|
|
|
|
ঐতিহ্যের ঘেরাটোপ টেনে
রাষ্ট্রপতি এড়ালেন রাজনীতি |
সুমন ঘোষ • মেদিনীপুর |
চোখে স্পষ্ট উচ্ছাস। হাসিতে হাল্কা শ্লাঘা। হবে না! খানিক আগেই যে স্বয়ং রাষ্ট্রপতি জানিয়ে দিয়েছেন: ‘‘অন্য শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের থেকে এই বিদ্যালয়ের একটা পার্থক্য আছে।’’
তবে সে গর্ববোধ অন্যায্য কিছু নয়। মেদিনীপুর কলেজিয়েট (বালক) স্কুল বাস্তবিকই ঐতিহ্যে আলাদা। এই স্কুলের ছাত্র ছিলেন সাহিত্য-সম্রাট বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়, তাঁর দাদা সঞ্জীবচন্দ্র, সাহিত্যিক মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়, বিপ্লবী ক্ষুদিরাম বসু, হেমচন্দ্র কানুনগো, অনাথবন্ধু পাঁজা-সহ আরও অনেক গুণীজন। স্কুলের প্রধান শিক্ষক ছিলেন ঋষি রাজনারায়ণ বসু। স্কুলের ইতিহাসের সঙ্গে জড়িয়ে রয়েছে স্বাধীনতা আন্দোলনের উজ্জ্বল বহু মুহূর্তও।
কুখ্যাত ইংরেজ জেলাশাসকদের হত্যার পরিকল্পনা এখানে বসেই করেছিলেন বিপ্লবীরা। পেডিকে হত্যার ছকও এখানেই করা হয়। তার জেরে কারাবরণ থেকে মৃত্যুবরণও করতে হয়েছিল। বিদ্যালয়ের ইতিহাসের কথা বলতে গিয়ে সে সব পুরনো প্রসঙ্গই টেনে আনলেন রাষ্ট্রপতি প্রণব মুখোপাধ্যায়। মনে করিয়ে দিলেন এই বিদ্যালয়ের আদর্শ ‘ত্যাগ, তিতিক্ষা, সমাজের জন্য জীবন উৎসর্গ করা।’ আর এখানেই মেদিনীপুর কলেজিয়েট স্কুলের সঙ্গে অন্য শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের পার্থক্য খুঁজে পেয়েছেন রাষ্ট্রপতি। |
বিদায়বেলায় |
|
রাষ্ট্রপতি চলে যাওয়ার সময় কপ্টারের উদ্দেশে হাতনাড়া ছাত্রদের। —নিজস্ব চিত্র। |
স্কুলের ১৭৫ বছর পূর্তি হয়েছে ২০০৮ সালে। তখনই প্রণববাবুকে আমন্ত্রণ জানিয়েছিলেন স্কুল কর্তৃপক্ষ। কিন্তু সময়াভাবে তিনি আসতে পারেননি। ইতিমধ্যে তিনি রাষ্ট্রপতি হয়েছে। স্কুল কর্তৃপক্ষ ফের তাঁকে চিঠি দিয়ে স্কুলে আসার আমন্ত্রণ জানান। আর ফেরাতে পারেননি দেশের সর্বোচ্চ নাগরিক। তিনি আসবেন জানানোর পরই স্কুল কর্তৃপক্ষ সিদ্ধান্ত নেন সোমবার ১৭৫তম বর্ষপূর্তির বিশেষ অনুষ্ঠান করা হবে। সেই অনুষ্ঠানে যোগ দিতেই এ দিন স্কুলে এসেছিলেন রাষ্ট্রপতি। বক্তব্য রাখা ছাড়াও তিনি স্কুলের একটি সভাকক্ষের শিলান্যাস করেন।
ঘড়ির কাঁটা তখনও বারোটা ছোঁয়নি। কলেজ-কলেজিয়েট স্কুলের মাঠে নামল হেলিকপ্টার। সেখান থেকে গাড়িতে স্কুলে পৌঁছলেন প্রণববাবু। পরের এক ঘণ্টা স্কুলের অনুষ্ঠানে ছিলেন তিনি। প্রায় ৩৫ মিনিট বক্তব্য রাখেন, যার আগাগোড়াই ছিল ইতিহাস। ১৮৩৪ সালে মেদিনীপুর কলেজিয়েট স্কুলের জন্ম। দেশে ইংরেজি শিক্ষার প্রচলন নিয়ে তখন জোর বিতর্ক চলছে। রামমোহনের মতো ব্যক্তিও ইংরেজি শিক্ষায় জোর দিয়েছেন। হিন্দু কলেজ তো ছিলই।
১৮৫৭ সালে কলকাতা, মাদ্রাজ ও বোম্বাই বিশ্ববিদ্যালয় তৈরি হল। তার আগেই মেদিনীপুরের শিক্ষানুরাগী কিছু মানুষ ইংরেজি শিক্ষার প্রবর্তনের কথা মাথায় রেখে কলেজিয়েট স্কুল গড়ে ছিলেন। সময়ের দাবিকে কখনও নস্যাৎ করেনি বিপ্লবের সুতিকাগার মেদিনীপুর। ১৮৮৫ সালে জাতীয় কংগ্রেস প্রতিষ্ঠার সময় থেকেই এখানে এসে পৌঁছেছে স্বাধীনতা আন্দোলনের ঢেউ। ১৯৪২ সালে ভারত ছাড়ো আন্দোলনের সময় অবিভক্ত মেদিনীপুরের গড়ে উঠেছে স্বাধীন তাম্রলিপ্ত সরকার। কলেজিয়েট স্কুলের ছাত্রেরাও এই আন্দোলনে সামনের সারিতে ছিলেন। যেমন হেমচন্দ্র কানুনগো। বাড়ির লোক ফ্রান্সে ইঞ্জিনিয়ারিং পড়াতে পাঠিয়েছিলেন হেমচন্দ্রকে। তিনি ইঞ্জিনিয়ারিং পড়ার সঙ্গেই শিখে ফেলেন আগ্নেয়াস্ত্র তৈরি। এ সব কথাই স্কুলের শিক্ষক-ছাত্রদের জানা। তবু রাষ্ট্রপতির মুখ থেকে সে অতীত ঐতিহ্যের কথা আরও একবার শুনে সকলেই আপ্লুত হয়ে পড়েন।
কলেজিয়েট স্কুলের সম্পাদক অগমপ্রসাদ রায়ের কথায়, “এমন একজন মানুষকে নিয়ে আসার জন্য অনেকদিন আগে থেকেই চেষ্টা করেছিলাম। প্রথমে সময়ের অভাবে তিনি আসতে পারেননি। এ বার এলেন। কী যে ভাল লাগছে!” স্কুলের প্রধান শিক্ষক দিলীপ দাস বলেন, “রাষ্ট্রপতিকে নিয়ে আসার ইচ্ছে ছিল বহুদিনের। এতদিনে সে ইচ্ছে পূরণ হল।” রাষ্ট্রপতিকে কাছে পাওয়াটাই স্কুলের বড় প্রাপ্তি। সে কথা স্মরণ করিয়ে দিতেই স্কুল কর্তৃপক্ষ এ দিন নানা উপহার তুলে দিয়েছেন রাষ্ট্রপতির হাতে। তার মধ্যে ছিল এক স্কুল ছাত্রের হাতে আঁকা প্রণববাবুর ছবিও। রাষ্ট্রপতিও আবেগ চেপে রাখতে পারেননি। তাঁর কথায়, “এরকম একটি ঐতিহ্যশালী স্কুলে আসতে পেরে আমি ধন্য। ব্যক্তি জীবনের মতো প্রতিষ্ঠানের জীবনও অনেক ঘাত প্রতিঘাতের মধ্যে চলে। নানা উত্থান-পতন রয়েছে। তা অতিক্রম করে ১৭৫ বছর পেরিয়ে যাওয়া কম কথা নয়।”
ঐতিহ্যের ঘেরাটোপে এ দিন অন্য কোনও প্রসঙ্গও তাই ব্রাত্য ছিল প্রণববাবুর বক্তব্যে। শুধু এই স্কুলের ঐতিহ্য সংরক্ষণ প্রসঙ্গে একটি বার মুখ্যমন্ত্রীর নাম করেন তিনি। তিনি বলেন, “মমতা প্রচেষ্টা চালাচ্ছেন আমাদের সংস্কৃতিকে পুনরুজ্জীবিত করতে। মুখ্যমন্ত্রীর এই কাজে আমার শুভেচ্ছা রইল।”
এ দিনের অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন রাজ্যপাল এমকে নারায়ণন ও রাজ্যের মন্ত্রী সুদর্শন ঘোষ দস্তিদার। |
|
|
|
|
|