তারকাহীন চার্চিল ব্রাদার্স চ্যাম্পিয়ন হচ্ছে দেখে উইম কোভারম্যান্সও কি তা হলে বিস্মিত?
নাকি, সুভাষ ভৌমিক কোন রসায়নে তাদের আই লিগ চ্যাম্পিয়ন করছেন তা জানতে আগ্রহী হয়ে উঠেছেন জাতীয় কোচ?
ঘটনা যাই হোক, নজিরবিহীন ভাবে সোমবার সাতসকালে ভারকায় বেটো-সুনীলদের অনুশীলন দেখতে হাজির কোভারম্যান্স! জাতীয় কোচেরা কোনও ক্লাব দলের অনুশীলন দেখতে এসেছেন, এরকম ঘটনা বিরল। তা হলে কেন তিনি হাজির? রাশভারী ডাচ কোচ কোনও উত্তর দিতে চাননি। তবে তাঁকে দেখা গেল, মোবাইল ক্যামেরায় সুভাষের টিমের অনুশীলনের বিভিন্ন মুহূর্তের ছবি তুলে রাখতে।
ফেডারেশন তাদের ওয়েব সাইটে সোনা-রুপোয় তৈরি নতুন আই লিগ ট্রফির ছবি প্রকাশ করে দিয়েছে সোমবারই। মাথায় রুপোর বল লাগানো ইউরোপিয়ান চ্যাম্পিয়নশিপের ট্রফিগুলোর আদলে তৈরি। সেটি নিয়ে আজ, মঙ্গলবার সকালে ভাস্কোর তিলক ময়দানে উপস্থিত হবেন আই লিগ কর্তারা। চার্চিল চ্যাম্পিয়ন হওয়ার পর ট্রফি তুলে দেওয়া হবে ‘সুভাষ ব্রাদার্স’-এর হাতে।
গোয়ার পারিবারিক ক্লাবটির সর্বময় কর্তা চার্চিল আলেমাও ঠিক করে ফেলেছেন, ১৬ মে তাঁর জন্মদিনেই খেতাব জয়ী ফুটবলারদের সংবর্ধনা দেবেন। দেবেন পার্টিও।
মঞ্চ প্রস্তুত! আবহাওয়া তৈরি। দরকার শুধুমাত্র এক পয়েন্ট। আজ মঙ্গলবার ওডাফা-নবিদের সঙ্গে ম্যাচ ড্র রাখতে পারলেই চাম্পিয়ন হয়ে যাবে চার্চিল ব্রাদার্স। অনন্য রেকর্ড গড়ে ফেলবেন সুভাষ ভৌমিক। “দু’ম্যাচে চাই তো এক পয়েন্ট। ফুটবলারদের বলে দিয়েছি, কেক তৈরি শেষ। তার উপর ক্রিমটা লাগিয়ে শুধু কাটতে হবে। আর সেটা করতে হবে তোমাদেরই।” অনুশীলনের পর বলছিলেন সুভাষ। মাঠের পাশের ক্লাব হাউসের দোতলায় বসে।
মাঠের এক কোণে ঠায় দাঁড়িয়ে থাকা কোভারম্যান্সের সঙ্গে ‘হাই হ্যালোর’ বেশি কিছু করেননি সুভাষ। মজা করে বলেছেন, “সাতসকালে সাহেব কোচ। কী ব্যাপার।” খেলোয়াড় জীবনের শুরু থেকেই তিনি বেশি রকমের বেপরোয়া। কোচিং জীবনে এসেও সেটা বজায় রেখেছেন। দীর্ঘ দশ বছর পর বহু অন্ধকার পেরিয়ে ফিনিক্স পাখির মতো ভেসে উঠে চ্যাম্পিয়ন হতে চলেছেন। জাতীয় কোচের সঙ্গে গা-ঘষাঘষি করতে যাবেন কেন? ঘণ্টা খানেক চার্চিল অনুশীলনে ছিলেন কোভারম্যান্স। সুভাষ বাড়তি গুরুত্ব দেননি। মগ্ন থেকেছেন টিম নিয়ে। গেম প্ল্যানিং করেছেন, সেট পিস মুভমেন্ট করিয়েছেন। ভাবটা এমন যে, “তুমি তোমার জায়গায় এক নম্বর। আমি আমার জায়গায়।”
সকালে অনুশীলনে নামার আগে ফুটবলারদের ডেকে ডেকে একান্তে কথা বলেছেন চার্চিল কোচ। অধিনায়ক বেটো শিস দিতে দিতে ঢুকলেন। সুভাষ ঘাড় ঘুরিয়ে তাকালেন। হাসলেন। আসলে এই ‘শিস’-এর আত্মবিশ্বাসটাই পুরো দলে চাইছেন চার্চিল কোচ। কোনও চাপ তিনি ঢুকতে দিতে চান না টিমে।
কিন্তু করিম বেঞ্চারিফার দলের বিরুদ্ধে ধুন্ধুমার মনস্তাত্বিক যুদ্ধে নামার আগে সুভাষ কি নিজেই চাপে আছেন? “চাপ? কীসের চাপ? বাড়িতে সিবিআই ঢোকার দিনও চাপে পড়িনি। আর এটা তো একটা ম্যাচ। আমাকে চাপে ফেলবে এরকম কেউ জন্মেছে? আমার তো অতীত-বর্তমান-ভবিষ্যৎ কিছুই নেই।” বেটো থেকে অ্যাশলে, হেনরি থেকে সতীশ সিংহ, ‘রেড মেশিন’ ফুটবলারদের শরীরী ভাষায় এই মুহূর্তে যে আত্মবিশ্বাসটা চুঁইয়ে পড়ছে, তারই প্রতিফলন ঠিকরে বেরোয় তাঁদের কোচের মুখে।
চ্যাম্পিয়ন হওয়ার মেজাজটা এরকমই হয়তো হয়। তা সে বার্সা হোক বা বায়ার্ন। ভারতসেরা হতে যাওয়া চার্চিল তার ব্যতিক্রম হবে কেন? বরং এ বারের আই লিগ চ্যাম্পিয়ন হতে চলা সুভাষের টিম বাহবা পাচ্ছে অন্য জায়গায়। মাঝ মরসুমে আর্থিক ভাবে ভেঙে পড়া সত্ত্বেও ঘুরে দাঁড়ানো। টুর্নামেন্টের মাঝপথে দলের দুই স্তম্ভ আক্রাম আর বিলালের দল ছাড়ার পর নতুন বিদেশি এনে দলকে ফের দাঁড় করানো। সঞ্জয়, আ্যাশলে, বিক্রমজিৎ, সতীশ সিংহদের মতো অনামী-জুনিয়র নিয়ে ম্যাচ জেতা। ক্লাব পর্যায়ে বাতিল সুনীল ছেত্রীকে এনে ঝকঝকে করে তোলাকঠিনতম সব হার্ডল পার হয়ে চ্যাম্পিয়ন হতে চলেছে চার্চিল। শুধু কী তাই, নানা কারণে চার্চিল ভাইদের সঙ্গে ঝামেলা হওয়ায় অন্তত তিন-চারবার পদত্যাগও তো করে বসেছিলেন সুভাষ। চ্যাম্পিয়ন হতে যাওয়ার চব্বিশ ঘণ্টা আগে নিউ আলিপুর থেকে বেনোলিমে ঘাঁটি গেড়ে বসে থাকা ভদ্রলোক তাই কিছুটা নস্ট্যালজিক। “আসিয়ান কাপের টিমটার চেয়েও এই টিমটার মধ্যে একাত্মতা বেশি। কী পরিশ্রম করেছে ছেলেরা। যা বলেছি তাই করেছে। দু’মাসের কঠিন প্রি-কন্ডিশনিং ট্রেনিং। সকাল থেকে রাত। ওরা চ্যাম্পিয়ন হবে না তো কে হবে? হেনরি। ওকে নিতে চায়নি চার্চিল। কী বায়োডাটা! আমি জোর করে নিয়েছি। জানতাম, ও দৌড় শুরু করলে সবাই শেষ। সুনীলের আত্মবিশ্বাস তলানিতে ঠেকেছিল। নিয়ে এলাম। কী খেলছে! বেটোর হাত ভাঙল। কঠিন পরিস্থিতি। উতরে দিল অন্যরা। টিমের এই পরিবার হয়ে যাওয়াটাই আমার টিমের সাফল্যের রসায়ন। ইউ এস পি। ”
ভারকা থেকে ভাস্কোর তিলক ময়দান গাড়িতে ঘণ্টাখানেকের রাস্তা। অন্য সময় হলে করিম-ওডাফা যুগলবন্দির অনুশীলনে মিডিয়া উপচে পড়ত। কিন্তু এ দিন সেখানে কেউ নেই। কারণ অবনমন বাঁচিয়ে ফেরা মোহনবাগানের সামনে ‘সম্মান বাঁচানো’ ছাড়া কোনও লক্ষ্য নেই। আর একটা কাজ ওডাফা-নবিরা করতে পারেন। তা হলপিছিয়ে দিতে পারেন চার্চিলের ট্রফি জয়ের তারিখ। কিন্তু সে ক্ষেত্রে ম্যাচটা জিততে হবে করিম ব্রিগেডকে। কিন্তু সেটা কি সম্ভব? তবে খেলাটা ফুটবল বলেই কোনও কিছুই অসম্ভব নয়। টোলগে আসেননি। ওডাফার চোট। তিনি এদিনও অনুশীলন করেননি। তবে খেলবেন। ফরোয়ার্ডে ওডাফার সঙ্গী হবেন রহিম নবি। “সামনে কলকাতা লিগ। ভাল ফল করে আত্মবিশ্বাস বাড়িয়ে নিতে চাই। এটাই মোটিভেশন।” বলছিলেন মোহন কোচ। কল্যাণীতে ২-০ হেরেছিলেন। কাল কি বদলার ম্যাচ। করিম সংযত। “সে রকম কিছু নেই।”
চার্চিল-বাগান ম্যাচের আবহাওয়া বারো বছর আগের স্মৃতি উসকে দিচ্ছে। সে বার মারগাওতে জাতীয় লিগের শেষ ম্যাচে চ্যম্পিয়ন হওয়ার জন্য চার্চিলের দরকার ছিল এক পয়েন্ট। মোহনবাগানের তিন। আব্দুল স্যালিউর গোলে চ্যাম্পিয়ন হয়ে ছিল সুব্রত ভট্টাচার্যের মোহনবাগান। এ বার অবশ্য দুই টিম মুখোমুখি হলেও পরিস্থিতি অন্য রকম। মোহনবাগানের সামনে সেরা হওয়ার সুযোগ নেই। সেটা জানেন বলেই একদিন আগে জয়ধ্বজা উড়িয়ে দিয়েছেন সুভাষ ভৌমিক। “আমরা যদি এ বার চ্যাম্পিয়ন হতে না পারি, তা হলে আমাদের সবাইকে হাঁটু গেড়ে নিল ডাউন করিয়ে মারা উচিত।”
|