শুধু রাজনৈতিক প্রতিপক্ষের মহড়া নেওয়ায় মন দিলে সমস্যার সমাধানে, দেশ চালনায় এবং রাজ্যপাট
সামলানোয়
প্রশাসন নজর দেবে কবে? অন্য দিকে, বিরোধী শক্তিও রাজনীতির এই মূলমন্ত্র
ভুলে গিয়েছেন।
তাঁরা শুধু নির্বাচনের দিকে তাকিয়ে বিতর্কের নম্বর জোগাড়ে ব্যস্ত। রণবীর সমাদ্দার |
সঞ্চয়িতা, সঞ্চয়িনী, সারদা... ইতিহাসের পুনরাবৃত্তি ঘটে কি না জানি না, কিন্তু ইতিহাসকে বার বার মনে পড়ে, এ ব্যাপারে সন্দেহ নেই। বামফ্রন্ট সরকারের প্রথম জমানার অর্থমন্ত্রী সহ অনেকে স্মরণ করিয়ে দিয়েছেন, সঞ্চয়িতাকে সে যুগে কী ভাবে সরকার সংসারপত্র গোটাতে বাধ্য করেছিল, এবং তার শিক্ষা কেউ নিল না কেন।
তিরিশ বছর আগের সে যুগ আর এ যুগ এক নয়। সে কথায় আসার আগে বলা দরকার সে যুগেরই কিছু কথা, যা সঞ্চয়িতার ভাগ্যে ঘটেছিল, তার সঙ্গে সম্পর্কিত এবং আজও সে কথাগুলো স্মর্তব্য। সঞ্চয়িতার মালিকত্রয়ীর বিরুদ্ধে দীর্ঘ কাল মামলা চলেছে। কেউ কিছু পায়নি বললেই চলে, সঞ্চয়িতার ‘প্রকৃত’ সম্পত্তির হদিশ মেলেনি, কারণ সম্পত্তি ছিল নানা নামে, যা পাওয়া যায়, তা ছিটেফোঁটা। কিছু আমানতকারী আত্মহত্যা করেন, কেউ কেউ তিরিশ বছর প্রতীক্ষারত যদি কিছু পাওয়া যায়। তিন মালিকের মধ্যে শম্ভুনাথ মুখোপাধ্যায় রহস্যজনক ভাবে ‘আত্মহত্যা’ করেন, দিল্লির এক বিচারালয় স্বপন গুহকে দেউলিয়া ঘোষণা করেন, বিহারিলাল মুরারকা আজও ফেরার। সে যুগের ১২০ কোটি টাকা আজকের হিসাবে কত, তা নিয়ে নানা মত থাকতে পারে, কিন্তু এক বিপুল পরিমাণ বিত্ত যে ধ্বংস হয়ে গিয়েছিল, সেটা অনস্বীকার্য। সরকার সেই সম্পদের সন্ধান করতে পারেনি। |
কিন্তু ক্ষুদ্র সঞ্চয় থেমে থাকেনি। ডাকঘরে টাকা জমানোর সুযোগ বেড়েছে। পাশাপাশি প্রসার হয়েছে ব্যাঙ্কের। আবার রাষ্ট্রীয় উদ্যোগে ও তত্ত্বাবধানে চলা সঞ্চয় প্রকল্পের পাশাপাশিই বিকল্প আত্মা রূপে থেকে গিয়েছে ক্ষুদ্র সঞ্চয়ের অন্য নানা কারবার। আর আজ? নতুন আর্থিক নীতি এবং নতুন অর্থনীতি, দুইয়ের প্রকোপে ক্ষুদ্র অর্থনীতিপ্রধান অঞ্চলে ব্যাঙ্কশিল্পের প্রসার অনেকাংশে থেমে গিয়েছে। ক্ষুদ্র সঞ্চয়ে ব্যাঙ্কের আগ্রহ কম। ডাক বিভাগের গৌরবও অস্তমিত। সমগ্র দেশ জুড়ে শাসকদের কাছে অর্থনীতি বলতে দাঁড়িয়েছে সংগঠিত অর্থনীতি। অসংগঠিত অর্থনীতি, উদ্যোগ, স্বল্পসঞ্চয়, এগুলি সম্পর্কে শাসকদের মানসিকতা হল কী করে এগুলিকে চাবুক মেরে শায়েস্তা করা যায়, বৃহত্ পুঁজির জালে এদের বাঁধা যায়। তাই কখনও কখনও নজর পড়ে অসংগঠিত ক্ষুদ্র সঞ্চয়ের দিকে। এই নজরের মূল কথা শাসন। যে বিপুল অর্থ এই অসংগঠিত ক্ষুদ্র সঞ্চয়ের পথ ধরে আসছে, তাকে উত্পাদনের পথমুখী করার কোনও পরিকল্পনা তিরিশ বছর আগেও ছিল না, আজও নেই। একটা বড় কারণ, আমাদের অর্থনীতিবিদরা দেশজ অর্থনীতির বৈশিষ্ট্যসমূহকে অবলম্বন করে মূল ভাবনা তখনও করতে শেখেননি, আজও নয়। পুরোটাই পশ্চিমী ধনতান্ত্রিক অর্থশাস্ত্রের বিদ্যাভ্যাসে বাঁধা।
তাই অভিজিত্ বিনায়ক বন্দ্যোপাধ্যায় এবং মৈত্রীশ ঘটকের লেখা (‘ক্ষুদ্র ঋণের বাজারে...’, ১-৫) ভাল লাগল। তাঁরা স্মরণ করিয়ে দিয়েছেন পশ্চিমবঙ্গের অর্থনীতির বৈশিষ্ট্য আর সতর্কবাণী দিয়েছেন, সারদা কাণ্ডের অপরাধীদের সাজা দিতে গিয়ে এবং লগ্নি সংস্থার অনাচার নিয়ে ঢক্কানিনাদে ক্ষুদ্র ঋণের বাজারে ক্ষতি না হয়ে যায়। কিন্তু ধর্মের কথা কে শুনবে?
ক’জন খেয়াল রাখেন, ১৯৯১ সালে এই রাজ্যে একটি ব্যাঙ্ক-শাখা গড়ে ষোলো হাজার মানুষকে পরিষেবা দিত, কুড়ি বছরে সংখ্যাটা মোটামুটি একই থেকে গিয়েছে। অন্যতম উন্নত জেলা বর্ধমানে রাষ্ট্রায়ত্ত বাণিজ্যিক ব্যাঙ্ক অফিসের সংখ্যা ছিল ৩৫৭, ২০১১’য় তা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৪৮৬। অন্য দিকে, পিছিয়ে পড়া পুরুলিয়ায় ১৯৯১’এ সংখ্যাটা ছিল ১১১, ২০১১’য় সমস্ত ব্যাঙ্ক মিলিয়ে সংখ্যাটা বেড়েছে মাত্র ১৩, অর্থাত্ গড়ে বছরে একটাও নয়। অথচ জনসংখ্যা বেড়েছে, ক্ষুদ্র উত্পাদকের সংখ্যা বেড়েছে, প্রশাসনের প্রসার হয়েছে, পঞ্চায়েতি রাজের মাধ্যমে অর্থনীতির বিকেন্দ্রীকরণ হয়েছে। কৃষিজাত এবং অ-কৃষিজাত গ্রামীণ পণ্যের ব্যবসা বেড়েছে। রিজার্ভ ব্যাঙ্কের তথ্যেই আরও জানা যায়, পশ্চিমবঙ্গে এই কুড়ি বছরে ব্যাঙ্ক-শাখা বেড়েছে ১৩৩০টি। তার মধ্যে ৩০০’র বেশি কলকাতায়। বাকিটাও প্রধানত দু’তিনটে জেলায় দার্জিলিং, দুই মেদিনীপুর, দুই চব্বিশ পরগনা।
অন্য দিকে, ক্ষুদ্র সঞ্চয়ের ভাগ্য? পশ্চিমবঙ্গের ক্ষুদ্র সঞ্চয় আধিকারিকের দফতরের তথ্য অনুযায়ী ২০০৫-০৬ সালে ক্ষুদ্র সঞ্চয়ের পরিমাণ ছিল ৯৮৯৫ কোটি টাকা গত কুড়ি বছরে সর্বাধিক। তুলনার জন্য পাশে রাখা যায় ১৯৮০-৮১’র অঙ্কটি: ১৭৪ কোটি টাকা। ২০০৫-০৬’এর পর থেকে প্রাতিষ্ঠানিক ক্ষুদ্র সঞ্চয়ের পরিমাণ কমতে থাকে। তার কারণগুলি ইতিমধ্যেই বহু-আলোচিত, পুনরাবৃত্তির প্রয়োজন নেই। কিন্তু এটুকু মনে রাখা দরকার যে, আমাদের ব্যাঙ্ক এবং অন্যান্য সরকারি ব্যবস্থা এই ক্ষুদ্র সঞ্চয়ের সম্ভাবনার প্রতি যথেষ্ট মনোযোগী হয়নি।
এই অর্থ কিন্তু পশ্চিমবঙ্গের সাধারণ মানুষের, প্রধানত শ্রমজীবী মানুষের জমানো টাকা। এতে কর্পোরেট শিল্পপতি, বিদেশি বহুজাতিক সংস্থা ইত্যাদির অবদান নেই বললেই চলে। এর সুফল রাজ্যবাসী পাবেন, যখন এই অর্থ উদ্ভাবনী অর্থনৈতিক পরিকল্পনায় রাজ্যের পুনর্গঠন ও পুনরুজ্জীবনে কাজে লাগবে। ক্ষুদ্র অর্থনীতির নিজস্ব নিয়মে কিছু ফল হয়তো রাজ্যবাসী ইতিমধ্যেই পাচ্ছেন। কিন্তু পরিকল্পনা চাই, উদ্ভাবনী শক্তি চাই, এই বাস্তবতা সম্পর্কে প্রখর সচেতনতা চাই। পশ্চিমী অর্থনীতির ধ্যানধারণায় বাঁধা পথে আর মাঝে মাঝে পুলিশি অভিযান চালিয়ে এই সঞ্চয়ের সদ্ব্যবহার সম্ভব নয়। যেখানে ব্যাঙ্কের কে ওয়াই সি ফর্ম ভরতে আমানতকারীদের প্রাণ ওষ্ঠাগত, যেখানে ক্ষুদ্র সঞ্চয়ের গতি, অস্থিরতা (এক জন গরিব মেয়ে আজ দশ টাকা বাঁচাবে তো কাল তিরিশ টাকা) এবং আনুষ্ঠানিক রূপ সম্বন্ধে সংগঠিত সঞ্চয় প্রতিষ্ঠানগুলির কোনও ধারণাই নেই, সেখানে শুধু চাবুক চালাও বললে কি কাজ হবে? ঘরের পর ঘর থেকে লক্ষ্মীর ভাণ্ডারে জমানো টাকা এক সপ্তাহ বা এক মাস পরে এই ব্যাঙ্ক-শিল্পের কর্মপদ্ধতিতে একটি সামগ্রিক তহবিলে জমা হবে কী করে? ক্যালকাটা রিসার্চ গ্রুপ-এর একটি সাম্প্রতিক গবেষণায় দেখা গিয়েছে, অভিবাসী শ্রমিকের টাকা নেওয়ার কোনও উপযুক্ত পদ্ধতি ব্যাঙ্ক বা ডাকঘরের জানা নেই। পঞ্জাবে কর্মরত উত্তর বিহারের কৃষি শ্রমিক বা হায়দরাবাদে কর্মরত ওয়ারাঙ্গলের ঠিকা শ্রমিকের সঞ্চিত অর্থ আজও সেই পুরনো সমাজভিত্তিক টাকা পাঠানোর প্রথায় এক স্থান থেকে অন্য স্থানে যায়। ব্যাঙ্কের কাছে এরা এখনও অচ্ছুত।
তাই অর্থনীতির চেনা ছকের বাইরে শাসনরীতি এবং রাজনৈতিক বিচক্ষণতার প্রশ্নও এখানে জড়িত। এটা স্পষ্ট যে, পূর্বতন এবং বর্তমান প্রশাসনের নানা কর্তাব্যক্তি এই অসংগঠিত ক্ষুদ্র সঞ্চয়ের উদ্যোগপতিদের সঙ্গে বিভিন্ন রূপে সম্পর্কিত থেকেছেন। রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দের পক্ষে এই সামাজিক বাস্তব থেকে মুখ ফিরিয়ে থাকা হয়তো সম্ভব হয়নি। তেমনই ছোট শহরে, গ্রামে, মফস্সলে, যেখানে সংগঠিত প্রতিষ্ঠান তুলনায় কম, সেখানে সমাজের বিভিন্ন স্তরের প্রশ্রয়ে, দাক্ষিণ্যে, সাহচর্যে এই সব ব্যবসা বেড়েছে। যা ঘটেছে, সমাজের প্রয়োজন ও প্রশ্রয় ব্যতিরেকে তা সম্ভব হত না।
তাই এক দিকে যেমন শক্ত নিয়মের দরকার আছে, নজরদারির প্রয়োজন আছে, ক্ষুদ্র সঞ্চয়ের সামাজিক নিরাপত্তা নিশ্চিত করার প্রয়োজন আছে, রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দের দুর্নীতিমুক্ত থাকার দরকার আছে, তেমনই ক্ষুদ্র রাজনীতি যার মূল কথা, কে দোষী প্রমাণ করার জন্য দুই রাজনৈতিক শক্তির পারস্পরিক কাদা ছোড়াছুড়ি তার থেকে সরে এসে অন্য ভাবে ভাবার প্রয়োজনহয়ে পড়েছে।
মধ্যযুগের এক ইতালীয় দার্শনিক বলেছিলেন, শাসককে হতে হবে সিংহ এবং শৃগাল, দুইয়েরই মতো। দেশ চালানোর জন্য কঠোর নিয়মের প্রয়োজন, বাধ্যবাধকতা জারির প্রয়োজন, সিংহের মতো শৌর্য ও দৃঢ়তা চাই। তেমনই, ধূর্ততা অর্থাত্ উদ্ভাবনী শক্তি দিয়ে সমস্যার সমাধান করাও চাই। নতুন পথ বার করা চাই। তবেই শাসক সফল হবে, রাজা রাজ্যপাট সামলাতে পারবে।
তাই শুধু রাজনৈতিক প্রতিপক্ষের মহড়া নেওয়ায় মন দিলে সমস্যার সমাধানে, দেশ চালনায় এবং রাজ্যপাট সামলানোয় প্রশাসন নজর দেবে কবে? পরিবর্তনের জন্য সমাজের নানা অংশের সঙ্গে যে ব্যাপক কথোপকথনের প্রয়োজন, তার সময় আসবে কখন? আবার সেই কথোপকথনের জন্য যে উদ্যোগ এবং গ্রহণীয়তা শাসকের থাকা দরকার, তার নৈতিক ও রাজনৈতিক চরিত্র সম্পর্কে শাসক নিজে কবে সচেতন হবেন?
অন্য দিকে, বিরোধী শক্তি, যাঁরা তিরিশ বছরেরও বেশি রাজ্য শাসন করেছেন, তাঁরাও রাজনীতির এই মূলমন্ত্র ভুলে গিয়েছেন। তাঁরা শুধু নির্বাচনের দিকে তাকিয়ে বিতর্কের নম্বর জোগাড়ে ব্যস্ত। সমস্যা সমাধানের জন্য কথোপকথন এবং নতুন ভাবনা কোনও দিকেই নজর নেই।
ক্ষুদ্র রাজনীতিতে শাসকের দৃঢ়তা এবং উদ্ভাবনী ক্ষমতা, দুইয়েরই অভাব ঘটে। ক্ষুদ্র রাজনীতির এই বাস্তবতা পশ্চিমবঙ্গে দলীয় আবর্তের তীব্রতা এবং একই সঙ্গে তার বদ্ধদশার কথা আমাদের মনে করিয়ে দেয়। তবু আশার কথা, মানুষ নতুন ভাবে ভাবছেন, ১৯৮২-৮৩’র দাওয়াই দিয়ে এই সমস্যা সমাধানের কথা ভাবছেন না। এই নতুন ভাবনাই অহল্যার শাপমোচনের ইঙ্গিত। সেই ভবিষ্যত্ আশু না দীর্ঘকাল পরে আসবে, তার চেয়েও বড় কথা, নতুন ভাবে ভাবার কথা উঠে আসছে। |
সমাজতাত্ত্বিক, ক্যালকাটা রিসার্চ গ্রুপ-এর অধিকর্তা
|