ছাত্র দিদিমণিকে চুমু খেলেই শিক্ষা-ব্যবস্থার পবিত্রতা নষ্ট এবং ধ্বস্ত? কোন যুক্তিতে? গৌতম চক্রবর্তী |
তিনটি সংলাপে ‘বিপ বিপ’ আওয়াজ ও একটি দৃশ্য বাদ দিয়ে আগামী শুক্রবার মুক্তি পেতে চলেছে মৈনাক ভৌমিকের আসন্ন ‘আমি আর আমার গার্লফ্রেন্ডস’। সিনেমাওয়ালা ও সেন্সরওয়ালাদের ঝগড়া নতুন নয়। এই সব ঘটনা আজকাল গা-সওয়া হয়ে গিয়েছে।
কিন্তু যুক্তিক্রম? ছবিতে শিক্ষক স্বস্তিকা ও তাঁর ছাত্র অনুব্রতর চুমু খাওয়ার দৃশ্য ছিল। রিভিউ কমিটি জানিয়েছেন, দৃশ্যটি কেটে বাদ দিতে হবে। তাঁদের যুক্তি, এর ফলে educational sanctity নষ্ট হবে।
যুক্তিটি ভাবার মতো। স্বস্তিকা যদি শিক্ষক না হয়ে ‘এইতরাজ’ ছবির প্রিয়ঙ্কা চোপড়ার মতো উঁচু মহলের কর্পোরেট কর্মী হতেন, এবং অক্ষয়কুমারের মতো অধস্তনকে চুমু খেতেন? ‘কর্পোরেট স্যাঙ্কটিটি’ নষ্ট করার দায়ে দৃশ্যটি কেটে দেওয়া হত? অক্সফোর্ড অভিধানে ইংরেজি sanctity শব্দটির পাশে saintliness, sacredness ইত্যাদি যা কিছু অর্থ, সবই পূতপবিত্র গোছের ব্যাপার। হতেই হবে। লাতিন ‘sanctus’ বা পবিত্র থেকে শব্দটির উত্পত্তি। |
পবিত্রতা মন্দিরে-মসজিদে-তীর্থস্থানে থাকলেও থাকতে পারে। কিন্তু স্কুল, কলেজে? রুসো থেকে ভলতেয়ার, মায় মিশেল ফুকো অবধি সকলে এই পবিত্রতার বাগাড়ম্বরে চমকে উঠতেন। জেনেভার ছেলে রুসো তাঁর দিদিমণি ফ্রাঁসোয়া লুই দি ওয়ারেনের বাড়িতে থাকতেন। ২০ বছর বয়সী রুসোকে ফ্রাঁসোয়া পরে একই বিছানায়, প্রেমিক হিসাবে গ্রহণ করেছিলেন। আলোকপ্রাপ্তির আর এক উজ্জ্বল ফরাসি দার্শনিক, ভলতেয়ার? তিনিও ‘নিনোঁ দ্য লেনক্লস’-এর অকাদেমির উজ্জ্বল ছাত্র ছিলেন। নিনো ডাকসাইটে সুন্দরী ফরাসি মহিলা, মেয়েদের শরীর ও মন কী ভাবে জয় করতে হয়, সে বিষয়ে প্যারিসে একটি স্কুল খুলেছিলেন। অভিজাত পরিবারের সন্তানরা অনেকেই সেই স্কুলে পাঠ নিতে আসতেন। নিনোর আইনজীবী ফ্রাঁসোয়া আরুয়েতের ছেলেও ওই স্কুলে নাম লিখিয়েছিলেন। সেই ছেলে দিদিমণির মন এতই টেনেছিল, যে মৃত্যুকালে নিনো উইল করে তাকে বই কেনার জন্য তখনকার দিনে দুই হাজার ফ্রাঁ দিয়ে যান। ছেলেটি পরে ভল্তেয়ার নামে বিখ্যাত হয়।
বেস্টসেলার লেখিকা আয়ান র্যান্ডের ‘ফাউন্টেনহেড’ বা ‘অ্যাটলাস শ্রাগ্ড’ এখনও বইয়ের দোকানে পাওয়া যায়। ব্যক্তি-স্বাধীনতা, সুখই ব্যক্তির জীবনের একমাত্র লক্ষ্য ইত্যাদি নিয়ে আয়ান র্যান্ড পঞ্চাশের দশকে ‘অবজেক্টিভিজ্ম’ নামে এক দর্শন চালু করেছিলেন, বিশ্ববিদ্যালয়ে তা পড়ানো হত। ন্যাথানিয়েল ব্র্যান্ডেন ও তাঁর স্ত্রী বারবারা লেখিকার কাছে সেই দর্শন অধ্যয়ন করতে যেতেন। পরে আয়ান র্যান্ড প্রেমে হাবুডুবু খেয়ে ছাত্র ন্যাথানিয়েলকে বিয়ে করেন, দুজনে মিলে ‘ন্যাথানিয়েল ব্র্যান্ডেন ইনস্টিটিউট’ নামে একটি প্রতিষ্ঠান তৈরি করেন।
সিনেমায় শিক্ষকের সঙ্গে ছাত্রীর প্রেম দেখালে অসুবিধা নেই, কিন্তু শিক্ষিকা-ছাত্র হলেই পবিত্রতা, বৈধতা ইত্যাদির আশ্রয় নিতে হবে? এখানেই সেন্সর, রিভিউ কমিটি, রাষ্ট্রের পুরুষতান্ত্রিক বজ্জাতি। রাষ্ট্র মনে করে, পেশাদার মহিলা হবেন যৌনতাহীন, নির্বিকল্প। পুরুষের সাত খুন মাফ।
কোন ছেলের হৃদয়ে কোনও-না-কোনও বিশেষ দিদিমণির প্রতি ‘ইনফ্যাচুয়েশন’ তৈরি হয়নি? অআকখ, অঙ্ক শেখার পাশাপাশি সেই মানুষের বিভিন্ন পর্যায়ে যৌন চেতনার উন্মেষ হবে, সেটাকে সামাজিক বিধিনিষেধ মেনে চাপা দিতে শিখবে এটাই তো স্বাভাবিক। আধুনিক বাঙালি চেতনার গন্ডগোল এখানেই। স্বাভাবিকতাকে অস্বীকার করে পবিত্রতার আশ্রয় খোঁজা।
অথচ, চল্লিশ বছর আগেও এই সব sanctity বা purity জাতীয় শব্দকে আলোকপ্রাপ্ত বাঙালি হেলায় তছনছ করেছে। সমরেশ বসুর ‘প্রজাপতি’ উপন্যাস নিয়ে অশ্লীলতার মামলা, সাক্ষ্য দিতে এসেছেন বুদ্ধদেব বসু। বিচারকের জিজ্ঞাসা, ‘বইটি খাঁটি সাহিত্য? পিওর লিটারেচার? আপনার কী মত?’ তুলনামূলক সাহিত্যের অধ্যাপকের সাফ জবাব, ‘ইওর অনার, পিওরিটি রসায়নশাস্ত্রের শব্দ। সাহিত্যের সঙ্গে ওর কোনও সম্পর্ক নেই।’
শিক্ষাঙ্গনের সঙ্গেও পবিত্রতা বস্তুটি সে রকমই সম্পর্করহিত। |