নতুন দিশা
অভয়ের বাক্স
স্কুল-কলেজ থেকে শপিং মল। বাসস্টপ, রেলস্টেশন থেকে পার্ক। বাদ নেই কোনও জায়গা। সাধারণ মানুষের অভাব-অভিযোগ সরাসরি জানার জন্য ওই সমস্ত জায়গায় ‘অভিযোগ বাক্স’ লাগিয়ে দিয়েছেন খোদ মুখ্যমন্ত্রী! এক দিন সেখানে জমা পড়ল একটি চিঠি। এক ব্যক্তি মুখ্যমন্ত্রীর উদ্দেশে জানালেন, ‘আমার বাড়ির পাশে কয়েক জন সন্দেহজনক লোক ঘোরাঘুরি করছে। ওরা বোমা তৈরি করছে। বড় নাশকতার ছক কষছে।’ এই সূত্র পেয়েই শহরের বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ জায়গায় তল্লাশি চালিয়ে উদ্ধার হল টাইম বোমা।
এই চিত্রনাট্যটি বলিউডের একটি জনপ্রিয় হিন্দি সিনেমার। যেখানে অভিনেতা অনিল কপূর মুখ্যমন্ত্রী হওয়ার পরেই তাঁর রাজ্যে এ রকম এই ব্যবস্থা চালু করেছিলেন। কিন্তু ‘অভিযোগ বাক্স’র সেই ছবিটা এ বার বাস্তবে পরিণত হয়েছে!
ঘটনাস্থল হাওড়া।

ছবি: দীপঙ্কর মজুমদার
হাওড়া শহরের ১২টি থানা এলাকায় গত এক মাসে মোট ৫৭টি অভিযোগ বাক্স লাগানো হয়েছে বলে জানিয়েছেন হাওড়া সিটি পুলিশের কর্তারা। তাঁরা জানান, স্থানীয় থানা, বাজার, লঞ্চ ঘাট, শপিং মল, ডাকঘর, বাসস্ট্যান্ড, রেলস্টেশনের পাশাপাশি এই অভিযোগ বাক্স সব থেকে বেশি লাগানো হয়েছে শহরের বিভিন্ন মেয়েদের স্কুল-কলেজে। পুলিশ সূত্রে খবর, হাওড়া শহরের উত্তর থেকে দক্ষিণ সর্বত্রই মেয়েদের স্কুল-কলেজের পাশাপাশি রামকৃষ্ণপুর লঞ্চ ঘাট, শপিং মল, বেসু-র দ্বিতীয় গেট, মন্দিরতলা, জিপিও, কদমতলা বাটা মোড়, টিকিয়াপাড়া টি-৮ বাসস্ট্যান্ড, বেলিলিয়াস পার্ক, খুরুট বাসস্ট্যান্ড, বালিটিকুরি, কামারডাঙা, সিটিআই, বেলুড় স্টেশন-সহ বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ জায়গায় ওই বাক্স লাগানো হয়েছে।
সিটি পুলিশ সূত্রে খবর, মাস আটেক আগে হাওড়া শহরের মেয়েদের স্কুল ও কলেজের প্রধান শিক্ষিকা, অধ্যক্ষদের নিয়ে বৈঠক করেন সিটি পুলিশের কর্তারা। লিলুয়ার একটি বেসরকারি ইংরেজি মাধ্যম স্কুলে আয়োজিত ওই বৈঠকে পুলিশকর্তারা জানান, মহিলাদের নিরাপত্তার বিষয়ে বিশেষ গুরুত্ব দেওয়ার পরিকল্পনা করা হচ্ছে। রাস্তায় বিপদে পড়লে এক জন নারী কী ভাবে তা মোকাবিলা করতে পারবেন তার জন্য ক্যারাটের প্রশিক্ষণ দেওয়া হবে। পাশাপাশি, কার্যক্ষেত্রে বা স্কুল-কলেজে আসার পথে কিংবা বাড়ি বা পাড়ায় মানসিক ও শারীরিক ভাবে লাঞ্ছিত হলে মেয়েরা যেন ভয় না পেয়ে সোজাসুজি থানায় চলে আসেন, সে বিষয়েও পরামর্শ দেওয়া হয়। এরই সঙ্গে অভিযোগ জানানোর জন্য শহরের গুরুত্বপূর্ণ স্থানে ‘অভিযোগ বাক্স’ লাগানোর সিদ্ধান্ত নেন পুলিশকর্তারা।

তিনি বলেন
কলকাতা পুলিশেরও এ ব্যাপারে বিভিন্ন
পরিকল্পনা রয়েছে। আগামী দিনে সেগুলিও
কার্যকর করা হবে। তবে হাওড়া সিটি পুলিশ
যে ব্যবস্থা নিয়েছে তা খুবই ভাল। এ বিষয়ে
আগে হাওড়ার পুলিশ কমিশনারের সঙ্গে
আমার কথা হয়েছে।
সুরজিৎ কর পুরকায়স্থ, পুলিশ কমিশনার, কলকাতা
দক্ষিণ ২৪ পরগনায় নারী পাচারের
প্রবণতা বেশি। তাই সে ব্যাপারে আমরা
স্কুল-কলেজে লিফলেট বিলি করি।
বিভিন্ন গ্রাম ও শহরতলিতে ভিডিও
সিডি-র মাধ্যমে নারী পাচার-বিরোধী
প্রচার করা হয়।

প্রবীণ ত্রিপাঠী, পুলিশ সুপার, দক্ষিণ ২৪ পরগনা

ইচ্ছা করলে কোনও মেয়ে নিজের নাম-পরিচয় গোপন রেখেও অভিযোগ জানাতে পারেন।
শুধু কে কী ভাবে কোথায় হেনস্থা করেছে তা জানালেই চলবে।
অজেয় রানাডে, কমিশনার, হাওড়া সিটি পুলিশ
শহরের বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ স্থানে অভিযোগ বাক্স লাগানো হল কেন?
হাওড়া সিটি পুলিশের কর্তাদের মতে, মহিলাদের নিরাপত্তার বিষয়ে জোর দিতে গিয়ে এই পরিকল্পনাটি করা হয়। কারণ, বেশির ভাগ সময় দেখা যায় অনেক মেয়ে নির্যাতিত হলেও লজ্জা অথবা সামাজিক সম্মানহানির ভয়ে প্রকাশ্যে এসে অভিযোগ জানান না। ফলে অপরাধীও বেমালুম ঘুরে বেড়ায়। এ-ও দেখা যায়, স্কুল-কলেজে আসার পথে কিংবা কোচিং সেন্টারে যাওয়ার সময় তাঁদের প্রায়ই ইভটিজিং-এর শিকার হতে হয়।
হাওড়া সিটি পুলিশের কমিশনার অজেয় রানাডে বলেন, “এই সমস্ত বিষয়ে কোনও মেয়ে যাতে সহজেই পুলিশের কাছে অভিযোগ জানাতে পারেন তাই এই পরিকল্পনা। ইচ্ছা করলে মেয়েটি নিজের নাম-পরিচয় গোপন রেখেও অভিযোগ জানাতে পারেন। শুধু কে কী ভাবে কোথায় হেনস্থা করেছে তা জানালেই চলবে।” আর এক পুলিশ কর্তা বলেন, “ওই মেয়েটি যদি শুধু সময় ও জায়গাটি জানিয়ে শহরের যে কোনও প্রান্তে চিঠি জমা দেন, তাতেই হবে।”
কী ভাবে গোটা প্রক্রিয়া পরিচালনা করা হবে?
পুলিশকর্তারা জানান, প্রতিটি বাক্স কয়েক দিন অন্তর খুলবেন সংশ্লিষ্ট থানার পুলিশকর্মীরা। জমা পড়া চিঠি তাঁরাই পৌঁছে দেবেন সংশ্লিষ্ট ডিভিশনাল অ্যাসিস্ট্যান্ট পুলিশ কমিশনারের কাছে। তাঁরা চিঠিগুলি দেখে সংশ্লিষ্ট থানার মাধ্যমে ঘটনার সত্যতা যাচাই করে ব্যবস্থা নেবেন। তিন জন এসিপি এই দায়িত্বে রয়েছেন।
সিটি পুলিশের এই উদ্যোগকে স্বাগত জানিয়েছেন হাওড়া শহরের বিভিন্ন স্কুল-কলেজের শিক্ষিকা থেকে অভিভাবকরাও। যেমন, হাওড়া গার্লস কলেজের অধ্যক্ষা রিনা সেনগুপ্ত বলেন, “পরিকল্পনাটি খুবই ভাল। তবে মেয়েরা নিজেরাই যাতে সাহস করে এগিয়ে এসে অভিযোগ করেন, তার জন্য মেয়েদের মধ্যে সচেতনতা বাড়ানো দরকার। পাশাপাশি দেখতে হবে যাতে কেউ অন্যকে হেনস্থা করতে মিথ্যা অভিযোগ না করে।” তারাসুন্দরী বালিকা বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষিকা সুস্মিতা রায় মনে করেন, “এটি একটি ভাল পদক্ষেপ। পারিবারিক ও সামাজিক, দু’ভাবেই মেয়েরা অনেক সময় হেনস্থা হন। তাঁদের কথা বলার একটা জায়গা তৈরি হল।”
শিক্ষিকাদের পাশাপাশি অভিভাবকেরাও খুশি পুলিশের এই পরিকল্পনায়। সালকিয়ার বাসিন্দা মেঘনাথ হালদারের কথায়: “আমার মেয়ে ক্লাস টেনে পড়ে। অনেক সময় অনেক কথা ওরা ভয়ে আমাদেরও বলতে পারে না। কিন্তু সেটা ওরা ওই বাক্সে লিখে জমা দিলে সুরাহার একটা আশা থাকে।” খুশি ছাত্রীরাও। তাঁদের বক্তব্য: মেয়েদের সুরক্ষার জন্য পুলিশের এই ভূমিকা অতুলনীয়। তবে তাদের সঙ্গে সহযোগিতা করতে হবে মেয়েদেরও।
শুধু কি মহিলারাই অভিযোগ জানাতে পারবেন?
পুলিশ কমিশনার বলেন, “বাজার বা শপিং মলের অভিযোগ বাক্সে যে কোনও ব্যক্তি অভিযোগ জমা দিতে পারেন। সবটাই গুরুত্ব দিয়ে দেখা হবে।”




অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.