আঁধার মুছে জেনারেটরের সুরে রাত জাগছে চরের পড়ুয়ারা
সূর্য পাটে গেলেই গর্জে ওঠে জেনারেটর। চরের স্তব্ধতা খান খান করে একটা-দুটো নয় চারটে।
নিমেষে চর দৌলতপুরের ঝিঁঝিঁ ডাকা সন্ধেটা অন্ঝকার ফুঁনে যেন আলোয় আড়মোড়া ভাঙে। আরও কয়েক লহমার অপেক্ষা। সব ছাপিয়ে দরমার বাড়ি গুলি থেকে গুনগুননিয়ে ওঠে ধারাপাত, দুলে দুলে ইংরজি পাঠ্যের পড়া মুখস্থ কিংবা গ্রামীণ বেলো হারমোনিয়ামে কিশোরীর গলা...‘এই আকাশে আমার মুক্তি আলোয় আলোয়।’
বিদ্যুৎ আসেনি। তার জন্যে হা পিত্যেশ করে বসে নেই রানিনগর ১ ব্লকের চর দৌলতপুর কিংবা বেগমপুর। “লেপুলেদের পড়া আর অন্ধকার সন্ধে থকে আমরা মুক্তি চেয়েছিলাম। তাই নিজেরাই খরচ-খরচা তুলে গ্রামে জেনারেটর চালাই। সন্ধে ৬টা থেকে রাত এগারোটা”, তরের হামিদ শেখের গলায় স্পষ্ট গর্ব ঝরে সেই সাঁঝে।
বৈশাখের পড়ন্ত বিকেলে গ্রামের মাচায় বয়স্কদের ভিড়ে জেনারেটরের প্রসঙ্গ উঠতেই কথা কেড়ে নিলেন সত্যেন্দ্রনাথ মণ্ডল বললেন,‘‘ কে কবে কি করবে তার অপেক্ষায় থেকে লাভ নেই। আমরাই আমাদের মতো করে বাঁচার পথ খুঁজে নিয়েছি। চরের সমস্যার কথা শোনার কেউ নেই আর নেই নেই করতে করতে আমরাও কিছু করতে পারলাম না আমাদের ছেলেমেয়েরা অন্তত লেখাপড়া শিখে দুধে ভাতে থাকুক।’’ আর তাই মাসান্তে শ-দেড়েক টাকা খরচ করে গ্রামে বসেছে তিন-তিনটি জেনারেটর।
দুই দেশের মাঝখানের চর। ভারতীয় ভূখন্ডের অর্ন্তগত হলেও কার্যত তাঁরা নিজ দেশেই পরবাসী। এমনই অভিমান চরের বাসিন্দাদের। সরকারি প্রায় সবরকম সুযোগ সুবিধা থেকেই বঞ্চিত স্থানীয় বাসিন্দারা। এমনই অভিযোগ তাঁদের। এখানকার বাসিন্দারা নেই রাজ্যের এই চরে আছে বলতে একটা স্কুল আর কয়েকটি অঙ্গনওয়াড়ি কেন্দ্র। আর আছে এখানকার ছাত্রছাত্রীদের পড়াশোনার অদম্য ইচ্ছে। কিন্তু এত দিন কোন উপায় ছিল না। সূর্য পাটে গেলেই মুখ ভার হয়ে যেত ওদের। শেষ না হওয়া অঙ্ক, আধপড়া ভূগোল মনখারাপ করে গুটিয়ে রাখতে হত তক্তপোশের তলায়। অপেক্ষায় থাকতে হত পরের দিনের। গ্রামের বাসিন্দারা সমস্বরে জানান, কেরোসিনের যা আকাল তাতে লণ্ঠন বা পিদিম জ্বালানো প্রায় অসম্ভব হয়ে পড়েছিল। স্থানীয় বিদ্যুৎ দফতর সূত্রে জানা গিয়েছে, চরের বাসিন্দারা বিদ্যুতের জন্য আবেদনই করেননি। করলে কি বিদ্যুৎ দেওয়া যেত? ওই বিদ্যুৎ-কর্তা বলেন, “সেটা নির্ভর করছে কতজন গ্রাহক ওই গ্রাম থেকে পাওয়া যাবে তার উপরে। তারপর থেকে হবে সেখানে বিদ্যুৎ পৌঁছান কতটা সম্ভব। চরের বাসিন্দারা অবশ্য সে অপেক্ষায় থাকেননি।
তবে পরিস্থিতি এখন বদলেছে। সৌজন্যে গ্রামের খান কয়েক জেনারেটর। সন্ধ্যার পর সেই জেনারেটরের আলোয় পড়তে বসছে ছাত্রছাত্রীরা। এখন আর সূর্যাস্তকে ভয় পায় না ওরা। সপ্তম শ্রেণীর মিলন মণ্ডল, অষ্টম শ্রেণীর শঙ্কর মণ্ডল কিংবা দশম শ্রেণীর পিঙ্কি মণ্ডলরা জানান ‘‘এতদিন সূর্যের আলো থাকতে থাকতে যতটা পারতাম পড়ে নিতাম। এটাই ছিল এখানকার রেওয়াজ। তারপর অন্ধকার নামলেই বই বন্ধ। এখন অবশ্য জেনারেটরের আলোয় অনেক রাত পর্যন্ত পড়াশোনা করতে পারি।’’
চরের বাসিন্দারা জানান, ছেলেমেয়েদের কথা ভেবেই জেনারেটরের ব্যবস্থা। আর এ ব্যাপারে এগিয়ে আসেন চরেরই জনা কয়েক যুবক। তাঁরাই উদ্যোগী হয়ে কিনে ফেলেন বেশ কয়েকটি জেনারেটর। সেগুলোর দেখভালও করছেন ওই যুবকরাই। প্রতি মাসে সামান্য কিছু টাকার বিনিময়ে সন্ধ্যের পর প্রায় প্রতি বাড়িতেই জ্বলে উঠছে একটা করে বাল্ব।
রাতের সীমান্তে বহু দূর থেকেও শোনা যায় জেনারেটরের সেই একঘেঁয়ে সুর। হ্যাঁ, তর দৌলতপুরের মানুষের কাছে সশব্দ জেনারটর যেন সুরই তুলেছে। আর ওই যান্ত্রিক আওয়াজটুকুই যেন চরের হৃদস্পন্দন এগিয়ে চলার ছন্দ। বাড়ির দাওয়ায় বসে দুলে দুলে পড়তে থাকে শঙ্কর, সাথী, প্রিয়াঙ্কারা। গ্রীষ্মের প্রখর দাবদাহে পুড়ে যাওয়া চরের চকচকে বালিও যেন অস্ফুটে বলে ওঠে চরৈবেতি... চরৈবেতি



First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.