সময় আসছে হিসেব-নিকেশ বুঝে নেওয়ার! প্রাক্তনকে হুঁশিয়ারি দিলেন বর্তমান।
যে ভাবে বর্তমান রাজ্য সরকার নিয়ম-নীতি না মেনে একের পর এক কাজ করে চলেছে, যে ভাবে বিরোধী দলের কার্যালয়ে ভাঙচুর হচ্ছে, যে ভাবে বিরোধী দলের নেতা-কর্মীদের মিথ্যা অভিযোগে হয়রান করা হচ্ছে, যে ভাবে রাজ্য জুড়ে টাকা নয়ছয় এবং সমাজবিরোধীদের দাপট চলছে এ সবের বিরুদ্ধেই এ বার রুখে দাঁড়ানোর ডাক শোনা গেল প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যের গলায়। উত্তর ২৪ পরগনার শ্যামনগরে রবিবার দলীয় সভা থেকে সিপিএমের এই পলিটব্যুরো সদস্যের হুঁশিয়ারি, “কত দিন মাথা নিচু করে মানব? কেন মানব? যাঁরা প্রশাসনে আছেন, সরকারে আছেন, জেনে নিন, সময় আসছে হিসেব-নিকেশ বুঝে নিতে হবে আমাদের! এ সব চলতে পারে না! অবস্থা পাল্টাতে হবে।”
রাজ্যে শিল্পায়নের করুণ দশা, ছেলেমেয়েদের চাকরির অভাব, কৃষকের সঙ্কটের প্রশ্নে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সরকারকে বেশ কিছু দিন ধরেই আক্রমণ করে আসছেন বুদ্ধবাবু। কিন্তু এ দিন যে ভাবে ‘বুঝে নেওয়া’র হুঁশিয়ারি দিয়েছেন তিনি, তাতে অদূর ভবিষ্যতে সরকার-বিরোধী আন্দোলনে সিপিএমের তীব্রতা বাড়ানোরই ইঙ্গিত মিলছে। বস্তুত, সারদা-কাণ্ডকে সামনে রেখে সরাসরি মুখ্যমন্ত্রীকে এ দিন যে সুরে পাল্টা আক্রমণ করেছেন তাঁর পূর্বসূরি, তা-ও যথেষ্ট বিরল। বর্তমান মুখ্যমন্ত্রী মিথ্যা বলাকে অভ্যাসে পরিণত করে ফেলেছেন বলে অভিযোগ করেছেন প্রাক্তন। বর্তমানের ভাষা শুনলে তাঁর শরীর খারাপ লাগে বলেও মন্তব্য করেছেন প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী!
প্রত্যাশিত ভাবেই, বুদ্ধবাবুর এমন আক্রমণের পত্রপাঠ কড়া জবাব এসেছে শাসক দলের তরফে। তৃণমূলের মহাসচিব তথা রাজ্যের শিল্পমন্ত্রী পার্থ চট্টোপাধ্যায়ের প্রতিক্রিয়া, “ব্রিগেডে আস্তিন গুটিয়ে উনি বলেছিলেন, মাথা ভেঙে দেব! বিধানসভায় বলেছিলেন, সব শেষ করে দেব! তাঁর ওই সব হুঁশিয়ারি থেকেই রক্তাক্ত হয়েছিল বাংলা। তাঁদের জামায় রক্তের দাগ দেখেই সিপিএমকে পরিত্যাগ করেছিল বাংলার মানুষ। দেখা যাচ্ছে, অতীত থেকে কোনও শিক্ষা হয়নি! আয়নায় নিজেদের মুখ দেখে তার পরে মানুষের কাছে যান!” |
শ্যামনগরের সভায় বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য। —নিজস্ব চিত্র |
দীর্ঘদিন অন্তরালে থাকার পরে প্রথম জনসমক্ষে এসে এক টিভি সাক্ষাৎকারে প্রথম তৃণমূল নেত্রীর সততার ভাবমূর্তিকে চ্যালেঞ্জ করেছিলেন বুদ্ধবাবু। সারদা কাণ্ডের পরেও সেই ধারা অব্যাহত রাখেন তিনি। যার জেরে পরের জনসভায় মুখ্যমন্ত্রী থাকাকালীন বুদ্ধবাবুর সঙ্গে অর্থলগ্নি সংস্থার কর্ণধারদের ছবি দেখিয়ে পাল্টা প্রচারে যান মমতা। সেই প্রচারের জবাব আবার এ দিন শ্যামনগরের অন্নপূর্ণা মাঠে দিয়েছেন বুদ্ধবাবু। বলেছেন, “নিজেদের অপরাধ সামনে আসতেই এখন আমি চোর, আমরা চোর বলে হইচই শুরু করেছেন! আমার ছবি দেখাচ্ছেন। ভাল করে দেখান! ছবি দেখিয়ে কী প্রমাণ করতে চাইছেন? আমি চিট ফান্ডের থেকে টাকা নিয়েছি, আমার পরিবারের লোক নিয়েছে, কাউকে কোনও সংস্থার মাথায় বসিয়েছি, দলের কাউকে সুবিধা পাইয়ে দিয়েছি একটা বার করতে পারবেন? দুর্নীতিগ্রস্ত দল একটা!”
বস্তুত, ছবি-প্রচার নিয়ে বুদ্ধবাবুর যুক্তির সঙ্গে একমত তৃণমূলের একটি বড় অংশই। প্রকাশ্যে না বললেও তাঁরা মানছেন, জনপ্রতিনিধিরা কে কোন অনুষ্ঠানে গিয়েছেন, সেই ছবি দেখিয়ে কোনও সিদ্ধান্তে পৌঁছনো যায় না। রাজনৈতিক নেতারা ওই সংস্থার দ্বারা উপকৃত কি না, সেটাই বিবেচ্য হওয়া উচিত। প্রকাশ্যে তৃণমূল নেতারা অবশ্য বুদ্ধবাবুর সমালোচনাই করছেন। পার্থবাবু যেমন বলেছেন, “বুদ্ধবাবু নিজেকে সৎ বলে মনে করেন। মৌলালি থেকে মাদার হাউস পর্যন্ত রাস্তার ধারে একটা বাড়িও তো বাদ নেই। এ সব কি কৌটো নাড়িয়ে হয়েছে? জনসভায় আঁকুপাঁকু না-করে বুদ্ধবাবু এ সব প্রশ্নের জবাব দিন!” আবার বুদ্ধবাবুর সভা-মঞ্চ থেকেই সিপিএমের উত্তর ২৪ পরগনা জেলা সম্পাদক গৌতম দেব জানিয়ে দিয়েছেন, মমতার অভিযোগের জবাবে শ্যামবাজারে সভা করে তাঁরা দেখিয়ে দেবেন তৃণমূলের মুখপত্র অর্থলগ্নি সংস্থা থেকে কী ভাবে বিজ্ঞাপন নিয়েছিল! তাঁর বিরুদ্ধে ওঠা অভিযোগের প্রত্যুত্তরে বুদ্ধবাবু এ দিন আক্রমণ এগিয়ে নিয়ে গিয়েছেন বেশ কয়েক ধাপ। বলেছেন, “পয়লা বৈশাখের আগে কিছু জানতাম না বলছেন! আদালতে হলফনামায় ধরা পড়ে গেল সব। মিথ্যা কথা বলাটা অভ্যাস! তাঁর দলের লোক ওই কোম্পানির সংবাদমাধ্যমের মাথায় আছেন, জানতেন না? তাঁর দলের লোক ব্র্যান্ড অ্যাম্বাসাডর (সারদা), জানতেন না? ওদের কাছ থেকে দলের কারা মাসোহারা পেত, জানতেন না?” সত্য উদ্ঘাটনের জন্য সিবিআই তদন্তের পক্ষেও সওয়াল করেন বুদ্ধবাবু। বলেছেন, “সিবিআই আসুক না! দেখা যাবে, আমাদের দল আর ওই দল কোথায় দাঁড়িয়ে! সততা দেখাচ্ছেন?”
জবাবে পার্থবাবুর পাল্টা প্রশ্ন, “রাজ্যকে কেন্দ্রীয় সরকারের উপনিবেশ বানাতে দেব না যারা বলত, সেই সিপিএম কি পুরনো স্লোগান ভুলে গেল? সিবিআইয়ের হাত ধরে কেন্দ্র যাতে রাজ্যের ঘাড়ে চাপে, উনি সেই ব্যবস্থা করতে চাইছেন? এতই যদি সিবিআইয়ে ভরসা, নন্দীগ্রাম-নেতাইয়ের পরে কেন সিবিআই তদন্তের দাবি মানেননি?” আক্রমণের সুর চড়াতে গিয়ে প্রাক্তন এ দিন বর্তমান মুখ্যমন্ত্রীর শ্যামবাজার ও পানিহাটির সভার দৃষ্টান্ত টেনেছেন। তীব্র কটাক্ষে বলেছেন, “আমাকে কেউ কেউ দেখতে বলেছিলেন। দেখলাম। চলছে তো চলছেই! টেলিভিশন খুললে শরীর খারাপ হয়ে যায়!” কেন? বুদ্ধবাবুর কথায়, “কী ভাষা! এটা মুখ্যমন্ত্রীর ভাষা? চমকে লাভ নেই! ওভার বাউন্ডারি মারব! ঘেষঁতে দাওনি তো কি ঘষতে দিয়েছো? ঘষে দেওয়া মানে কী? এক জন মহিলা, তার উপরে মুখ্যমন্ত্রী। গা-বমি করে। শরীর খারাপ লাগে, সত্যি বলছি! আমাদের অভিশাপ, এ সব শুনতে হচ্ছে!” প্রাক্তনের অভিযোগ, লুম্পেন আর সমাজবিরোধীতে ভরে গিয়েছে বর্তমান শাসক দল এবং সরকার। তাদের ভাষাই শোনা যাচ্ছে!
প্রাক্তনের এ দিনের চড়া সুরের পরে পরিস্থিতি যা দাঁড়িয়েছে, ফের বর্তমানের পাল্টা ময়দানে নামার সম্ভাবনা যথেষ্ট! যে পরিস্থিতির কথা এ দিন উত্তর ২৪ পরগনারই মধ্যমগ্রামে কটাক্ষের সুরে ধরিয়ে দিয়েছেন বিরোধী দলনেতা সূর্যকান্ত মিশ্র “তৃণমূল খালি আমাদের নকল করে। সোনার একটা নকল হয় ‘ইমিটেশন’। পাঁচ বছর পরে ধরা পড়ে যায়, কোনটা সোনা আর কোনটা ইমিটেশন!”
|