এর আগে শুভেন্দু অধিকারী, মদন মিত্রেরা বলেছিলেন। এ বার আবেদন শোনা গেল স্বয়ং মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের গলায়। সারদা-কাণ্ডের পরে ওই ধরনের অর্থলগ্নি সংস্থায় আর টাকা না রাখার আর্জি জানালেন রাজ্যের প্রশাসনিক প্রধান।
উত্তর ২৪ পরগনার পানিহাটিতে শনিবার সন্ধ্যায় দলীয় জনসভার মঞ্চ থেকে মমতা বলেছেন, “আর চিট ফান্ডে টাকা রাখবেন না। যা হয়েছে, অনেক হয়েছে! আমরা বিল পাশ করেছি। কেউ সমস্যায় পড়লে অভিযোগ করুন, ব্যবস্থা নেব।”
একই সঙ্গে মুখ্যমন্ত্রীর হুঁশিয়ারি, “আপনারা জেগে ঘুমোবেন না! আপনাদের পাহারাদার আমি আছি!” যা শুনে সিপিএমের এক রাজ্য নেতার কটাক্ষ, “আগে বলেছিলেন, যা গেছে, তা গেছে! এখন বলছেন, যা হয়েছে, অনেক হয়েছে! উনিই কি জেগে ঘুমোচ্ছিলেন এত দিন?”
মুখ্যমন্ত্রী অবশ্য এ দিনও দাবি করেছেন, ১লা বৈশাখের আগে তিনি সারদার বিষয়ে কিছু জানতেন না। যদিও শুক্রবারই কলকাতা হাইকোর্টে রাজ্য সরকারের জমা দেওয়া হলফনামা অন্য কথা বলছে! তার ২৪ ঘণ্টার মধ্যে মুখ্যমন্ত্রী বরং আরও এক ধাপ এগিয়ে বোঝানোর চেষ্টা করেছেন, পরে জানলেও তাঁর সক্রিয়তার জন্যই আরও বড় ক্ষতি থেকে রেহাই পেয়েছেন মানুষ। তাঁর কথায়, “আমি চেয়ারে আছি বলে মানুষ জানতে পারল। বেঁচে গেল! আরও টাকা কোথায় যে যেত!”
পানিহাটির যে অমরাবতী মাঠে গত রবিবার সিপিএমের সভা থেকে মুখ্যমন্ত্রীর ‘সততা’র ভাবমূর্তিকে আক্রমণ করেছিলেন প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য এবং গৌতম দেব, এ দিন সেই মাঠেই পাল্টা সমাবেশ করে সিপিএমের ঘরেই আক্রমণ ফিরিয়ে দিয়েছেন তৃণমূল নেত্রী। যা বলেছেন, বেশির ভাগই শ্যামবাজারে দু’দিন আগের বক্তব্যের পুনরাবৃত্তি। এবং সেই সঙ্গে শুক্রবার দলের সাধারণ পরিষদের বৈঠকে যা বলেছিলেন, সেই বার্তাই এ দিন প্রকাশ্যে নিয়ে এসেছেন। বলেছেন, “মমতা চোর, তার পরিবার চোর, মুকুল চোর, তৃণমূল চোর, তাদের গুষ্টি চোর! আর তুমি (সিপিএম) সাধু!”
তৃণমূল নেত্রীর এই পাল্টা আক্রমণের কৌশল দেখে সিপিএমের কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য গৌতমবাবু প্রশ্ন তুলেছেন, “কেউ কি মমতাকে চোর বলেছে? উনি নিজেই বলছেন! আসলে সিবিআই তদন্তকে ভয় পাচ্ছেন। সুদীপ্ত সেনের চিঠিতে যে ২২ জনের নাম আছে, তাদের ধরা হচ্ছে না কেন?”
গৌতমবাবু যা প্রকাশ্যে বলছেন, দলের অন্দরে প্রায় একই রকম প্রশ্ন তুলছেন তৃণমূল নেতৃত্বের একাংশও। তৃণমূল নেত্রী এক দিকে বলছেন, দলের পতাকার অসম্মান যাঁরা করবেন, তাঁদের বরদাস্ত করবেন না। আবার ‘মুকুল চোর, আমি চোর’ বলে এমন মন্তব্য করছেন, যাতে সারদা-কাণ্ডে অভিযুক্তদের আড়াল করার চেষ্টাই প্রকট হয়ে যাচ্ছে বলে দলের একাংশের মত! দলের কিছু প্রথম সারির নেতার প্রশ্ন, পাল্টা আক্রমণে নেমে এত স্ব-বিরোধিতা কেন থাকবে? তৃণমূলের এক রাজ্য নেতার প্রশ্ন, “বুদ্ধবাবু, মহম্মদ সেলিমের সঙ্গে চিটফান্ডের কারও ছবি দেখিয়ে বলা হচ্ছে, এ সব পোস্টার করে বাজারে ছাড়া হবে। পর মুহূর্তেই বলা হচ্ছে, মুখ্যমন্ত্রীর সঙ্গে কে কখন কী উদ্দেশ্যে দেখা করছে, ছবি তুলে নিচ্ছে, এ সব কী করে উনি বুঝবেন! কোনওটার সঙ্গে কোনওটা মিলছে না!”
তবে জনতাকে ‘বোধোদয়ে’র পরামর্শ দেওয়ার পাশাপাশিই নিজের দলের জন্যও কিছু আত্মসমীক্ষার উপাদান এ দিন পানিহাটির মাঠে রেখে গিয়েছেন নেত্রী। বলেছেন, “আমার লোকেরা আর চাঁদা তুলবে না। কেউ টাকা চাইলে দেবেন না। কেউ টাকা তুললে নিজের দায়িত্বে তুলবেন।” মমতার বিকল্প দাওয়াই অবশ্য পুরনো। তিনি ছবি আঁকবেন, বইয়ের টাকা প্রার্থীর নির্বাচনী তহবিলে দেবেন। যার শুরু হচ্ছে হাওড়ার উপনির্বাচনে প্রার্থী প্রসূন বন্দ্যোপাধ্যায়কে দিয়ে।
সিপিএমের যাবতীয় সম্পত্তি এবং অছি পরিষদ তদন্ত করে দেখার হুঁশিয়ারি দিয়ে মমতা এ দিন বলেন, “সমস্ত ট্রাস্ট-এর তদন্ত করব। চ্যারিটি বিগিনস অ্যাট হোম। প্রথম আমার ট্রাস্ট থেকে শুরু করব।” এই সঙ্গেই তৃণূল নেত্রী এ দিন বলেন, “বাল্মীকির পাপ কি কেউ গ্রহণ করেছিল? অন্যের পাপ কেন আমি গ্রহণ করব?” তৃণমূলেই জল্পনা শুরু হয়েছে, যাঁদের ‘পাপে’র ভার দলনেত্রী নেবেন না, তাঁদের কেউ কেউ দলেরই কি না! প্রসঙ্গত, সাধারণ পরিষদের বৈঠকে মুকুল রায়কে চিরাচরিত পদ্ধতি মেনে দলনেত্রীর ঠিক আগে বক্তৃতার বদলে অনেক আগে ভাষণ দিতে দেখে এই জল্পনাও চলছে যে, দলের সর্বভারতীয় সাধারণ সম্পাদকের গুরুত্ব কি কমতে শুরু করল? মুকুলবাবু এবং মমতার ভাইপো অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়, দু’জনেই এ দিনের মঞ্চে ছিলেন। প্রথম জন ম্রিয়মাণ, প্রশ্নের জবাব এড়িয়ে গিয়েছেন। দ্বিতীয় জন প্রাণচঞ্চল এবং মাঠে ‘যুবা’র ভিড় দেখে উৎসাহিত! |