|
|
|
|
|
কলকাতা মেডিক্যাল |
জীবাণুতে ভরা ওটি-তেই
২৬ দিন ধরে অস্ত্রোপচার
পারিজাত বন্দ্যোপাধ্যায় • কলকাতা |
|
হাসপাতালের মূল অপারেশন থিয়েটার কমপ্লেক্সে যে মারাত্মক জীবাণু রয়েছে, সেই রিপোর্ট হাসপাতালেই মজুত ছিল অনেক আগে থেকে। অভিযোগ, রিপোর্ট তৈরির পরেও টানা ২৬ দিন খাম খুলে তা একটি বার পড়ে দেখারও প্রয়োজন বোধ করেননি কেউ। জীবাণু-ভর্তি সেই ওটি কমপ্লেক্সেই ২৬ দিন ধরে চলেছে মুমূর্ষু রোগীদের যাবতীয় অস্ত্রোপচার, যার সংখ্যা ৩৫০-৪০০। ঘটনাস্থল, রাজ্যের অন্যতম নামী হাসপাতাল কলকাতা মেডিক্যাল কলেজ।
সুস্থ হতে এসে ক’জন রোগী মেডিক্যালের ওই অপারেশন থিয়েটারে ‘হসপিটাল অ্যাকোয়ার্ড ইনফেকশন’-এর জেরে মৃত্যুমুখে পড়েছেন, কত জনের শরীরে জীবাণু ঢুকে প্রাণসংশয় হয়েছে তা নিয়ে আপাতত মুখে কুলুপ এঁটেছেন হাসপাতাল-কর্তৃপক্ষ।
অথচ, সময়মতো রিপোর্ট এলে গত ১০ এপ্রিল থেকেই ওই কমপ্লেক্সে সব অস্ত্রোপচার বন্ধ করে ওটি জীবাণুমুক্ত করার কাজ শুরু হওয়ার কথা। কারণ, ‘ওটি সোয়াব টেস্ট’ করে হাসপাতালের মাইক্রোবায়োলজি বিভাগ ১০ এপ্রিল ই গ্রিন বিল্ডিংয়ের অপারেশন থিয়েটারে মারাত্মক জীবাণু থাকার প্রমাণ পেয়ে গিয়েছিল।
তার পরেও কেন ৬ মে পর্যন্ত সেই জীবাণু-ভর্তি তিনটি অপারেশন থিয়েটারে একের পর এক অস্ত্রোপচার চালিয়ে গেলেন হাসপাতাল-কর্তৃপক্ষ?
কারণ, মেডিক্যালের মাইক্রোবায়োলজি বিভাগ থেকে গ্রিন বিল্ডিংয়ের ওটি কমপ্লেক্সের তিন মিনিট হাঁটা দূরত্বে রিপোর্ট এনে খুলে দেখতেই প্রায় এক মাস সময় লেগে গিয়েছে! মাইক্রোবায়োলজি বিভাগও পরীক্ষা করার পরে ফল কাউকে না জানিয়ে রিপোর্ট খামবন্দি করে রেখেছিল। আর গ্রিন বিল্ডিংয়ের সেই চিকিৎসক বা নার্সরাও রিপোর্ট জানার ব্যাপারে বিন্দুমাত্র আগ্রহ দেখাননি।
৬ মে বিষয়টি জানাজানি হওয়ার পরে দ্রুত গ্রিন বিল্ডিংয়ের তিনটি অপারেশন থিয়েটার অনির্দিষ্ট কালের জন্য বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। তাতে আবার মেডিক্যালের মতো প্রথম সারির ব্যস্ত হাসপাতালে অভূতপূর্ব পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে। কারণ, আগেই সেখানে কার্ডিওথোরাসিক ওটি প্রায় ভেঙে পড়ছিল বলে তা সংস্কারের জন্য বন্ধ করা হয়েছে। হাসপাতালের ইমার্জেন্সি ভবনের দোতলায় চারটি ওটি নিয়ে তৈরি ওটি কমপ্লেক্সও দীর্ঘদিন ধরে বন্ধ। ফলে, কার্যত মেডিক্যাল কলেজের যাবতীয় অস্ত্রোপচার থমকে যেতে বসেছে। দুর্ঘটনায় আহত রোগীদেরও ফিরিয়ে দেওয়ার অভিযোগ উঠছে। এই পরিস্থিতিতে কর্তারা একে অপরের উপরে দোষ চাপাচ্ছেন। সুপার দিব্যেন্দু গৌতম বলছেন, “এটা আমার দেখার কথা নয়, অধ্যক্ষকে জিজ্ঞাসা করুন।” অধ্যক্ষ তপনকুমার লাহিড়ীর মুখে শোনা গেল সেই কথারই প্রতিধ্বনি, “আমি কিছু জানি না। হাসপাতালের ব্যাপার সুপার বলবেন।”
কর্তারা কিছু না বললেও হাসপাতালের অন্য চিকিৎসকেরা জানিয়েছেন, গ্রিন বিল্ডিংয়ের তিনটি ওটিতে অর্থোপেডিক, গ্যাসট্রোএন্টেরোলজি, প্লাস্টিক সার্জারি, ইউরোলজি, নিউরোসার্জারির সব অস্ত্রোপচার হয়। হাসপাতালে পথ-দুর্ঘটনার যে সমস্ত কেস আসে, সেগুলির অধিকাংশ অস্ত্রোপচারও হয় এখানেই। চার-পাঁচ মাস আগে এই ওটি কমপ্লেক্স জীবাণুর জন্য প্রায় ১২ দিন ধরে বন্ধ ছিল।
গত ১ এপ্রিল ফের ওটি-তে জীবাণু ঢুকেছে বলে আশঙ্কা প্রকাশ করেন চিকিৎসকেরা। ‘ওটি সোয়াব’ পাঠানো হয় হাসপাতালের মাইক্রোবায়োলজি বিভাগে।
মাইক্রোবায়োলজির চিকিৎসকদের বক্তব্য, “১ এপ্রিল সোয়াব পাওয়ার পরে আমরা পরীক্ষা করে ১০ এপ্রিলের মধ্যে রিপোর্ট তৈরি করে দিয়েছিলাম। তাতে জীবাণু পাওয়ার কথা বলাও ছিল। আমাদের খাতায় এন্ট্রি আছে। কিন্তু তার পরে কোনও ভাবে রিপোর্টটা হারিয়ে যায়! বহু কাজের তাড়ায় আমাদের এখানকার চিকিৎসকেরা ভেবেছিলেন, রিপোর্ট হয়তো ওটি কমপ্লেক্সে পৌঁছে গিয়েছে। ওটি কমপ্লেক্স থেকেও কেউ এর মধ্যে খোঁজখবর নেয়নি।”
এর পরে অস্ত্রোপচারের ফলাফল ক্রমশ খারাপ হতে থাকায় সোয়াব টেস্টের কথা ওটি-র চিকিৎসকদের হঠাৎ মনে পড়ে বলে হাসপাতাল সূত্রে খবর। তার পরেই ২৬ দিন পরে সেই রিপোর্ট আনা হয়।
এই গাফিলতির জেরে এত দিন ধরে এত জন রোগীর স্বাস্থ্য নিয়ে যে ‘ছেলেখেলা’ হল, তার দায় কে নেবে? কেন এত গুরুত্বপূর্ণ রিপোর্ট ফেলে রেখে নির্বিকারে জীবাণুময় ওটি-তে অস্ত্রোপচার চালিয়ে যাওয়া হল?
গ্রিন বিল্ডিং ওটি কমপ্লেক্সের চিকিৎসক ও নার্সরা এই প্রশ্নের জবাবে শুধু বললেন, “ভুলে গিয়েছিলাম। কী আর করা যাবে!” |
|
|
|
|
|