সত্যম আর্থিক কেলেঙ্কারির তদন্তের ধাঁচেই সারদা গোষ্ঠীর সম্পত্তির হদিস পেতে চাইছে পুলিশ।
২০০০-এ তথ্যপ্রযুক্তি সংস্থা ‘সত্যম কম্পিউটার সার্ভিসেস’-এর আর্থিক তছরুপের তদন্তে সিবিআই একটি বিশেষ প্রযুক্তির সাহায্য নিয়েছিল। গোয়েন্দাদের ভাষায়, তার নাম ‘ফরেন্সিক অডিট’। সারদার তদন্তেও সেই প্রযুক্তি ব্যবহার করতে চায় বিধাননগর পুলিশ। এ নিয়ে সোমবার বৈঠকে বসেন তদন্তকারীরা। এক গোয়েন্দাকর্তা জানান, সেই বৈঠকে সত্যম কেলেঙ্কারির ‘ফরেন্সিক অডিট’ দলের বিশেষজ্ঞরাও ছিলেন। হাজির ছিলেন বিশেষ তদন্তকারী দলের সদস্য (সিট) রাজেশ যাদবও।
কী এই ফরেন্সিক অডিট? সিবিআইয়ের কেন্দ্রীয় ফরেন্সিক ল্যাবরেটরির ভারপ্রাপ্ত বিজ্ঞানী চন্দ্রনাথ ভট্টাচার্য জানান, আর্থিক দুর্নীতির তদন্তে এটি নতুন পন্থা। কোনও সংস্থার হিসেবে কী কারচুপি রয়েছে বা কোন ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্টে কী ভাবে লেনদেনের হিসেব দেখানো হয়েছে, তা বুঝতে এই প্রযুক্তি ব্যবহার করা হয়। এই ধরনের বিশেষজ্ঞ দলে যেমন চাটার্ড অ্যাকাউন্ট্যান্টরা থাকেন, তেমনই কম্পিউটার ইঞ্জিনিয়ারদেরও রাখা হয়। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এখন যেহেতু হিসেবের জন্য সংস্থাগুলি নিজস্ব সফট্ওয়্যার ব্যবহার করে, তাই সংশ্লিষ্ট কম্পিউটার ও সফট্ওয়্যারের কারচুপি ধরতে ইঞ্জিনিয়ার প্রয়োজন হয়।
সারদা কাণ্ডের তদন্তে প্রথম থেকেই সংস্থার আয়-ব্যয় ও সম্পত্তির হিসেব নিয়ে নাজেহাল তদন্তকারীরা। প্রচুর নথিপত্র ঘেঁটে টাকার হিসেব বার করতে গিয়ে হিমসিম খাচ্ছেন গোয়েন্দারা। এক তদন্তকারী অফিসার বলেন, “কয়েক হাজার কোটি টাকার চুলচেরা হিসেব বার করা পুলিশের কাজ নয়। তাই বিশেষজ্ঞদের সাহায্য নেওয়া হচ্ছে।” তবে সত্যম কেলেঙ্কারির তদন্তের ভারপ্রাপ্ত সংস্থার বিশেষজ্ঞদের এ ক্ষেত্রে কাজে লাগানো হবে কি না, তা এখনও নিশ্চিত নয়। একটি সূত্র জানাচ্ছে, ‘সত্যম’-এর ফরেন্সিক অডিট যে সংস্থা করেছিল, তারা প্রায় ৩০ কোটি টাকা নিয়েছিল। সারদা কাণ্ডের ক্ষেত্রে এ রাজ্যের পুলিশ কতটা খরচ করতে পারবে, তা নিয়ে সন্দেহ রয়েছে।
তা হলে কী ভাবে বিশেষজ্ঞদের নিয়োগ করা হবে? বিধাননগরের এক গোয়েন্দাকর্তা জানান, ফরেন্সিক অডিটের জন্য টেন্ডার ডাকা হবে। তার মাধ্যমেই নির্বাচন করা হবে ফরেন্সিক অডিটকারী সদস্যদের। তবে এমন কাজের উপযুক্ত বেশি সংস্থা নেই বলেই কর্তার দাবি। পুলিশ সূত্রের খবর, কোন সংস্থাকে নিয়োগ করা যেতে পারে, বৈঠকে তা নিয়েও বিশেষজ্ঞদের সঙ্গে কথা হয়েছে।
সারদা গোষ্ঠীর কয়েক জন সন্দেহজনক কর্মীর হদিস পেয়েছে পুলিশ। জানা গিয়েছে, ওই কর্মীরা বেতন পেলেও কাজ করতেন না। বিষয়টি খতিয়ে দেখতে সংস্থার মানবসম্পদ বিভাগের তথ্য দেখছেন তদন্তকারীরা। পুলিশ সূত্রের খবর, এ বিষয়ে হিডকোর প্রাক্তন জনসংযোগ আধিকারিক অঞ্জন ভট্টাচার্যকে এ দিন পুনরায় জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়।
তদন্ত করা হচ্ছে সারদার প্রশাসনিক-রাজনৈতিক যোগাযোগ নিয়েও। এক গোয়েন্দাকর্তার দাবি, “সিবিআইকে লেখা চিঠিটি সম্ভবত সুদীপ্তবাবু লেখেননি। ওই ধরনের বয়ান লিখতে গেলে আইন-কানুন সম্পর্কে যথেষ্ট ওয়াকিবহাল হতে হয়।” ঘটনাচক্রে, সারদার সঙ্গে কয়েক জন প্রাক্তন পুলিশকর্তার যোগাযোগের কথা ইতিমধ্যেই জানতে পেরেছে পুলিশ। তাঁদেরই এক জন চিঠিটির বয়ান লিখে দিয়েছিলেন বলে তদন্তকারীদের দাবি।
জেরায় সুদীপ্ত সেন যে রাজনৈতিক নেতা-মন্ত্রীদের নাম করে টাকা দেওয়ার দাবি করেছেন, তা কতখানি ঠিক তা-ও খতিয়ে দেখছে পুলিশ। সারদার মিডল্যান্ড পার্কের অফিসের এক কর্মীকে জেরা করে রাজ্যের শাসক দলের কিছু নেতার নাম পেয়েছেন তদন্তকারীরা। ওই নেতারা গভীর রাতে মিডল্যান্ড পার্কের অফিসে যেতেন বলে ওই কর্মী পুলিশকে জানিয়েছেন। পুলিশ সূত্রের খবর, রাজ্য ছেড়ে পালানোর আগে সুদীপ্ত কয়েক জন নেতা-মন্ত্রীর সঙ্গে বৈঠক করেছিলেন।
রবিবার রাতে জেরার সময় সেই নেতাদের বিরুদ্ধে ক্ষোভ উগরে দিয়েছেন সারদা কর্তা। পুলিশের দাবি, নানা সময়ে সুবিধা নিলেও বিপদে ওই নেতারা তাঁর পাশে দাঁড়াননি বলে সারদা কর্তা জানিয়েছেন। পুলিশ সূত্রের খবর, জেরার মুখে ক্রমশ ভেঙে পড়ছেন সারদা কর্তা। গত দিন কয়েক ধরে নিয়মিত স্নান-খাওয়াও করতে চাইছেন না তিনি। এ দিকে, এ দিনই সারদার অফিসগুলিতে নিরাপত্তার দায়িত্বে থাকা সংস্থার পক্ষ থেকে বিধাননগর আদালতে একটি মামলা দায়ের করা হয়েছে। ওই নিরাপত্তা সংস্থার পক্ষ থেকে আদালতে জানানো হয়েছে, সারদা গোষ্ঠীতে ৯৮ জন নিরাপত্তারক্ষী কাজ করতেন।
|