শনিবার পাকিস্তানে পার্লামেন্ট নির্বাচন। নানা কারণে এই নির্বাচন ঐতিহাসিক। অথচ রাজনৈতিক দলগুলি
যে যার ক্ষুদ্র স্বার্থ
নিয়ে ব্যস্ত। লিখছেন বিশিষ্ট পাকিস্তান-বিশেষজ্ঞ।
আহমেদ রশিদ |
ক্রমবর্ধমান হিংসা ও হানাহানির মধ্যে ১১ মে অনুষ্ঠিত হচ্ছে পাকিস্তানের পার্লামেন্ট নির্বাচন। এই প্রথম পূর্ণ সময় ক্ষমতায় থাকার পরে একটি নির্বাচিত সরকারের হাত থেকে অন্য নির্বাচিত সরকারের হাতে শাসনক্ষমতা অর্পিত হতে চলেছে। স্বভাবতই এই নির্বাচন নন্দিত হচ্ছে এক নজিরবিহীন ঘটনা রূপে। এটা এমন এক সন্ধিক্ষণ, যা একই সঙ্গে সঙ্কট এবং সুযোগ, উভয়ই ঘনিয়ে তুলছে। অথচ নিষ্প্রভ রাজনীতিকরা ব্যক্তিগত স্বার্থসিদ্ধির চিন্তায় এতই মগ্ন যে, দেশকে রক্ষার কোনও পরিকল্পনা তাঁদের মাথায় নেই।
শুধু এপ্রিল মাসেই ফিদাইন হামলা, গুলিবৃষ্টি এবং মাইন বিস্ফোরণে অন্তত ৭০ জন প্রার্থী বা তাঁদের সমর্থক নিহত হয়েছেন, আহত শ’তিনেক। যে কোনও দিনই আরও গুরুত্বপূর্ণ লক্ষ্যবস্তুতে আততায়ীরা হামলা চালাবে, এই আশঙ্কা অত্যন্ত প্রবল। বহু স্কুলবাড়িতে অবস্থিত ভোটগ্রহণ কেন্দ্রও উড়িয়ে দেওয়ার আশঙ্কা, সেই সঙ্গে ভোটের জন্য প্রস্তুত রাখা সরকারি পরিবহণ ব্যবস্থার উপরেও যে কোনও সময় আক্রমণ হতে পারে। তালিবান ও অন্যান্য গোষ্ঠী গণতন্ত্র ও সামরিক বাহিনীর বিরুদ্ধে প্রকাশ্যে যুদ্ধ ঘোষণা করেছে এবং মূল স্রোতের তিনটি ধর্মনিরপেক্ষ দলকে নিশানা বানিয়েছে। নির্বাচনের পরেও তাই দেশের ভবিষ্যত্ খুব আশাপ্রদ দেখাবে না, যদি না রাজনীতিকরা একটা কার্যকর অভিন্ন কর্মসূচি প্রণয়নে সক্ষম হন। |
তালিবানের সমর্থক? নির্বাচনী সভায় ইমরান খান। লাহৌর, ৫ মে। ছবি: পি টি আই। |
প্রথম কর্মসূচিটাই হতে হবে নিরাপত্তা ব্যবস্থার উন্নতি ঘটিয়ে সন্ত্রাসবাদ রোধের সর্বসম্মত আয়োজন করা। পাক তালিবানরা পিপল্স পার্টি সহ তিনটি দলকে ধর্মনিরপেক্ষ, উদারনৈতিক, সুতরাং নির্মূল করার উপযোগী রূপে শনাক্ত করেছে। অথচ যে দুটি দক্ষিণপন্থী দলকে তারা ছাড় দিয়েছে, নওয়াজ শরিফ ও ইমরান খানের সেই দুই দল কিন্তু এ জন্য তালিবানের নিন্দা করেনি, সহ-রাজনীতিকদের সমর্থনে এগিয়ে আসার উদ্যোগ নেয়নি। ইমরান খান প্রকাশ্যেই তালিবানের প্রতি সহমর্মিতা জানিয়ে থাকেন, আর শরিফ ভান করেন, যেন তালিবান বলে কিছু নেই।
এর ফলে এক শ্রেণির রাজনীতিকরা ক্রমাগত নিহত হচ্ছেন, আর অন্য এক শ্রেণির রাজনীতিকরা অবাধে প্রচার চালিয়ে যাচ্ছেন। প্রচারপর্বে গভীর আঞ্চলিক বিভাজনও লক্ষ করা যাচ্ছে। তালিবান ও পঞ্জাবি উগ্রপন্থী গোষ্ঠীগুলি দেশের বৃহত্তম এবং নওয়াজ শরিফ শাসিত পঞ্জাব প্রদেশকে সন্ত্রাসমুক্ত রেখেছে। কিন্তু সিন্ধু, বালুচিস্তান ও কেপি-র (খাইবার পাখতুনখোয়া) মতো ছোট প্রদেশগুলি পঞ্জাব সম্পর্কে বিরূপ হওয়ার কারণে ব্যাপক হিংসার শিকার হয়ে চলেছে। এখনই সব দল সন্ত্রাসবাদের বিরুদ্ধে একজোট না হলে নির্বাচনের পরেও তালিবান শক্তি বাড়াতে থাকবে এবং তখন শরিফ ও ইমরানের দলকেও নিশানা বানাতে চাইবে।
দ্বিতীয় সমস্যাটি অর্থনীতির। এখন থেকে ভোট শেষে জুন-জুলাইয়ে নতুন সরকার ক্ষমতাসীন হওয়া অবধি পাকিস্তান ক্রমশ দেউলিয়া হতে থাকবে। মাত্র ছশো কোটি মার্কিন ডলার বিদেশি মুদ্রার সঞ্চিত ভাঁড়ার, সামান্য আয় এবং আগের আই এম এফ ঋণ পরিশোধের বিপুল ব্যয়ভার নিয়ে পাকিস্তান আর্থিক বিপর্যয়ে পড়তে পারে। কোনও দলেরই কিন্তু এ সব নিয়ে মাথাব্যথা নেই। কী করে এই সঙ্কট থেকে ত্রাণ পাওয়া যায়, অর্থ, বিদ্যুত্, গ্যাস বা পেট্রোলিয়মের অভাবে বিপন্ন দেশের অর্থনীতিকে গভীর খাদের কিনারা থেকে ফিরিয়ে আনা যায়, কেউ তা ভাবছে না।
সব দলই চরম সুবিধাবাদীর মতো কেবল পশ্চিম দুনিয়াকে, সামরিক জোট নেটোকে, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রকে দোষারোপ করে সস্তা জনপ্রিয়তা পেতে উন্মুখ। অথচ নেতারা ভালই জানেন, এটা যত বেশি করা হবে, ততই তালিবানি জেহাদিদের নৈতিক সুবিধা করে দেওয়া হবে, ক্ষুব্ধ জনসাধারণকে আরও ক্ষুব্ধ করে তোলা হবে, এবং নির্বাচিত নেতারা যখন আবার ভিক্ষাপাত্র হাতে পশ্চিমের দরজায় দাঁড়াবেন, তখন দেশকে বিরাট সমস্যায় পড়তে হবে।
আর একটা গুরুত্বপূর্ণ বিষয় উপেক্ষিত থেকে যাচ্ছে। সেটা হল, নির্বাচনের পর পাকিস্তানের বিদেশ নীতি কী হবে এবং অসামরিক কর্তৃপক্ষের সঙ্গে ফৌজের সম্পর্কই বা কেমন হবে। ভারত, আফগানিস্তান ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মতো গুরুত্বপূর্ণ রাষ্ট্রগুলির সঙ্গে পাকিস্তানের কূটনৈতিক সম্পর্ক এ যাবত্ পাক সামরিক বাহিনীই স্থির করে এসেছে। এই সম্পর্কগুলির প্রতিটিই বর্তমানে তাত্পর্যপূর্ণ এবং মৌলিক পরিবর্তনের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে। কোনও রাজনীতিকই কিন্তু এখনও ইঙ্গিত দেননি, ক্ষমতায় এলে সেনাবাহিনীর সঙ্গে তাঁদের বোঝাপড়া কেমন হবে এবং বিদেশ নীতি নির্ধারণে তাঁরা ফৌজের শরিক হবেন কি না।
কয়েক সপ্তাহ ধরে পাকিস্তান বড় বিপদের মধ্য দিয়ে যেতে চলেছে। একই সঙ্গে বেশ কিছু সুযোগও তার সামনে। সঙ্কট থেকে ত্রাণের জন্য জয়ী ও পরাজিত সব দলকে এবং অবশ্যই সেনাবাহিনীকেও দেশের সামনে উপস্থিত প্রধান চ্যালেঞ্জের মোকাবিলায় ঐক্যবদ্ধ হতে হবে। এটা না পারলে পরবর্তী সরকারও বিদায়ী সরকারের মতোই ব্যর্থতার নিয়তি নিয়েই ক্ষমতাসীন হবে। |
‘পাকিস্তান অন দ্য ব্রিঙ্ক’ গ্রন্থের লেখক |