রাজ্য ছেড়ে পালানোর আগে কয়েক জন রাজনৈতিক নেতার কাছে সাহায্য চেয়েছিলেন সারদা-কর্তা সুদীপ্ত সেন। জেরায় তাঁর মুখে এ কথা জানার পরে তদন্তকারীদের প্রাথমিক ধারণা, ওই নেতাদের কাছে নিরাপদ আশ্রয় না-পেয়েই সুদীপ্তকে রাজ্য ছাড়তে হয়। যদিও তাঁরা কে কোন দলের, তা নিয়ে পুলিশ মুখ খুলতে চায়নি।
গত ৬ এপ্রিল সুদীপ্ত সিবিআই-কে একটি চিঠি পাঠিয়েছিলেন। তাতে সারদা গোষ্ঠীর পতনের জন্য কয়েক জনকে দায়ী করেন তিনি। পুলিশের দাবি: চিঠিটি লেখার আগে তিনি ওই নেতাদের কাছে আশ্রয় চেয়েছিলেন। তাঁদের সঙ্গে গোপনে বৈঠকও করেন সারদা-কর্ণধার। তদন্তকারীদের অনুমান, বৈঠক ব্যর্থ হওয়ার পরেই সিবিআই-কে চিঠি লিখে সারদা-কর্তা গা ঢাকা দেন। পুলিশের দাবি: জেরায় এ-ও উঠে এসেছে যে, দীর্ঘ দিন ধরে নিজের স্বার্থসিদ্ধির লক্ষ্যে একটি রাজনৈতিক গোষ্ঠী (পলিটিক্যাল লবি) তৈরি করেছিলেন সুদীপ্ত। উল্লিখিত নেতারা সেই ‘লবি’র সদস্য কি না, তা খতিয়ে দেখা হচ্ছে। বিভিন্ন দলের ছোট মাপের নেতাদের সঙ্গেও সুদীপ্ত ঘনিষ্ঠ যোগাযোগ গড়ে তুলেছিলেন বলে তদন্তের ইঙ্গিত। এই সূত্রে প্রাক্তন অর্থমন্ত্রীর অসীমবাবুর আপ্ত-সহায়ক গণেশ দে-কে জিজ্ঞাসাবাদ করা হচ্ছে। এমন আরও ছ’জনের নাম মিলেছে বলে পুলিশ জানিয়েছে।
এই রাজনৈতিক যোগসূত্রের পাশাপাশি সারদার সম্পত্তির হিসেব-নিকেশ নিয়েও পুলিশ ধাঁধায়। সুদীপ্তকে গ্রেফতার করার পরে বারো দিন অতিক্রান্ত। এখনও সারদা গোষ্ঠীর বিপুল সম্পত্তির পুরো হদিস মেলেনি। তদন্তকারীদের দাবি: সাম্রাজ্য তাসের ঘরের মতো ভেঙে পড়ছে টের পেয়েই আমানতকারীদের টাকা অন্যত্র সরিয়ে ফেলেছিলেন সারদা-কর্তা। কিন্তু কোন পথে, কোথায় ও কী ভাবে, তা গোয়েন্দারা এখনও বুঝে উঠতে পারেননি। গোয়েন্দা-সূত্রের খবর: বেশ ক’টি অ্যাকাউন্টে কোনও টাকা মেলেনি। সেগুলির কয়েকটি খোলার পরে ব্যবহারও করা হয়নি। উপরন্তু অধিকাংশ অ্যাকাউন্টে লেনদেন হয়েছে নেট-ব্যাঙ্কিং মারফত। ফলে সে সংক্রান্ত তথ্য পেতে গোয়েন্দাদের বিস্তর কাঠ-খড় পোড়াতে হচ্ছে।
তদন্তকারীরা জানাচ্ছেন, সারদা-সম্পত্তির হদিস পেতে তাঁরা খানিকটা ভরসা করেছিলেন সংস্থাটির কিছু পদস্থ কর্মীর উপরেও, গোড়ায় যাঁরা বিভিন্ন তথ্য দিয়ে সাহায্য করছিলেন। কিন্তু ইদানীং ওঁদের দেওয়া তথ্য বিশেষ কাজে আসছে না বলে খবর। এমনকী, সুদীপ্তের ছায়াসঙ্গী দেবযানী মুখোপাধ্যায়ের জোগানো তথ্যও নয়। এই পরিস্থিতিতে গোয়েন্দাদের দাবি, সম্পত্তির হদিস দিতে পারেন একমাত্র সুদীপ্তই। পুলিশ সূত্রের খবর: জীবন বিমা নিগমে সুদীপ্তের একটি পলিসি-র হদিস মিলেছে। অন্যান্য বিমা সংস্থায় তাঁর কোনও বিনিয়োগ আছে কি না, যাচাই করতে হায়দরাবাদের ইনস্যুরেন্স রেগুলেটরি অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট অথরিটি-র সঙ্গে যোগাযোগ করা হচ্ছে বলে জানিয়েছেন বিধাননগর কমিশনারেটের এক পুলিশ-কর্তা।
গোয়েন্দা-সূত্রের খবর: বিভিন্ন জেলা ও মহকুমা সদরে প্রচুর জমি কেনা ছিল সারদার। সেগুলো দেখিয়েই লোকের কাছ থেকে টাকা তোলা হতো। কিন্তু অধিকাংশ ক্ষেত্রে ওই সব জমিতে কোনও কাজ হয়নি। বনগাঁ, কাঁথি, মালদহেও এমন জমি
রয়েছে। “এ পর্যন্ত সারদার এমন শ’দুয়েক জমি-সম্পত্তির হদিস মিলেছে, যার দাম অন্তত ৩৫ কোটি টাকা। অনেক জমির রেজিস্ট্রেশন ও মিউটেশনও করা হয়নি।” মন্তব্য এক গোয়েন্দা-কর্তার।
তদন্তকারী-সূত্রের খবর: জেলার দায়িত্বে থাকা সারদার কয়েক জন এজেন্ট ও পদস্থ কর্মীর খোঁজ চলছে। পুলিশের দাবি, জেরায় সুদীপ্তবাবু এমন কয়েক জনের নামে ক্ষোভ উগরে দিয়েছেন এবং তাঁদের সম্পর্কে বিস্তারিত তথ্য-ও দিয়েছেন। এই সূত্রে উত্তর ২৪ পরগনার দায়িত্বপ্রাপ্ত এক কর্মীকে জিজ্ঞাসাবাদ করা হবে। খোঁজ চলছে ফেরার এক জেনারেল ম্যানেজারেরও। এ ক্ষেত্রে অবশ্য সারদা কর্তা যথেষ্ট সাহায্য করছেন বলে পুলিশ জানিয়েছে। বারুইপুরে সারদা গোষ্ঠীর এক এজেন্টের বাড়িতে এ দিন তল্লাশি চালায় পুলিশ। বেশ কিছু নথিপত্র বাজেয়াপ্ত করা হয়। এজেন্টের সন্ধান মেলেনি। পুলিশ সূত্রের খবর, সারদা গোষ্ঠীর পতনের পিছনে ওই এজেন্ট অন্যতম দায়ী বলে সুদীপ্ত জেরায় জানিয়েছিলেন।
সারদা-সম্পত্তির খোঁজে শনিবার রাতেও সল্টলেকের বিভিন্ন জায়গায় তল্লাশি চলেছে। পাশাপাশি শনিবার বিশেষ তদন্তকারী দলের (সিট) বৈঠকে স্থির হয়েছে, জেলায় সারদা গোষ্ঠীর সম্পত্তিগুলি সংশ্লিষ্ট জেলা পুলিশই বাজেয়াপ্ত করবে। সম্পত্তির হদিস পেতে জনসাধারণেরও সাহায্য নেবে পুলিশ। রবিবার বিধাননগরের গোয়েন্দা-কর্তা অর্ণব ঘোষ জানিয়েছেন, আদালতের অনুমতি নিয়ে সম্পত্তির তালিকা পশ্চিমবঙ্গ পুলিশের ওয়েবসাইটে দেওয়া হবে। এর বাইরে কোনও সম্পত্তির কথা জানা থাকলে সাধারণ মানুষ পুলিশকে সে তথ্য দিতে পারবেন বলেও অর্ণববাবুর দাবি।
গত বারো দিনে দফায় দফায় জেরার জেরে সুদীপ্ত কিছুটা ভেঙে পড়েছেন বলে জানিয়েছে পুলিশের একটি সূত্র। দিন দু’য়েক ধরে লক-আপে কান্নাকাটিও করেছেন তিনি। তদন্তকারীদের ধারণা, দুঃসময়ে পরিচিত-পরিজনদের অভাবই তাঁকে মানসিক ভাবে আরও বিধ্বস্ত করে দিয়েছে। বিশেষত, দেবযানীর সঙ্গে তাঁর পরিজন ও আইনজীবীরা দেখা করতে এলেও সুদীপ্তবাবুর কাছে তেমন কেউ আসছেন না। তবে তদন্তকারীদের একাংশের মতে, সুদীপ্তের এই মানসিক অবস্থা এক দিকে তাঁদের সাহায্যই করছে। এক অফিসারের কথায়, “আবেগের বশে অনেক সময়ে অনেকের সম্পর্কে অনেক তথ্য উগরে দিচ্ছেন সারদা-কর্তা।”
এ দিনও সন্ধ্যায় বিধাননগরের পুলিশ কমিশনার রাজীব কুমার ও গোয়েন্দা-প্রধান অর্ণব ঘোষ নিউটাউন থানায় গিয়ে দেবযানী ও সুদীপ্তকে আলাদা আলাদা ভাবে জেরা করেন। আজ সোমবার সল্টলেকের শ্যামল সেনের নেতৃত্বাধীন তদন্ত কমিশনের অফিসে অভিযোগ জমা নেওয়া শুরু হবে। উত্তর ২৪ পরগনার জেলাশাসক ও বিধাননগরের পুলিশ-কর্তারা গোটা এলাকা পরিদর্শন করেছেন। মোতায়েন করা হয়েছে বিশেষ পুলিশবাহিনী। অভিযোগ নেওয়ার জন্য জনা চল্লিশ কর্মী থাকবেন। |