|
|
|
|
|
|
আলেয়া |
অবাস্তব লাভের লোভে দৌড়বেন না। চিনুন সব না-হারানোর সিধে রাস্তা। সঞ্চয় তো করবেনই।
কিন্তু করুন ভেবে। আপনার সঙ্গে আলোচনায় প্রজ্ঞানন্দ চৌধুরী ও ইন্দ্রজিত্ অধিকারী |
একের পর এক প্রশ্ন ধেয়ে আসছে তাঁর দিকে। বাড়ির উঠোনে হাঁটুতে মুখ গুঁজে বসে থাকা সর্বস্ব খোয়ানো মানুষটার উপর হামলে পড়েছেন পরিচিত-আধা পরিচিতেরা। কেউ জিজ্ঞাসা করছেন, “তাবড় ব্যাঙ্কই ৮% সুদ দিতে হিমসিম। সেখানে ৫০ শতাংশের আশা করলেন কোন আক্কেলে?” কারও হাল্কা টিপ্পনি, “ঝুঁকি নেওয়ার বুকের খাঁচা যদি ছিলই, তো শেয়ার বাজারে গেলেন না কেন?”
কোনও জবাব নেই।
টানা অনেকক্ষণ প্রশ্ন, চিত্কার আর বিদ্রুপের জবাবে নিঃস্ব, রিক্ত, হতাশ মানুষটা শুধু অস্ফুটে বিড়বিড় করে বলছিলেন, “বুঝিনি। চেনা লোক দরজায় এসে টাকা নিয়ে যেত। বিশ্বাস করেছিলাম। কী সংস্থা, কী করে, ব্যবসা কেমন কিছুই জানতাম না। কী ভাবে টাকা অমন লাফিয়ে বাড়বে, তা-ও ভাবিনি। শুধু আশা ছিল, যদি ...”
আসুন শিখি
সাধারণ মানুষের টাকা হাতিয়ে বেআইনি অর্থলগ্নি সংস্থা শেষ পর্যন্ত কী ভাবে চম্পট দেয়, তা নিয়ে এত দিনে গুচ্ছ গুচ্ছ লেখা বার হয়েছে বিভিন্ন সংবাদপত্রে। টিভি চ্যানেলেও সারাক্ষণ এই নিয়ে আলোচনা। আর সেখানে বার বার উঠে আসছে নির্দিষ্ট কিছু শব্দবন্ধ। যেমন ধরুন: চিট ফান্ড, সিআইএস, সেবি, এমএলএম, এনবিএফসি ইত্যাদি। যা আগে শুনে থাকলেও, তার মানে ঠাহর করতে পারেননি ওই সব হারানো মানুষটি।
তাই আসুন, আজ সবার আগে সহজ করে এই শব্দগুলোর মানে বুঝি। জানতে চেষ্টা করি, এ ধরনের প্রকল্প বা সংস্থায় টাকা রাখা আদৌ কতটা নিরাপদ। কার নিয়ন্ত্রণ আসলে কার হাতে। ৩০-৪০-৫০ শতাংশ তো দূর অস্ত্, কেন কেউ সাড়ে বারো শতাংশের বেশি সুদ দিতে চাইলেই যথেষ্ট কারণ আছে সিঁদুরে মেঘ দেখার।
বিনিয়োগে ঝুঁকি কম-বেশি থাকবেই। কিন্তু এগুলো জেনে রাখতে পারলে, অন্তত অকারণ ঝুঁকি নেওয়ার আগে দু’বার ভাববেন আপনি। সতর্ক হবেন আগেভাগে।
চিট ফান্ড কিন্তু বেআইনি নয়
• সুদীপ্ত সেন ফেরার হওয়ার পর সব থেকে বেশি আলোচিত শব্দ সম্ভবত এটাই। চিট ফান্ড নিয়ে যে কখনও কোনও অভিযোগ ওঠেনি, এমনটা নয়। কিন্তু তা বলে চিট ফান্ড কোনও ভাবেই বেআইনি নয়। এই ব্যবসা আইন-স্বীকৃত। তারা আইন মেনে ব্যবসা করছে কি না, তা দেখার দায়িত্বও সংশ্লিষ্ট রাজ্য সরকারের।
• এ বার সারদা-সহ অর্থ লগ্নি সংস্থাগুলির কার্যকলাপ ব্যাখ্যা করতে গিয়ে চিট ফান্ড শব্দটি বিভিন্ন জায়গায় যে-ভাবে ব্যবহার করা হচ্ছে, তা ভুল। কারণ, এই সব ফান্ড যে-ভাবে ব্যবসা করে, তার ধরন সম্পূর্ণ আলাদা।
ব্যবসার ধরন
• আইন অনুযায়ী, চিট ফান্ড টাকা তুলতে পারে শুধু তার সদস্যদের কাছ থেকে (অনেকটা সমবায় বা কো-অপারেটিভের মতো)। সাধারণ মানুষের কাছ থেকে নয়। এই টাকা খাটানোরও কোনও সুযোগ নেই। তহবিলে জমা পড়া অর্থ বণ্টন করা যায় শুধু সদস্যদের মধ্যেই।
একটা উদাহরণ দিলে হয়তো বিষয়টি স্পষ্ট হতে পারে। ধরা যাক, ১০ জন মিলে মাসে ১০০০ টাকা করে জমা দিয়ে একটি চিট ফান্ড তৈরি করলেন। তা হলে প্রতি মাসে জমা পড়বে ১০০০০ টাকা। সাধারণত যত জন সদস্য, প্রকল্পের একটি ‘সাইক্ল’ (মেয়াদ) হয় তত মাসের। যাতে প্রত্যেকে এক বার করে টাকা পাওয়ার সুযোগ পান। ফলে এ ক্ষেত্রে প্রকল্পের মেয়াদ ১০ মাস।
• এমনিতে চিট ফান্ডে তহবিল বণ্টিত হয় লটারির মাধ্যমে। টাকা জমা পড়ার পর প্রতি মাসের শেষে সদস্যদের মধ্যে লটারি হয়। যার পোশাকি নাম ‘ড্র অফ চিটস্’ (CHIT)। নিয়ম হল, লটারিতে যাঁর নাম উঠবে, সেই মাসে তহবিলের পুরো টাকাই তাঁর। তবে যাঁর নাম এক বার উঠবে, তিনি কিন্তু মেয়াদের মধ্যে আর লটারিতে যোগ দিতে পারবেন না।
• যেমন উপরের দশ জনের গোষ্ঠীর কথাই ধরুন। প্রথম মাসে লটারির পর যাঁর নাম উঠবে, ১০ হাজার টাকাই পেয়ে যাবেন তিনি। পরের মাসে লটারি হবে বাকি ন’জনের মধ্যে। এ ভাবে প্রতি মাসেই এক-এক জন করে নিজের জমা দেওয়া পুরো টাকাই ফেরত পেয়ে যাবেন। সুতরাং সেই হিসেবে জমা দেওয়া টাকা মার যাওয়ার কোনও সম্ভাবনাই নেই। কে আগে বা পরে পাবেন, তার জন্যই লটারি।
• জরুরি কারণে কারও টাকার প্রয়োজন হলে, তা-ও পাওয়া সম্ভব। কেউ এই ভাবে টাকা নিতে চাইলে, সেই মাসে লটারি আর হবে না। টাকা দেওয়া হবে তাঁকেই। কিন্তু সে ক্ষেত্রে তিনি পুরো টাকা পাবেন না। তাঁকে বলতে হবে, তিনি কতটা কম নিতে রাজি। একই মাসে একাধিক জনের জরুরি প্রয়োজন হলে, নিলামে উঠবে ওই মাসের তহবিল। সর্বোচ্চ দরদাতা (যিনি সব থেকে বেশি টাকা ছাড়তে রাজি) ওই মাসের টাকা পাবেন। তবে মেয়াদের বাকি সময়ে তিনি আর লটারি বা নিলামে যোগ দিতে পারবেন না।
• এই ভাবে নিলামের দরুন যে-টাকা তহবিলের আয় হবে, মেয়াদ শেষে সুদ-সহ (ব্যাঙ্কে রাখলে) তা ভাগ করে দেওয়া হবে সব সদস্যের মধ্যে।
• মেয়াদের মধ্যে নিলাম একাধিক বার হতে পারে। তবে এক জন সদস্যের জন্য তা হবে এক বারই।
• এ রাজ্যে নথিবদ্ধ চিট ফান্ড প্রায় নেই বললেই চলে। তবে এর রমরমা ব্যবসা কেরল, অন্ধ্রপ্রদেশ, তামিলনাড়ু, মহারাষ্ট্র ইত্যাদি রাজ্যে।
নিয়ন্ত্রণ কার হাতে
• চিট ফান্ড নিয়ন্ত্রণে কেন্দ্রের আইন (১৯৮২ সালের চিট ফান্ডস্ অ্যাক্ট) ও রিজার্ভ ব্যাঙ্ক অফ ইন্ডিয়া অ্যাক্টের নির্দিষ্ট ধারা রয়েছে। যা বলবত্ করে রাজ্য সরকার।
• সংস্থা নিয়ম মেনে চলছে কি না, তা দেখার জন্য প্রতি রাজ্যে রয়েছে সেখানকার সরকার নিযুক্ত ‘রেজিস্ট্রার অফ চিটস্।’ তাই কোনও চিট ফান্ড মানুষকে প্রতারিত করলে, তা দেখার দায় রাজ্য সরকারেরই। |
|
সিআইএস: যে-জন্য টাকা তোলা, লগ্নি সেখানেই
• পুরো কথা কালেক্টিভ ইনভেস্টমেন্ট স্কিম।
• সিআইএস হল এমন কোনও প্রকল্প বা ব্যবস্থা, যেখানে কোনও সংস্থা অনেক জনের (এ ক্ষেত্রে লগ্নিকারী) কাছ থেকে টাকা সংগ্রহ করে। এবং সেই অর্থ মিলিত ভাবে কোনও পণ্য উত্পাদন, সম্পদ তৈরি, আয়ের ব্যবস্থা করা কিংবা লাভজনক প্রকল্পের জন্য বিনিয়োগ করে। তবে পেনশন, পিএফ, বিমা ইত্যাদিতে তোলা টাকা এর মধ্যে পড়ে না। আওতায় আসে না চিট ফান্ড, ব্যাঙ্ক নয় এমন আর্থিক সংস্থা (এন বি এফ সি) ইত্যাদির সংগ্রহ করা অর্থও।
• এই ধরনের প্রকল্পের ক্ষেত্রে নিয়ম হল, যে-কারণ দেখিয়ে টাকা তোলা হবে, তা খরচও করতে হবে সেই খাতেই। শুধু তা-ই নয়। এ ক্ষেত্রে লগ্নিকারীদের দেওয়া সার্টিফিকেট ঠিক শেয়ার ছাড়ার মতো করে সেবি-র অনুমতি নিয়ে স্টক এক্সচেঞ্জে নথিভুক্ত করতে হবে। এই নিয়ম ভাঙলে, তা অবশ্যই বেআইনি।
নিয়ন্ত্রণ কার হাতে
• যে কোনও সিআইএস প্রকল্পেরই নিয়ন্ত্রক হল সেবি। এ দেশে শেয়ার বাজার নিয়ন্ত্রণের রাশ যাদের হাতে।
• তবে আইন ভেঙে আমানত তুলে সুদে ফেরত দিলে, তাতে অনেক সময়ে ধোঁয়াশা তৈরি হয়। যেমন, কোনও আবাসন প্রকল্প হয়তো প্রতিশ্রুতি দিল, এখন টাকা দিন। পরে ফ্ল্যাট না-নিলে চড়া সুদে টাকা ফেরত পাবেন। কিংবা হয়তো বলা হল, টাকা দিলে শাল বা মেহগিনি গাছের এই চারা আপনার। পরে গাছ না-নিলে, মোটা টাকা ফেরত। সেবি-র নিয়মে, তা অবশ্যই বেআইনি। কিন্তু এখান থেকেই শুরু আইনের ঘোলা জলের সুযোগ নেওয়া। কারণ, এই ভাবে টাকা তুললে, তা স্পষ্টতই আমানত প্রকল্প। কিন্তু তার আইনি বল্গা কার হাতে? রিজার্ভ ব্যাঙ্ক না সেবি?
• অনেক অর্থলগ্নি সংস্থার দাবি, তারা আসলে ব্যাঙ্ক নয় এমন আর্থিক সংস্থা (এনবিএফসি)। তাই তাদের উপর নজরদারির অধিকার সেবি-র নেই।
• এখানেই আইনি সমস্যায় নিয়ন্ত্রকরাও। কারণ, সিআইএস প্রকল্পের রাশ থাকে সেবি-র হাতে। কিন্তু ডিপোজিট স্কিমের নিয়ন্ত্রণ আবার রিজার্ভ ব্যাঙ্কের আওতায়। তাই ‘আধা সিআইএস-আধা ডিপোজিট’ প্রকল্পে নজরদারির এক্তিয়ার কার, ধন্দ থেকে যাচ্ছে তা নিয়ে।
সাবধানতার দু’চার কথা
• এই প্রকল্পে টাকা তুলতে সেবি-র অনুমোদন জরুরি। এমনকী সংস্থা একই হলেও প্রতি প্রকল্পের জন্য আলাদা ছাড়পত্র প্রয়োজন। সংস্থা বা প্রকল্প আদৌ নথিভুক্ত কি না, তা দেখতে পাবেন সেবি-র ওয়েবসাইটেই www.sebi.gov.in।
• ভাল হতে হবে ক্রেডিট রেটিং (অর্থাত্, এখানে টাকা রাখলে তা মার যাওয়ার সম্ভাবনা যে যথেষ্ট কম, তা বলতে হবে রেটিং সংস্থাকে)।
• প্রকল্প সম্পর্কে গোড়াতেই বিস্তারিত জানাতে হবে ইচ্ছুক লগ্নিকারীকে।
• সেবি-র কাছে প্রকল্পের খুঁটিনাটি জমা দেওয়ার পরে সংস্থাকে অপেক্ষা করতে হবে অন্তত ২১ দিন। তার মধ্যে সেবি কিছু বদলাতে না-বললে, তবেই টাকা তোলার প্রশ্ন।
• টাকা রাখলে, এক জন বিনিয়োগকারী হিসেবে সংস্থা সম্পর্কে বিভিন্ন তথ্য চাইতেই পারেন আপনি। যেমন ধরুন, তার লাভ-ক্ষতি, ব্যালান্স শিট ইত্যাদি।
তাই যে-কোনও সংস্থার সিআইএস প্রকল্পে টাকা ঢালার আগে দেখুন, তা উপরের শর্তগুলি পূরণ করে কি না।
এত কিছুর পরেও ...
• মনে রাখবেন, প্রকল্পে ছাড়পত্র দিলেই তার দায়িত্ব কিন্তু সেবি-র নয়।
• কোনও কারণে সংস্থা ব্যবসা গোটালে, লগ্নিকারীদের টাকা ফেরতের দায়ও বর্তাবে না এই নিয়ন্ত্রণ কর্তৃপক্ষের উপর।
অভিযোগ কার কাছে?
• সিআইএস নিয়ে (বিশেষত টাকা ফেরত না-পাওয়ার বিষয়ে) কোনও অভিযোগ থাকলে, প্রথমে সংশ্লিষ্ট সংস্থাকে জানান।
• কাজ না-হলে, লিখিত ভাবে অভিযোগ দায়ের করুন সেবি-র কাছে।
• সমস্যার কথা জানাতে পারেন জেলার ক্রেতা সুরক্ষা দফতরেও (কনজিউমার রিড্রেসাল ফোরাম)।
• সংস্থার দেওয়া চেক বাউন্স করলে, তা আইনি অপরাধ। সে ক্ষেত্রে তাদের বিরুদ্ধে আদালতে যেতে পারেন।
এনবিএফসি: ব্যাঙ্ক না-হয়েও টাকার কারবারি
• পুরো নাম নন ব্যাঙ্কিং ফিনান্সিয়াল কোম্পানি (ব্যাঙ্ক নয়, এমন আর্থিক সংস্থা)।
• এই ধরনের সংস্থা ১৯৫৬ সালের কোম্পানি আইনে (কোম্পানিজ অ্যাক্ট) নথিবদ্ধ। এদের মূল ব্যবসা আর্থিক লেনদেন। তা ঋণ দেওয়া, শেয়ার-বন্ড-ডিবেঞ্চার ইত্যাদি কেনাবেচা, বিমা ব্যবসা, চিট ফান্ড ব্যবসার মতো অনেক কিছুই হতে পারে।
তবে আসল শর্ত হল, এই ধরনের সংস্থার মূল ব্যবসা কখনওই কৃষি, শিল্প, পরিষেবা প্রদান, স্থাবর সম্পত্তি (যেমন জমি, বাড়ি, ফ্ল্যাট) কেনা-বেচা ইত্যাদি হতে পারবে না। অর্থাত্, তাদের মূল ব্যবসা হতে হবে আর্থিক ক্ষেত্রেই।
• মনে রাখবেন, সাধারণ মানুষের কাছ থেকে টাকা তোলা বা তা রাখার অধিকার কিন্তু সব এনবিএফসি-র নেই। তা করতে গেলে নির্দিষ্ট ভাবে রিজার্ভ ব্যাঙ্কের অনুমতি জরুরি।
ব্যাঙ্ক বনাম এনবিএফসি
এক ঝলক দেখলে মনে হয়, ব্যাঙ্ক আর এনবিএফসি-র কাজকর্ম বুঝি একেবারেই এক। কিন্তু আসলে তাদের মধ্যে ফারাক যথেষ্ট। যেমন
(১) ব্যাঙ্ক নয়, এমন কোনও সংস্থা ডিমান্ড ডিপোজিট সংগ্রহ করতে পারে না। অর্থাত্, এমন আমানত তোলার ক্ষমতা তাদের নেই, যা গ্রাহক চাইলেই সঙ্গে সঙ্গে ফেরত দিতে হয়। ব্যাঙ্কে সেভিংস অ্যাকাউন্টে রাখা টাকা কিন্তু বিনা নোটিসেই যখন খুশি তুলতে পারেন আপনি।
(২) ব্যাঙ্কের মতো চেক ইস্যু করার এক্তিয়ার এই সব সংস্থার নেই।
(৩) ব্যাঙ্কে লগ্নিকারীদের আমানতের (একটি নির্দিষ্ট অঙ্ক পর্যন্ত) সুরক্ষা দেয় ডিপোজিট ইনশিওরেন্স অ্যান্ড ক্রেডিট গ্যারান্টি কর্পোরেশন। কিন্তু আমানতে বিমার এই সুরক্ষা এনবিএফসি-র লগ্নিকারীদের জন্য বরাদ্দ নয়। এখানে পরে এ নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা করব আমরা।
|
|
‘অভিভাবক’ রিজার্ভ ব্যাঙ্ক?
• ১৯৩৪ সালের আরবিআই আইন অনুযায়ী, ব্যবসা করার জন্য বাধ্যতামূলক ভাবে রিজার্ভ ব্যাঙ্কের কাছে নথিভুক্তির শংসাপত্র নিতে হবে এনবিএফসি-কে। থাকতে হবে অন্তত ২ কোটি টাকার নিজস্ব নিট তহবিলও।
• তবে যে সব এনবিএফসি-র নজরদারি অন্য কোনও নিয়ন্ত্রক সংস্থার হাতে, তাদের ক্ষেত্রে এই নিয়ম প্রযোজ্য নয়। যেমন
— সেবি-র কাছে নথিবদ্ধ ভেঞ্চার ক্যাপিটাল, স্টক ব্রোকিং কিংবা মার্চেন্ট ব্যাঙ্কিং সংস্থা।
— আইআরডিএ-র অনুমোদন থাকা বিমা সংস্থা।
— চিট ফান্ড (নজরদারির দায়িত্ব রাজ্য সরকারের)।
— গৃহঋণ সংস্থা (নিয়ন্ত্রক এনএইচবি)।
— নিধি সংস্থা (নিয়ন্ত্রণের ভার কোম্পানি বিষয়ক মন্ত্রকের) ইত্যাদি
জানব কী করে?
• কোনও এনবিএফসি রিজার্ভ ব্যাঙ্কের কাছে নথিভুক্ত কি না, তা দেখতে পাবেন তাদের ওয়েবসাইটেই।
• www.rbi.org.in সাইটে যান। সেখানে খুঁজুন Sitemap। নথিভুক্ত এনবিএফসিগুলির তালিকা পাবেন সেখানে। দেখতে পাবেন তাদের প্রতি শীর্ষ ব্যাঙ্কের জারি করা বিজ্ঞপ্তিও।
সবেরই নিয়ম আছে
• কোন এনবিএফসি কত দিনের জন্য কত টাকা তুলতে পারবে, তা নিয়ে নির্দেশিকা রয়েছে রিজার্ভ ব্যাঙ্কের। কোন সংস্থা সর্বোচ্চ কত অর্থ তুলবে, তা নির্ভর করে তিনটি বিষয়ের উপর
• সংস্থাটি কী ধরনের এনবিএফসি?
• সংস্থার নিট তহবিলের অঙ্ক।
• ক্রেডিট রেটিং আছে কি না।
• ৩০, ৪০ কিংবা ৫০ শতাংশ সুদের স্বপ্ন তো ছেড়েই দিন। রিজার্ভ ব্যাঙ্কের নিয়ম অনুযায়ী, ১২.৫ শতাংশের বেশি সুদ দিতেই পারবে না এনবিএফসি (সময়ের সঙ্গে সঙ্গে এই হার অবশ্য বদলাতে পারে)। চক্রবৃদ্ধি হারে সুদ হলে, তা হিসেব করতে হবে অন্তত মাসিক ভিত্তিতে। দিনে বা সপ্তাহে নয়।
• আমানত সংগ্রহ করতে হবে অন্তত ১২ মাসের মেয়াদে। সব থেকে বেশি ৬০ মাসের (পাঁচ বছর) জন্য।
• টাকা তোলার জন্য এই ধরনের সংস্থা আমানতকারীদের কোনও উপহার কিংবা উত্সাহ ভাতা (ইনসেন্টিভ) দিতে পারবে না।
খেয়াল রাখুন
• শেষ পর্যন্ত কোনও এনবিএফসি-তে টাকা রাখার সিদ্ধান্ত নিলে, উপরের বিষয়গুলি অবশ্যই মাথায় রাখুন। আকাশকুসুম সুদের স্বপ্নে ভুলবেন না।
• দেখে নিন, টাকা জমার রসিদ ঠিকঠাক পেলেন কি না।
• মনে রাখবেন, ব্যাঙ্কের মতো এখানকার আমানত কিন্তু সুরক্ষিত নয়।
• এনবিএফসি-র একটা বড় অংশের উপর নজরদারির দায়িত্ব রিজার্ভ ব্যাঙ্কের হলেও লগ্নিকারীদের টাকা ফেরতের দায় তাদের উপর বর্তায় না।
টাকা ফেরত না-পেলে?
• এনবিএফসি টাকা না-ফেরালে কোম্পানি ল বোর্ড কিংবা ক্রেতা সুরক্ষা দফতরের দ্বারস্থ হতে পারেন। যেতে পারেন আদালতেও।
• এ রাজ্যে আঞ্চলিক কোম্পানি ল বোর্ডের ঠিকানা
কোম্পানি ল বোর্ড
কলকাতা বেঞ্চ
৫, এসপ্লানেড ইস্ট রো (পশ্চিম)
কলকাতা৭০০০০১
ফোন: (০৩৩) ২২৪৮-৬৩৩০
ফ্যাক্স: (০৩৩) ২২৬২-১৭৬০
|
|
আরএনবিসি: এখন অতীত
• পুরো কথা রেসিডুয়ারি নন ব্যাঙ্কিং কোম্পানি। এই সংস্থাগুলিও কিন্তু আদতে ব্যাঙ্ক নয়, এমন আর্থিক সংস্থা (এনবিএফসি)।
• আরএনবিসি আইন এখনও বাতিল হয়নি। কিন্তু এই ধরনের সংস্থাকে বাজার থেকে আমানত সংগ্রহ বন্ধ করতে আগেই নির্দেশ দিয়েছে রিজার্ভ ব্যাঙ্ক। তাদের বলা হয়েছে, ব্যবসার খোলনলচে বদলে ফেলতে।
কিন্তু সাম্প্রতিক কেলেঙ্কারি সামনে আসার পর অনেকেরই অভিযোগ, আসলে আরএনবিসি-র ধাঁচেই বাজার থেকে টাকা তুলছে কোনও কোনও লগ্নি সংস্থা। তাই এ সম্পর্কেও দু’চার কথা জেনে রাখা ভাল।
• এদের মূল ব্যবসাই হল বিভিন্ন প্রকল্পের মাধ্যমে আমানত সংগ্রহ করে তা খাটানো। তা যেমন একলপ্তে মোটা টাকা হতে পারে, তেমনই আবার হতে পারে ছোট ছোট কিস্তিও। তবে ডিমান্ড ডিপোজিট সংগ্রহ করতে পারে না আরএনবিসি-ও।
• সংগৃহীত টাকার কতটা কোথায় খাটাতে হবে, এই সব সংস্থার জন্য তা বেঁধে দিয়েছে রিজার্ভ ব্যাঙ্ক। যার অধিকাংশই যথেষ্ট সুরক্ষিত (সরকারি বন্ড, ফিক্সড ডিপোজিট, মিউচুয়াল ফান্ড ইত্যাদি)। চড়া রিটার্নের লোভে অধিকাংশ সময়েই যে-সব জায়গা এড়িয়ে অতিরিক্ত ঝুঁকির প্রকল্পে টাকা ঢালে এ ধরনের অর্থলগ্নি সংস্থাগুলি।
ধোঁয়াটে আইন
সিআইএস নিয়ে আলোচনার সময়ে আমরা দেখেছি, সে ক্ষেত্রে কী ভাবে আইনের ফাঁককে ব্যবহার করে রমরমিয়ে ব্যবসা করে বেআইনি অর্থলগ্নি সংস্থাগুলি। আইনের ধূসর জায়গার সুযোগ নেওয়ার ওই প্রবণতা তাদের বজায় থাকে প্রায় সব ক্ষেত্রেই। এ নিয়ে অন্তত প্রাথমিক জ্ঞানটুকু থাকলে, আগাম সাবধান হওয়ার চেষ্টা করা যেতে পারে। যেমন
• আইন বলে, ‘প্রাইভেট প্লেসমেন্টের’ মাধ্যমে চেনা-পরিচিতদের কাছে ডিবেঞ্চার (ঋণপত্র) ছেড়ে ইচ্ছে মতো টাকা তুলতে পারে কোনও সংস্থা। তার জন্য সেবি-র কাছে নথিভুক্ত হওয়ার প্রয়োজন নেই। কিন্তু শর্ত হল, এ ভাবে অর্থ সংগ্রহ করা যাবে সর্বাধিক ৪৯ জনের কাছ থেকে।
• ৫০ কিংবা তার বেশি জনের কাছ থেকে ডিবেঞ্চারের মাধ্যমে টাকা তুলতে গেলেই তাকে ধরা হবে ‘পাবলিক অফার’ হিসেবে। সে ক্ষেত্রে সেবি-র কাছে নথিভুক্তি বাধ্যতামূলক। মানতে হবে নিয়ন্ত্রক কর্তৃপক্ষটির যাবতীয় নিয়মকানুনও। তাই এই ‘বিপত্তি’ এড়াতে নিয়মের ফাঁক খোঁজে অর্থলগ্নি সংস্থাগুলি।
• প্রায়ই দেখা যায়, প্রাইভেট প্লেসমেন্টে টাকা তোলার জন্যও রীতিমতো প্রচার করছে বা বিজ্ঞাপন দিচ্ছে অনেক সংস্থা। অথচ প্রচার করে টাকা তুললে তা পাবলিক অফারের পর্যায়ে পড়ে। কিন্তু এ নিয়ে আইন স্পষ্ট না-হওয়ায়, ফায়দা তোলে সংস্থাগুলি।
• একই সমস্যা রেজিস্ট্রার অফ কোম্পানিজ (আরওসি)-এর কাছে নথিভুক্ত কিছু সংস্থার ক্ষেত্রেও। এখানেও প্রাইভেট প্লেসমেন্টে সর্বাধিক ৪৯ জনের কাছ থেকে ডিবেঞ্চার মারফত টাকা তোলা যায়। কিন্তু দেখা যায়, আইনি ফাঁকের সুযোগ নিয়ে একের পর এক ডিবেঞ্চারের সিরিজ ছেড়ে যাচ্ছে কোনও সংস্থা। এবং তা থেকে টাকা তুলছে প্রাইভেট প্লেসমেন্টের মাধ্যমে। এ বার ভেবে দেখুন, কেউ যদি ১৬০টি ভিন্ন সংস্থা খুলে তাদের প্রতিটির নামে একের পর এক ডিবেঞ্চারের সিরিজ ছাড়তে থাকে, তা হলে কত টাকা তোলা সম্ভব!
• আইন নিয়ে এমন ধোঁয়াশা থাকার কারণেই কিন্তু অনেক সময়ে আঁচ পাওয়া সত্ত্বেও আগাম ব্যবস্থা নিতে পারে না নিয়ন্ত্রণ কর্তৃপক্ষগুলি। কোনও সংস্থা লগ্নিকারীদের টাকা ফেরাতে ব্যর্থ হলে, একমাত্র তবেই প্রতারণা ইত্যাদি আইনে ব্যবস্থা নিতে পারে তারা।
ডিআইসিজিসি: ব্যাঙ্ক আমানতের বিমা
পুরো নাম ডিপোজিট ইনশিওরেন্স অ্যান্ড ক্রেডিট গ্যারান্টি কর্পোরেশন।
আমরা জানি, ব্যাঙ্ক ডুবলে লগ্নিকারীদের আমানত (একটি নির্দিষ্ট অঙ্ক পর্যন্ত) সুরক্ষিত রাখে ডিআইসিজিসি। যে-সুরক্ষা এনবিএফসি-তে নেই। এ বার এখানে সেই সুরক্ষা নিয়েই একটু বিশদে আলোচনা করব আমরা।
কাদের রক্ষাকবচ?
এই সুরক্ষাচক্রের আওতায় রয়েছে সমস্ত বাণিজ্যিক ব্যাঙ্ক। তা সে সরকারি, বেসরকারি, গ্রামীণ কিংবা আঞ্চলিক, যা-ই হোক না কেন। এমনকী এর এক্তিয়ারে রয়েছে বিদেশি ব্যাঙ্কের ভারতীয় শাখাগুলিও।
কীসের সুরক্ষা?
ব্যাঙ্কে প্রায় সব ধরনের আমানতের (সেভিংস, ফিক্সড, কারেন্ট, রেকারিং ইত্যাদি) বিমা করা থাকে ডিআইসিজিসি-র কাছে। তার জন্য প্রিমিয়াম গোনে সংশ্লিষ্ট ব্যাঙ্কই। ফলে কোনও কারণে ব্যাঙ্কে লালবাতি জ্ব ললে, একটি নির্দিষ্ট অঙ্ক পর্যন্ত আমানত ফেরত পান লগ্নিকারীরা।
বিমার সীমা
তা বলে অবশ্য ব্যাঙ্কে থাকা সব টাকাই যে ফেরত পাওয়া যাবে, এমনটা নয়। কারণ, কোনও ব্যাঙ্কের সব শাখা মিলিয়ে এক জনের যে-অঙ্কই থাকুক, বিমা করা থাকে সর্বোচ্চ এক লক্ষ টাকাই। তাও সুদ-সহ।
ধরা যাক, ‘ক’ ব্যাঙ্কের সব ক’টি শাখা মিলিয়ে ‘খ’বাবুর ৯৫ হাজার টাকা রয়েছে। যার উপর তিনি সুদ পাবেন ৪ হাজার। সে ক্ষেত্রে বিমার আওতায় থাকছে তাঁর ৯৯ হাজার টাকার পুরোটাই। কিন্তু যদি ৯৫ হাজারের উপর ৭ হাজার টাকা সুদ প্রাপ্য হত, সে ক্ষেত্রেও এক লক্ষ টাকার উপরেই কভারেজ পেতেন তিনি। বাকি দু’হাজারে পেতেন না।
বিমা বাড়বে কী ভাবে?
কোন কোন ক্ষেত্রে এক জন এক লক্ষের বেশি ব্যাঙ্ক-জমায় বিমার সুবিধা পেতে পারেন? এ ক্ষেত্রে উত্তর হল
• একাধিক ব্যাঙ্কে টাকা থাকলে। কারণ সে ক্ষেত্রে প্রতিটি ব্যাঙ্কেই এক লক্ষ পর্যন্ত টাকায় বিমার হকদার তিনি।
• একই/বিভিন্ন ব্যাঙ্কে একাধিক জয়েন্ট অ্যাকাউন্ট থাকলে। তবে সে ক্ষেত্রে হয় ওই সব অ্যাকাউন্ট আলাদা-আলাদা লোকের সঙ্গে খুলতে হবে, আর নইলে বদলাতে হবে নামের ক্রম। যেমন, ‘ক’ যদি ‘খ’ এবং ‘গ’-এর সঙ্গে পৃথক জয়েন্ট অ্যাকাউন্ট খোলে, তবে আলাদা করে বিমার সুবিধা পাবে দু’জায়গাতেই। তেমনই আবার ‘ক’-‘খ’এর জয়েন্ট অ্যাকাউন্টের থেকে আলাদা করে ধরা হবে ‘খ’-‘ক’এর জয়েন্ট অ্যাকাউন্টকে।
মনে রাখবেন, ব্যাঙ্কে বিনিয়োগের ক্ষেত্রে বিমার এই কভারেজ কিন্তু মস্ত সুবিধা। তাই টাকা রাখার আগে ব্যাঙ্কের শাখায় অবশ্যই এ বিষয়ে বিস্তারিত জেনে নিন। |
|
পাবলিক ডিপোজিটের নিয়ম-কানুন
সরকারি কিংবা বেসরকারি যে সংস্থাই টাকা তুলুক না-কেন, তার হাতে আসা সেই পাবলিক ডিপোজিটকে (জনগণের আমানত) সুরক্ষিত রাখতে একগুচ্ছ নিয়ম-নীতি রয়েছে কেন্দ্রের। এ ক্ষেত্রে মেনে চলা হয় ১৯৫৬ সালের কোম্পানি আইন (কোম্পানিজ অ্যাক্ট)। রিজার্ভ ব্যাঙ্কের পরামর্শ মেনে যেটি অনুযায়ী কিছু নিয়ম-নীতি তৈরি করে দিয়েছে দিল্লি। এর নাম কোম্পানিজ অ্যাকসেপ্ট্যান্স অফ ডিপোজিটস রুলস, ১৯৭৫ বা আমানত গ্রহণ নীতি।
এর মধ্যে খুব গুরুত্বপূর্ণ কয়েকটি অন্তত মাথায় রাখা জরুরি
• ১২.৫ শতাংশের বেশি সুদ দেওয়া চলবে না(সময়ের সঙ্গে পরিবর্তযোগ্য)। এ বার সেখানে বিতর্কিত লগ্নি সংস্থা- গুলির বিজ্ঞাপিত সুদ চিন্তা করে দেখুন।
• এক বছর পর্যন্ত মেয়াদের আমানতের জন্য এক শতাংশের বেশি ব্রোকারেজ দিতে পারবে না কোনও সংস্থা। এক বছরের বেশি অথচ দু’বছরের কম, এমন লগ্নির জন্য তা হতে পারে দেড় শতাংশ পর্যন্ত। মেয়াদ তারও বেশি হলে, ২ শতাংশ। তবে প্রতি বছর নয়, ব্রোকারেজ দেওয়া যাবে এক বারই। এর পাশে চিন্তা করুন এজেন্ট টানতে প্রথম দিকে অর্থলগ্নি সংস্থাগুলির দেওয়া সুযোগ-সুবিধার বহর।
• যত টাকার শেয়ার বাজারে ছাড়া হয়েছে আর ‘ফ্রি রিজার্ভ’ হিসেবে যা ব্যালান্স শিটে দেখানো আছে, তাদের সম্মিলিত অঙ্কের বড়জোর ১০ শতাংশ আমজনতার আমানত হিসেবে সংগ্রহ করতে পারবে সংস্থা।
• আগে গ্রাহকদের টাকা না-ফেরানোর ‘ইতিহাস’ থাকলে, নতুন করে আর আমানত সংগ্রহ করা চলবে না।
• ব্যাঙ্ক সাধারণ মানুষের কাছে টাকা সংগ্রহ করে বলে আইনি পরিকাঠামো অনুযায়ী তার একটা অংশ তুলে রাখা বাধ্যতামূলক। যাতে প্রয়োজনে তা গ্রাহকদের ফেরানো যায় (সিআরআর ও এসএলআর)। তেমনই ব্যাঙ্ক নয় এমন সংস্থার জন্যও রয়েছে এই টাকা সরিয়ে রাখার নিয়ম। তাই যেখানে টাকা রাখছেন, জেনে নিন তারা টাকা সরিয়ে রাখছে কি না। ওই তুলে রাখা অর্থ একমাত্র টাকা মেটানো ছাড়া আর কোনও খাতে খরচ হওয়ার কথা নয়।
• এ ভাবে বাজার থেকে টাকা তুলতে গেলে প্রথমেই অন্তত একটি ইংরেজি ও একটি স্থানীয় ভাষার কাগজে বিজ্ঞাপন দেওয়া বাধ্যতামূলক।
• সেখানে থাকতে হবে সংস্থা ও তার প্রকল্প সম্পর্কে বিশদ তথ্য। যেমন
— সংস্থার নাম।
— তা তৈরি হওয়ার বছর।
— ব্যবসার ধরন, শাখার খুঁটিনাটি।
— সংস্থা পরিচালনার সংক্ষিপ্ত বিবরণ।
— পরিচালন পর্ষদের সদস্যদের নাম, ঠিকানা, পরিচয়।
— মুনাফার অঙ্ক, ডিভিডেন্ড, কর, সংস্থার সামগ্রিক আর্থিক অবস্থা।
বিজ্ঞাপনে দেওয়া এই সমস্ত তথ্য যে-সঠিক, সে ব্যাপারে দায়িত্বও নিতে হবে পরিচালন পর্ষদের সদস্যদের।
• লগ্নি করার আগে সংস্থার দেওয়া আবেদনপত্র অবশ্যই ভর্তি করতে হবে ইচ্ছুক গ্রাহককে। তেমনই টাকা নিয়ে সংস্থা আবার সঠিক ব্যক্তির সই করা রসিদ দেবে তাঁকে।
• চুক্তিতে ঠিক হওয়া লগ্নির শর্ত পরে আর বদলে দিতে পারবে না সংস্থা।
• শুধু টাকা নিলেই হবে না। সঙ্গে সঙ্গে লগ্নিকারীর নাম-ঠিকানা, টাকা জমার তারিখ, সুদের হার, টাকা ফেরতের দিনক্ষণ ইত্যাদি খুঁটিনাটি তুলে রাখতে হবে সংস্থাকে। নিয়মিত জমা দিতে হবে রিটার্ন। করাতে হবে অডিটও।
যে-সংস্থায় ভরসা করে টাকা রাখছেন, উপরের সব নিয়মকানুন তারা মানে তো? খবর নিন।
না-ফেরালে
• মনে রাখবেন, মেয়াদ শেষের পর ‘ক্লেম’ করা সত্ত্বেও টাকা না-ফেরালে, শাস্তি হিসেবে ওই বাড়তি সময়ের জন্য আপনাকে ১৮% সুদ দিতে বাধ্য সংস্থা। ক্ষুদ্র লগ্নিকারীর জন্য এই হার ২০%।
• এই ক্ষেত্রে সংস্থা কোনও নিয়ম ভাঙলে, রিজার্ভ ব্যাঙ্কের সঙ্গে পরামর্শ করে ব্যবস্থা নেয় কেন্দ্র।
• এ বিষয়ে অভিযোগ থাকলে, তা দায়ের করতে পারেন কোম্পানি বিষয়ক দফতরের আঞ্চলিক ডিরেক্টরের কাছে। বিশদে জানতে দেখতে পারেন: www. mca.gov.in
এমএলএম: নিয়ন্ত্রকই নেই
• অর্থলগ্নি সংস্থাগুলিকে নিয়ে
দেশ জুড়ে বিতর্কের বাজারে এই শব্দবন্ধও শোনা যাচ্ছে বার বার। পুরো নাম: মাল্টি লেভেল
মার্কেটিং কোম্পানি (এমএলএম)। অনেকের দাবি, বিতর্কিত অর্থলগ্নি সংস্থাগুলির অনেক কাজ-কারবারই
এই গোত্রীয়।
• ব্যবসার ধরন হিসেবে এগুলি পুরোদস্তুর বিক্রি ও বিপণন সংস্থা। যারা বেচতে পারে কোনও পণ্য কিংবা পরিষেবা। এই ধরনের সংস্থার বিশেষত্ব হল এখানে এক জন পণ্য বা পরিষেবা বেচতে পারলে কিংবা বাজার থেকে টাকা তুলতে পারলে কমিশন পান। আবার নিজের অধীনে থাকা লোকেরাও ওই একই কাজ করতে পারলে, কমিশনের একটা মোটা অংশ জমা পড়ে তাঁর পকেটে। এ ভাবে পিরামিডের ধাঁচে ব্যবসার বহর যত বাড়ে, তত বড় অঙ্কের টাকা কমিশন পেতে পারেন উপরের দিকে থাকা কর্তাব্যক্তিরা।
ধরা পড়া কিংবা সন্দেহের তালিকায় থাকা অনেক অর্থলগ্নি সংস্থাই আবার বিভিন্ন পণ্যের কারবারকে সামনে রেখে এজেন্টদের মোটা কমিশনের লোভ দেখিয়ে ব্যবসা করে। তাই এ ধরনের ব্যবসায় টাকা রাখার আগে অবশ্যই সাবধান।
• সমস্যার আরও বড় কারণ হল, এ দেশে এই ধরনের সংস্থার নিয়ন্ত্রণ এখনও কারও হাতে দেওয়া নেই। তবে এই ধরনের সংস্থাগুলির বেআইনি ভাবে টাকা তোলা রুখতে যৌথ ভাবে নিয়ম-নীতির প্রাথমিক খসড়া তৈরি করেছে সেবি এবং কেন্দ্রীয় কোম্পানি বিষয়ক মন্ত্রক।
মাইক্রো ফিনান্স: সমর্থনে যোজনা কমিশনও
প্রথমেই স্পষ্ট বলে দেওয়া ভাল যে, এ বারের লগ্নি সংস্থা কেলেঙ্কারির সঙ্গে মাইক্রো ফিনান্স বা ক্ষুদ্র ঋণ সংস্থার কোনও যোগ নেই। বরং এ নিয়ে ভীতি তৈরি হওয়ার জেরে যাতে ক্ষুদ্র ঋণ সংস্থা মার না-খায়, তা নিয়ে ইতিমধ্যেই সওয়াল করেছেন অর্থনীতিবিদেরা। সমর্থন করেছে যোজনা কমিশনও।
তা ছাড়া, ক্ষুদ্র ঋণ সংস্থার সঙ্গে আমানত তোলার কোনও সম্পর্ক নেই। তাদের কাজ শুধুই ঋণ দেওয়া।
তবে বছর খানেক আগেই এ নিয়ে তৈরি হয়েছিল বিতর্ক। অভিযোগ উঠেছিল, সাধারণ গরিব মানুষের কাছ থেকে আকাশছোঁয়া হারে সুদ নেওয়ায় আরও বেশি করে ঋণের জালে জড়িয়ে যাচ্ছেন তাঁরা। ঋণের টাকা আদায় করতে গ্রাহকদের হেনস্থা করার অভিযোগও উঠেছিল সংস্থাগুলির বিরুদ্ধে।
অবশ্য উল্টো মতও আছে। অনেকেই মনে করেন, ক্ষুদ্র ঋণ সংস্থার হাত ধরেই দারিদ্র থেকে মুক্তি পেয়েছে অনেক পরিবার। ঋণের টাকা পৌঁছেছে এমন অনেকের কাছে, এমনিতে ব্যাঙ্কিং পরিষেবা থেকে যাঁরা ‘বঞ্চিত’।
তবে এখানে সেই বিতর্ক সরিয়ে রেখে বরং এই সংস্থাগুলি সম্পর্কে সংক্ষেপে কিছু জেনে রাখি আমরা।
একনজরে
• ক্ষুদ্র ঋণ সংস্থা হল সেই এন বি এফ সি, যার অন্তত ৮৫% সম্পদ ব্যবহৃত হয় গ্রামাঞ্চলে এমন সব পরিবারকে ঋণ দেওয়ার কাজে, যাদের বার্ষিক আয় ৬০ হাজার টাকার মধ্যে। আধা-শহর অঞ্চলে এই সীমা ১.২০ লক্ষ।
• অন্তত ৭৫% ঋণ বরাদ্দ
বিভিন্ন কর্মমুখী প্রকল্পে। যেখান থেকে মানুষ আয়ের বন্দোবস্ত করতে পারবেন।
• প্রথম দফায় ধার দেওয়া হয়
৩৫ হাজার টাকা পর্যন্ত। পরে ৫০ হাজার।
• ঋণগ্রহীতার মোট ধারের অঙ্ক ৫০ হাজার ছাড়ালে চলবে না।
• ধার দেওয়া হয় বন্ধক ছাড়াই। এবং তার মেয়াদ দু’বছরের কম নয়।
• ১৫ হাজার টাকা পর্যন্ত ধার আগে মেটালে (প্রি-পেমেন্ট) জরিমানা নেই।
• ধার শোধ করা যায় প্রত্যেক মাসে, প্রতি পনেরো দিনে এমনকী সপ্তাহেও।
• এই ধরনের সংস্থার কাছে সাধারণত গোষ্ঠীবদ্ধ ভাবে ধার নেন সাধারণ মানুষ (বিশেষত মহিলারা)। ফলে ঋণ ব্যক্তিগত ভাবে শুধতে হলেও, তার জন্য একে অপরকে লাগাতার সজাগ রাখেন গোষ্ঠীর সদস্যরা। ব্যক্তি-ঋণের দায়ও থাকে গোষ্ঠীর উপর। অর্থাত্, গোষ্ঠীই এখানে গ্যারান্টর।
সাবধানের মার নেই
অনেকেই বলেন, ক্ষুদ্র ঋণ সংস্থার কাছ থেকে নেওয়া ধার বুদ্ধি করে ব্যবহার করলে, নিজের পায়ে দাঁড়ানোর পুঁজি মেলে। কিন্তু তা সত্ত্বেও গোড়া থেকেই অন্তত কয়েকটি বিষয়ে সতর্ক হওয়া প্রয়োজন। যেমন
• গোড়াতেই জানুন, সুদের হার কত।
• ধার পাওয়ার শর্তই বা কী?
• জানুন, সংস্থা রিজার্ভ ব্যাঙ্কের অনুমোদিত কিংবা শেয়ার বাজারে নথিভুক্ত কি না। নইলে কোনও সমস্যা হলে, তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া কঠিন হয় নিয়ন্ত্রণ কর্তৃপক্ষের পক্ষে।
|
বাবলু মণ্ডল
রিক্শা চালক,হাওড়া
• প্রতি মাসে রাখেন ১৪০ টাকা। এমন প্রকল্প দু’টি।
• সংস্থার প্রতিশ্রুতি: এ ভাবে ৩ হাজার টাকা জমা দিলে, ৩ বছর পর ১৫ হাজার টাকা ফেরত। আড়াই বছর টাকা রেখেছেন। এখন চিন্তা, বাকি ছ’মাস সংস্থা থাকবে তো?
• রাখার কারণ: লোভনীয় রিটার্ন। চেনা লোকের টাকা নেওয়া। কাগজ-পত্তরের ঝামেলা ছাড়াই অল্প-অল্প করে টাকা জমা। |
পিউ গায়েন
পরিচারিকা, সুন্দরবন
• গত অগস্টে ব্যাঙ্ক থেকে অনেক কষ্টে জমানো ২০ হাজার টাকা তুলে একটি অর্থ লগ্নি সংস্থায় রাখেন। সেই সংস্থাই এখন বিতর্কের কেন্দ্রে। ফলে টাকা জলে।
• সংস্থার প্রতিশ্রুতি ছিল: পাঁচ বছরে টাকা দ্বিগুণ।
• রাখার কারণ: চড়া সুদ। টাকা নিয়ে যেতেন নিকটাত্মীয়। তাই অবিশ্বাস করেননি। উত্সাহ জুগিয়েছিলেন স্বামী, পাড়া-প্রতিবেশীরাও। |
|
সঞ্জিত্ বসু
ব্যবসায়ী, উত্তর কলকাতা
• রেকারিং ও পরে ফিক্সড ডিপোজিটে দফায় দফায় লগ্নি। শেষে নিজেও এজেন্ট।
• সংস্থার প্রতিশ্রুতি ছিল: পাঁচ বছরে টাকা দ্বিগুণ। সেই সঙ্গে এজেন্ট হিসেবে মোটা কমিশন।
ছিল বাড়িতে বসে চাল-ডাল-আটা পাওয়ার মতো বাড়তি সুবিধার টোপও।
• রাখার কারণ: ব্যাঙ্কের তুলনায় অনেক বেশি সুদ। প্রথম দিকে টাকা মেলায় বেড়েছিল বিশ্বাসও। |
|
রূপম সেন
ছোট ব্যবসায়ী, গড়িয়া
• অল্প অল্প করে একাধিক প্রকল্পে লগ্নি করেছেন মোট ৫০ হাজার টাকা। এমন সংস্থায়, যার কর্তা এখন হাজতে। টাকা সম্ভবত জলে।
• সংস্থার প্রতিশ্রুতি ছিল: সব প্রকল্পেই লোভনীয় রিটার্ন।
• রাখার কারণ: রোজ অল্প করে টাকা জমা দেওয়ার সুবিধা। ব্যাঙ্কে যা নেই বলেই তাঁর অভিযোগ। প্রথমে কয়েক বার টাকা ফেরত পাওয়ায় বিশ্বাসের পারদ চড়েছিল। |
মহাদেব সাউ
সরকারি কর্মী, কলকাতা
• প্রথমে রেকারিং ডিপোজিটে ৭ হাজার ঢালার পর ফের ফিক্সড ডিপোজিটে বিনিয়োগ ২০ হাজার টাকা। সংস্থা ডুবেছে। তাই টাকাও জলে।
• সংস্থার প্রতিশ্রুতি ছিল: সাত বছরের এফডি-তে ২০ হাজার টাকা রাখলে, পাওয়া যাবে ৪৫ হাজার।
• রাখার কারণ: স্ত্রীর জোরাজুরি আর এজেন্টের আশ্বাস। এখনও এজেন্টের দাবি, “চিন্তা নেই, টাকা পাবেন!” |
|
কিন্তু...
• দেশের সব ব্যাঙ্ক ৮-৯ শতাংশ সুদ দিতেই হিমসিম। আইন মেনে ব্যবসা করে লগ্নির উপর ১০ শতাংশ রিটার্ন পেতেই গলদঘর্ম নামজাদা সব সংস্থা। সেই বাজারে ৩০-৪০-৫০ শতাংশ সুদ আপনাকে কোনও সংস্থা দেবে কোথা থেকে? তাই যে-কেউ যদি বিনা ঝুঁকিতে আকাশছোঁয়া সুদ বা রিটার্নের স্বপ্ন দেখায়, তা হলে অবশ্যই দু’বার ভাবুন।
• ঘাম ঝরিয়ে অনেক কষ্টে রোজগারের টাকা শুধু অন্যের কথায় বিশ্বাস করে রাখবেন কেন? বেআইনি অর্থলগ্নি সংস্থার কথা তো ছেড়েই দিন, কমিশনের লোভে গ্রাহককে ভুল বুঝিয়ে অপ্রয়োজনীয় পলিসি বিক্রি করেন বড় সংস্থার অনেক এজেন্টও। তাই সাবধান!
• মনে রাখবেন, সংস্থা ডুবলে আপনার এজেন্টও অসহায়। হয়তো রাগের বশে বড়জোর তাঁকে হেনস্থা করবেন। কিন্তু তলিয়ে যাওয়া টাকা ফেরানোর ক্ষমতা তাঁর নেই।
• যে-কোনও প্রকল্পে টাকা রাখার আগে সংস্থা সম্পর্কে বিশদ খবর নিন। ভেবে দেখুন, সেই প্রকল্প আদৌ আপনার প্রয়োজনের সঙ্গে মানানসই কি না। উত্তর হ্যাঁ হলে, তবেই টাকা ঢালুন।
• অনেকেরই অভিযোগ, ব্যাঙ্কে টাকা রাখার অনেক হ্যাপা। সেখানে অ্যাকাউন্ট খুলতে ন্যূনতম যে ‘ব্যালান্স’ বজায় রাখতে হয়, গরিব মানুষের পক্ষে তা-ও বেশ শক্ত। কিন্তু মনে রাখবেন, সকলের জন্য উন্নয়নের লক্ষ্যে ব্যাঙ্ক এখন এমন মানুষের পাশে দাঁড়াতে চাইছে। তাই আপনিও তার দিকে হাত বাড়ান।
• বাড়ির কাছাকাছি যদি ইট-কাঠের ব্যাঙ্ক না-থাকে, তা হলে ‘ব্যাঙ্কিং করেসপন্ডেন্ট’-এর ব্যাপারে খবর নিন। তিনিই আপনার সঙ্গে দেখা করে সই বা আঙুলের ছাপ নিয়ে অ্যাকাউন্ট খুলে দেবেন। টাকা জমা দেওয়া বা তোলার কাজও করে দিতে পারেন তিনি।
• খোঁজ নিন ‘নো-ফ্রিল’ অ্যাকাউন্ট সম্পর্কে। মূলত গরিব মানুষের জন্য এই পরিষেবা চালু করছে বিভিন্ন ব্যাঙ্ক। যাতে নামমাত্র অর্থ দিয়ে (যেমন, এলাহাবাদ ব্যাঙ্কে মাত্র পাঁচ টাকায়) অ্যাকাউন্ট খুলে মূল ব্যাঙ্কিং পরিষেবাটুকু অন্তত পেতে পারেন আপনি।
*পিউ গায়েন বাদে অনুরোধ মেনে বাকিদের নাম বদলে দেওয়া হল |
তথ্য সহায়তা: দেবপ্রিয় সেনগুপ্ত ও গার্গী গুহঠাকুরতা
ছবি: সুমন বল্লভ, সুদীপ্ত ভৌমিক
ও মনোজ মুখোপাধ্যায় |
|
|
|
|
|