পরপর নির্বাচনে হারের ধাক্কা সামলে এখনও জনমানসে বিশ্বাসযোগ্যতা পুরোপুরি ফিরে পাওয়া যায়নি। এরই মধ্যে তৃণমূলের বীতশ্রদ্ধ লোকজনকে নিজেদের দিকে টেনে আনা উচিত কি না, তা-ই নিয়ে জলঘোলা শুরু হয়েছে বামফ্রন্টের অন্দরে! প্রশ্ন উঠছে, এতে কি বিশ্বাসযোগ্যতা বাড়বে?
সমস্যার সূত্রপাত সিপিএমের রাজ্য সম্পাদকমণ্ডলীর সদস্য গৌতম দেবের আহ্বানে। উত্তর ২৪ পরগনার জেলা সম্পাদক হিসাবে নিজের জেলায় বেশ কিছু কর্মসূচিতে তিনি নিয়মিত বলছিলেন, তৃণমূল ছেড়ে যাঁরা আসবেন, তাঁদের টেনে নিতে হবে। জেলার কিছু প্রান্তে কিছু কর্মসূচিতে এমন কিছু লোককে সিপিএমে যোগদানও করানো হয়েছে। মাঝে কিছু দিন বন্ধ থাকার পরে সারদা-কাণ্ডের প্রেক্ষিতে গৌতমবাবু আবার সেই আহ্বানে ফিরে গিয়েছেন। বলছেন, তৃণমূল ভেঙে টুকরো টুকরো হয়ে যাবে। একটা অংশ যাবে কংগ্রেসে। বাকিদের কাছে টানতে বামেদের সচেষ্ট হতে হবে। এতেই আপত্তি তুলছে বাম শরিকেরা। তাদের প্রশ্ন, তৃণমূলের যে কর্মী-সমর্থকদের হাতে বামেদের মার খেতে হচ্ছে, কার্যালয় ভাঙা হচ্ছে, তাদের নিজেদের দিকে টানার কথা ভাবা হবে কেন? শরিকদের এমন আপত্তি অবশ্য এখনও মানতে রাজি নয় সিপিএম। গৌতমবাবুও তাঁর যুক্তিতে অবিচল।
গৌতমবাবুর বক্তব্যে প্রথম আপত্তি তুলেছিল ফরওয়ার্ড ব্লকের কোচবিহার জেলা কমিটি। ওই জেলায় বামেদের মধ্যে ফ ব শক্তিশালী হওয়ায় দিল্লি-কাণ্ডের পরে তাদের বহু কার্যালয় তৃণমূল ভেঙে দিয়েছে বলে অভিযোগ। এমতাবস্থায় ফ ব-র কোচবিহার জেলা সম্পাদকমণ্ডলী জরুরি বৈঠক ডেকে গৌতমবাবুর বক্তব্যের প্রতিবাদে প্রস্তাব পাশ করেছে। জেলা সম্পাদক উদয়ন গুহ তাঁদের আপত্তি দলের রাজ্য নেতৃত্বকে জানানোর পরে তাঁরাও এই যুক্তিতে একমত। উদয়নবাবুর প্রশ্ন, “যারা রাজ্য জুড়ে এত অত্যাচার চালাচ্ছে, আমাদের কর্মী-সমর্থকদের মারধর করছে, তাদের সঙ্গে নিতে চাইলে আমাদের নিচু তলায় কী বার্তা যাবে? তা ছাড়া, আদর্শের প্রশ্নই বা উড়িয়ে দেওয়া যাবে কী ভাবে?” ফ ব-র রাজ্য সম্পাদকমণ্ডলীর এক সদস্যেরও বক্তব্য, “এই কথায় অত্যন্ত ভুল বার্তা যাচ্ছে। সিপিএম নেতাদের কাছে জানতে চাই, তাঁদের দলের সকলেও কি এমন কথা মানতে তৈরি?” আরএসপি-র রাজ্য সম্পাদকমণ্ডলীর এক সদস্য বলছেন, “যাঁরা এ দল থেকে সে দলে যান, তাঁরা সচরাচর কিছু সুবিধা নিতে চান। তাঁদের জন্য ভেবে লাভ কী? আর অন্য দল ভাঙিয়ে নিজেদের কিছু করার ভাবনা না-থাকাই ভাল।” পরিস্থিতির বিচারে বিষয়টি শেষ পর্যন্ত রাজ্য বামফ্রন্টের বৈঠকেও উঠতে পারে।
সিপিএম অবশ্য এখনও শরিকদের আপত্তিতে একমত নয়। খোদ গৌতমবাবুর প্রশ্ন, “তা হলে তো দু’টো রাস্তা খোলা থাকছে। হয় বামফ্রন্টকে বংশবৃদ্ধি করতে হবে! নয়তো চাঁদ থেকে লোক ধরে আনতে হবে! না হলে আর বামফ্রন্ট লোক বাড়াবে কী করে? যাঁরা আপত্তি তুলছেন, তাঁদের তো এটা ভাবতে হবে!” গৌতমবাবুর পাল্টা প্রশ্ন, “গত বিধানসভা নির্বাচনে এক কোটির বেশি লোক তৃণমূলকে সমর্থন করেছিল। তারা সবাই সমাজবিরোধী, এমন বলা যায় নাকি? এটা কোনও রাজনীতি হল? তৃণমূলের কাজকর্মে অসন্তুষ্ট হয়ে যারা আসতে চাইবে, আমাদের কথা তাদের বুঝিয়ে কাছে টানার চেষ্টায় অন্যায় কোথায়?”
সিপিএমের রাজ্য সম্পাদকমণ্ডলীর এক সদস্য বাম-শাসিত রাজ্য ত্রিপুরার উদাহরণ দিচ্ছেন। তাঁর কথায়, “ওখানে কংগ্রেস ছেড়ে-আসা লোকজনকে বামেদের দিকে
সামিল করার চেষ্টা লাগাতার চলে। তাতে কোনও অসুবিধা হয় না। এমনিতেই বামপন্থী দলগুলিতে সদস্যপদ পাওয়ার আনুষ্ঠানিক প্রক্রিয়া আছে। যে-ই আসবে, সে-ই তো আর সদস্য হয়ে যাবে না! ছাঁকনি ঠিক থাকলেই হল!” |