতে এই জাতীয় সম্ভারে অনেক সহজে কিন্তু পড়তে চাওয়া জিনিসটি খুঁজে পাওয়া যায়। অন্য দিকে বিচিত্রা জ্ঞানকেন্দ্রটি আমাদের পড়াশোনার চেহারা চরিত্র অনেকটাই বদলে দিতে পারে। এই প্রকল্প জ্ঞানচর্চায় একরকম বিকেন্দ্রীকরণ ঘটালো। পাঠের ও তথ্যের অধিকার লাভ করলেন অনেক বেশি মানুষ। অনেক কম খরচে, কম সময়ে এবং প্রশাসনিকতার বলয়কে অস্বীকার করে রবীন্দ্ররচনা পড়া যাবে এবং তা পড়তে পারবেন যে কোনও বিদ্যাবিষয়ের সঙ্গে সম্পর্কিত আগ্রহী মানুষ, চাইলে আমপাঠকও। যে সমস্ত পণ্ডিতেরা শুধু আমি জানি বা আমি এটা তোমাকে বলব না জাতীয় বিচিত্র গরিমায় নিজেরাই আপ্লুত হয়ে থাকতেন তাঁদেরও বোধহয় দিন ফুরলো।
আর একটা কথা। এই জাতীয় সাইট তো সবসময় মার্জিত ও সংশোধিত হয়। কাজেই এই সাইট ব্যবহার করতে গিয়ে পাঠকদের যদি অসুবিধে হয় তা হলে সেই সমস্যা সমাধানের জন্য কারিগরি সহায়ক ও উপদেশকেরা ব্যবস্থা নেবেন আশা করি। রবীন্দ্রনাথের লেখাপত্র পড়তে গেলে প্রভাতকুমারের রবীন্দ্র বর্ষপঞ্জি ও পশ্চিমবঙ্গ সরকার প্রকাশিত রবীন্দ্র রচনাবলির গ্রন্থপরিচয় খণ্ডটি হাতে রাখলে খুব সুবিধে হয়। সেই দুটি হাতে রেখে এখন বিচিত্রায় চোখ রাখুন। যত বেশি জানবেন, তত কম মানবেন আপনি রবীন্দ্রনাথকে দখল করে রাখার কারিগরদের। অন্তর্জালে এই সম্ভার এসে ক্ষমতার জাল অনেকটাই ছিন্ন করল। রবীন্দ্রনাথ তো ক্ষমতাকায়েমকারী রাজাকে খান খান করতেই চেয়েছিলেন।


First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.