কেন্দ্রকে আক্রমণ তুঙ্গে তুললেন মমতা
সাম্প্রতিক রণকৌশল অনুযায়ী জাতীয় রাজনীতিতে কংগ্রেস-বিরোধিতা তীব্র করছেন তৃণমূল নেত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। দিন ছ’য়েক আগে পানিহাটির জনসভাতেই তিনি দিল্লিতে সরকার ওল্টানোর ডাক দিয়েছিলেন। কিন্তু শুক্রবার বর্ধমানের জনসভায় সমালোচনার সুরকে তিনি যে উচ্চতায় নিয়ে গেলেন, সনিয়া গাঁধী-মনমোহন সিংহের সরকারকে যে ভাষায় আক্রমণ করলেন, অতীতে বামেরাও বোধ হয় কখনও এতটা কেন্দ্র-বিরোধী অবস্থান নেয়নি। চড়া সুরে তৃণমূল নেত্রী এ দিন বলেন, “আমি যদি আপনাদের ঘরের মেয়ে হই, বলে গেলাম, দিল্লির সরকার বদলাব। চ্যালেঞ্জ!” মমতা এ দিন ফের অভিযোগ করেন, কংগ্রেস ও সিপিএম হাত মিলিয়ে তাঁর সররকারের বিরুদ্ধে চক্রান্ত করছে। মাঠ ছাপানো জনতার উদ্দেশে তিনি বলেন, “চৌত্রিশ বছর ধরে অগ্নিপরীক্ষা দিয়ে এসেছি। আরও দিয়ে যাব।”
গত কাল সন্ধ্যায় মমতা জানতে পারেন, রেলমন্ত্রী হিসেবে তাঁর আমলের কাজকর্মকে তদন্তের আওতায় নিয়ে আসার চেষ্টা করছেন সিবিআই প্রধান রঞ্জিত সিন্হা। ক্ষুব্ধ মুখ্যমন্ত্রী মনে করছেন, সিবিআইয়ের এই প্রকাশ্য অবস্থানের পিছনে কংগ্রেস হাইকম্যান্ডের পূর্ণ সায় রয়েছে। তার পরেই তৃণমূল নেত্রী সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেন, ‘এনাফ ইজ এনাফ’। এ বার ইটের বদলে পাটকেল দিতে হবে দিল্লিকে। মুখ্যমন্ত্রীর নিজের ভাষায়, “আমি পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী। আমি ব্যস্ত রাজ্যের সমস্যা নিয়ে। কিন্তু দিল্লির কংগ্রেসই আমাকে বাধ্য করছে দিল্লির রাজনীতিতে সক্রিয় হতে। এখন তো আমি আর চুপ করে বসে থাকতে পারি না।”
অতএব মমতার বিশ্লেষণ, আক্রমণই আত্মরক্ষার শ্রেষ্ঠ পন্থা। মমতা মনে করছেন, নানা কেলেঙ্কারিতে কংগ্রেস এখন আকণ্ঠ নিমজ্জিত। সেই দুর্নীতি ঢাকতে ও সে সব থেকে নজর ঘোরাতেই কংগ্রেস নেতৃত্ব তৃণমূলের বিরুদ্ধে অপপ্রচারের কৌশল নিতে চাইছে। এ দিন বক্তৃতাতেও তিনি বলেন, “কংগ্রেস নিজেদের মন্ত্রীর চুরি ঢাকতে কেন্দ্রীয় এজেন্সিকে কাজে লাগাচ্ছে।” ঘনিষ্ঠ মহলে মমতা বলছেন, লালু প্রসাদের ঘনিষ্ঠ অফিসার ছিলেন বর্তমান সিবিআই প্রধান। অভিযোগ, পশুখাদ্য কেলেঙ্কারিতে লালুকে বাঁচাতে সচেষ্ট ছিলেন এই রঞ্জিত সিন্হা। মমতা রেলমন্ত্রী হওয়ার সময়ে রঞ্জিত সিন্হা রেলবোর্ডের সদস্য ছিলেন। কিন্তু নানা অভিযোগের ভিত্তিতে মমতা তাঁকে সরিয়ে দেন। তৃণমূল নেত্রী মনে করছেন, সেই রাগ মেটাতেই এখন কংগ্রেসের অঙ্গুলি হেলনে তাঁর বিরুদ্ধে সক্রিয় হয়েছেন সিন্হা।
আবার ঠিক এই সময়েই বামেরা সারদা কাণ্ডের সিবিআই তদন্ত চেয়ে দিল্লি অভিযানে নেমেছে। ত্রিপুরার বামফ্রন্ট সরকার লগ্নি-সংস্থা কেলেঙ্কারির সিবিআই তদন্তের নির্দেশ দিয়ে তাঁকে চাপে রাখতে চাইছে। মমতা মনে করছেন, কংগ্রেসের সঙ্গে এ বিষয়ে বামেদের নিশ্চয়ই কোনও বোঝাপড়া হয়েছে। এ দিন সভাতেও তিনি বলেন, “কংগ্রেস-সিপিএম জয়েন্ট ভেঞ্চার চলছে। সিপিএম হয়েছে ঢোল, কংগ্রেস তবলা।”
আগের দুটি সভাতেও মমতা বলেছিলেন, “বামেদের সঙ্গে নিয়ে তৃতীয় ইউপিএ গড়ার স্বপ্ন দেখছে কংগ্রেস। কিন্তু সে আশা দুরাশা।” আজ আরও এক ধাপ এগিয়ে তৃণমূল নেত্রী বলেন, “কংগ্রেস-সিপিএম চক্রান্তের কাছে মাথা নত করব না। আমি দিল্লির সরকার বদলাব। আমি মানুষের সরকার চাই।” মমতা বলেন, “রাজা-রানিরা জেনে রাখো, আগুন নিয়ে খেলা ভাল নয়।” মনে করা হচ্ছে, মনমোহন-সনিয়া গাঁধীকেই রাজা-রানি বলে উল্লেখ করেন মমতা।
কেন্দ্রকে আক্রমণ করে মমতা বর্ধমানে বলেছেন, “আমরা জোটসঙ্গী থাকার সময়ই আমাদের এমপিদের ফাইল দিল্লি নিয়ে গিয়েছে। ইনকাম ট্যাক্স রেড করাবে, সিবিআই তদন্ত করাবে বলে। এই নিয়ে ওরা চিঠি পর্যন্ত দিয়েছিল। ভেবেছিল, সিবিআইয়ের ভয় দেখিয়ে মায়াবতী-মুলায়মকে দমিয়েছি, মমতাকেও একটু টেনে রাখা যাক। কিন্তু আমি সিবিআইকে ভয় পাই না। শুনে রাখুন, আমার কেশাগ্র স্পর্শ করা যাবে না।”
তবে কি বিজেপি বা এনডিএ-র দিকে ঝুঁকছেন মমতা? তৃণমূল নেত্রীর সাফ জবাব, “কখনওই নয়। আমরা আমাদের কথা বলছি। কংগ্রেস ও বিজেপি-কে বাদ দিয়ে আঞ্চলিক দলগুলিকে একজোট করতে এ বার নেতৃত্ব দেব।”
তৃণমূল নেতা পুরমন্ত্রী ববি হাকিম ব্যাখ্যা করে বলেন, “তৃণমূল-বিজেপি জোট বাঁধার প্রশ্নই ওঠে না। কংগ্রেস ও সিপিএম এই প্রচার চালালেও মা-মাটি-মানুষকে ভুল বোঝানো যাবে না।” তৃণমূল সূত্র বলছে, এখন বাংলায় প্রায় ৩০ শতাংশ মুসলিম ভোট। এই সংখ্যালঘু ভোটকে আর কখনওই হারাতে চান না মমতা। হাওড়ার উপনির্বাচন জুন মাসের গোড়ায়। সেখানেও সংখ্যালঘু ভোট খুবই গুরুত্বপূর্ণ। এই পরিস্থিতিতে এনডিএ-তে ফেরার কথা মমতা কিছুতেই ভাববেন না।
মমতা চাইছেন, এনডিএ বা বিজেপি তাদের মতো করে রাজনীতি করুক। তিনি নবীন পট্টনায়কের মতো এনডিএ ও ইউপিএ-র বাইরে জোটনিরপেক্ষ রাজনীতির পথ ধরেই এগোতে চান। তাঁর উদ্দেশ্য পঞ্জাবে অকালি দল, ওড়িশায় বিজেডি, তামিলনাড়ুতে জয়ললিতার এডিএমকে, অন্ধ্রপ্রদেশে জগন রেড্ডির দল বা ঝাড়খণ্ডের জেএমএম-এর মধ্যে সমন্বয় গড়ে তোলা। মুলায়ম ও মায়াবতীর মতো দলের সঙ্গেও তিনি যোগাযোগ রাখছেন। অকালি নেতা সুখবীর সিংহ বাদলের সঙ্গে বৈঠক করেন সুদীপ বন্দ্যোপাধ্যায়। কেন্দ্রের কাছে পঞ্জাবের আর্থিক দাবিকেও সংসদে সমর্থন জানায় তৃণমূল।
বিহারের নীতীশ কুমারও এর আগে জানিয়েছিলেন, মমতার সঙ্গে জোট বেঁধে একটি কেন্দ্র-বিরোধী আঞ্চলিক মঞ্চ গড়ে তুলতে চান তিনি। ফোনেও নীতীশ-মমতা কথা হয়। কিন্তু সম্প্রতি নীতীশ যে ভাবে কংগ্রেসের সঙ্গে ঘনিষ্ঠতা গড়ে তুলেছেন এবং কেন্দ্রের কাছ থেকে বিহারের প্যাকেজ আদায় করেছেন, তাতে তাঁর বিশ্বাসযোগ্যতা ও মতিগতি নিয়ে মমতা শিবিরেও প্রশ্ন আছে। কংগ্রেস-নীতীশ বোঝাপড়া বাড়াতে সক্রিয় বিহারের মুখ্যমন্ত্রীর ঘনিষ্ঠ সাংসদ এন কে সিংহ। মমতা তাই এখনই নীতীশকে আক্রমণ হয়তো করছেন না, কিন্তু তাঁকে নিয়ে উৎসাহও দেখাচ্ছেন না।
তবে ২০১৪ সালের আগে পশ্চিমবঙ্গে কংগ্রেস-তৃণমূল জোট না হলেও আসন সমঝোতা হওয়াটা খুবই জরুরি। না হলে ভোট ভাগের সুযোগ নিয়ে ঝুলি ভরবে সিপিএম। কিন্তু মমতা এখনই এই আসন সমঝোতার তত্ত্ব মানতে নারাজ। বরং জোট বা সমঝোতা ছাড়াই হাওড়ায় নিজেদের প্রার্থীকে জিতিয়ে দলের মনোবল বাড়ানোই তাঁর লক্ষ্য। আর তাই কংগ্রেস-বিরোধী প্রচারকেও তিনি তুঙ্গে তুলেছেন।
তৃণমূলে আর একটা মত হল, মমতা কংগ্রেস বিরোধিতা বাড়ালে কংগ্রেসও মমতা-বিরোধী তৎপরতা বাড়াবে। সিবিআই, সেবি, আর্থিক প্যাকেজ, দার্জিলিং, নানা বিষয়ে তখন কেন্দ্র তৃণমূলকে আরও চাপে ফেলার চেষ্টা করবে। মমতা এই মতকেও গুরুত্ব দিতে নারাজ। তাঁর হিসেবে, মূল্যবৃদ্ধি ও দুর্নীতির কারণে দেশ জুড়ে কংগ্রেসের বিরুদ্ধে জনমত তীব্র থেকে তীব্রতর হচ্ছে। এ অবস্থায় কংগ্রেস-বিরোধিতার তাসই পশ্চিমবঙ্গে বেশি কার্যকর রণকৌশল হবে। আঞ্চলিক নেতাদের চাপে ফেলতে কংগ্রেস যে ভাবে সিবিআইকে ব্যবহার করে এসেছে, এ বার তারা তাঁকেও সে ভাবে চাপে রাখতে চায়। তৃতীয় ইউপিএ গড়ে জাতীয় রাজনীতিতে ফের কলকে পেতে কংগেসের সঙ্গে বোঝাপড়া করে চলছে সিপিএম তথা বামেরাও। আজ তিনি বর্ধমানের বাম-বিরোধী জনতার উদ্দেশে অঙ্গীকার ঘোষণা করলেন, “আঘাত করলে আমিও প্রত্যাঘাত করি। ইনসাল্লা, যদি বেঁচে থাকি, চক্রান্তের বদলা নেবো!”



First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.