দলীয় পুরপ্রধান ও মেয়রদের নতুন কোনও বেসরকারি অর্থলগ্নি সংস্থাকে ট্রেড লাইসেন্স না দেওয়ার নির্দেশ দিলেন তৃণমূলের শীর্ষ নেতৃত্ব। সারদা-কাণ্ডের প্রেক্ষিতে উদ্ভুত পরিস্থিতি নিয়ে শুক্রবার কলকাতার ক্ষুদিরাম অনুশীলন কেন্দ্রে তৃণমূলের সাধারণ পরিষদের সভা হয়। সেখানেই এই নির্দেশ দেওয়া হয়।
পুরুলিয়ার রঘুনাথপুর পুরসভার তৃণমূল চেয়ারম্যান মদন বরাটের কথায়, “আমাদের বলে দেওয়া হয়েছে, নতুন করে কোনও অর্থলগ্নি সংস্থাকে ট্রেড লাইসেন্স না দিতে।”
সে ক্ষেত্রে পুরনো সংস্থাগুলির ট্রেড লাইসেন্স সংক্রান্ত পুনর্নবীকরণের আবেদনের কী হবে? তাঁর জবাব, “আমরা বোর্ড মিটিংয়ে সিদ্ধান্ত নেব।” একই কথা জানিয়েছেন উত্তরবঙ্গ ও দক্ষিণবঙ্গের একাধিক পুরপ্রধান ও মেয়র। তবে ঘটনা হল, সারদা-কাণ্ডের পরে বিভিন্ন অর্থলগ্নি সংস্থার ট্রেড লাইসেন্স পুনর্নবীকরণের কাজ ইতিমধ্যেই বন্ধ করেছে এ রাজ্যের অধিকাংশ পুরসভা ও পঞ্চায়েত। বহরমপুরের পুরপ্রধান নীলরতন আঢ্য বলে দিয়েছেন, গত কয়েক দিন সংবাদমাধ্যমে যে সমস্ত অর্থলগ্নি সংস্থার নাম প্রকাশিত হয়েছে, তাদের কেউ ট্রেড লাইসেন্স পাবে না।
রাজ্যের শাসক দলের এই সিদ্ধান্তে ক্ষুব্ধ অর্থলগ্নি সংস্থার কর্তারা। রাজ্যের বিভিন্ন জেলায় মোট ২৫৪টি শাখা রয়েছে রোজ ভ্যালীর। সংস্থার পক্ষে শিবময় দত্ত বলেন, “আমাদের শাখাগুলির কোনওটির লাইসেন্সের বয়স ১৭ বছর, কোনওটির ১০। এত দিন বাদে যদি হঠাৎ বলা হয়, নবীকরণ হবে না তা হলে তো মুশকিলে পড়বেন সাধারণ মানুষই। একটি দোকান যদি অন্যায় করে, তাহলে সব দোকান কি বন্ধ করে দেওয়া যায়? কেন নবীকরণ হবে না, তা জানতে চাইব। প্রয়োজনে আইনি সাহায্য নিতে হবে।”
হুগলির একটি অর্থলগ্নি সংস্থার কর্মকর্তা দেবপ্রিয় আচার্যও বলেন, “শুধু টাকা তোলার ব্যবসা নয়, আমাদের সংস্থার আরও অনেক ব্যবসা রয়েছে। দীর্ঘদিন ধরে সে সব ব্যবসা চলছে। অনেক কর্মসংস্থান হয়েছে। এখন পুরসভা বা পঞ্চায়েত যদি লাইসেন্স বাতিল করার সিদ্ধান্ত নেয়, সে ক্ষেত্রে আইনের আশ্রয় নেওয়া ছাড়া আমাদের আর পথ থাকবে না।”
‘ইনস্টিটিউট অফ চার্টার্ড অ্যাকাউন্টেন্টস অফ ইন্ডিয়া’-র প্রবীণ সদস্য গৌতম ভৌমিকের অবশ্য অভিমত, “ট্রেড লাইসেন্স বাতিল হলেও আমানতকারীকে তাঁর টাকা ফেরত দেওয়ার দায়বদ্ধতা কোনও মতেই কোনও অর্থলগ্নি সংস্থা অস্বীকার করতে পারে না। সে কেবল মাত্র নতুন আমানত সংগ্রহ করতে বা ব্যবসা চালাতে পারবে না।”
কী বলছে আইন? হাইকোর্টের আইনজীবী অরূপ ভট্টাচার্য বলেন, “যে কোনও সিদ্ধান্ত নেওয়ার আগে সরকারের তা বিবেচনা করে দেখা উচিত। যদি যথাযথ কারণ দেখাতে পারে, তবেই লাইসেন্স দেওয়া বন্ধ করা যেতে পারে। কিন্তু শুধু বন্ধ করার জন্য করলে হয়তো তা ঠিক হবে না। এটা ঠিক না ভুল, তা বিশদে খতিয়ে দেখার পরেই ব্যবস্থা নেওয়া উচিত।” লাইসেন্স বাতিল করার পরে আদালতের নির্দেশে লাইসেন্স নবীকরণের ইতিহাস অবশ্য রয়েছে। বছর দুয়েক আগে ত্রিপুরা সরকার ১৭টি কোম্পানিকে বন্ধ করে দেয়। সেগুলির ট্রেড লাইসেন্স বাতিল করাও হয়। পরে আদালতের নির্দেশে সংস্থাগুলিকে ফের লাইসেন্স দিতে বাধ্য হয় ত্রিপুরা সরকার।
বস্তুত, সারদা-কাণ্ডের পরে আইনশৃঙ্খলা জনিত সমস্যা দেখা দিয়েছে জেলায় জেলায়। একাধিক এজেন্ট ও আমানতকারী আত্মঘাতী হয়েছেন। বিক্ষোভ হচ্ছে রোজই। এই অবস্থায় লাইসেন্স নবীকরণ না করলে বা নতুন লাইসেন্স না দিলে কোনও সংস্থা যদি আচমকা ঝাঁপ বন্ধ করে দেয়, তা হলে তাদের আমানতকারী ও এজেন্টদের কী হবে, সে আশঙ্কা দেখা দিয়েছে তৃণমূলের অন্দরেই।
দলের একাধিক পুরপ্রধানই বলছেন, “সংস্থাগুলি হঠাৎ করে অফিস বন্ধ করে দিলে প্রচণ্ড সমস্যায় পড়বেন আমানতকারীরা। তাঁরা এজেন্টদের উপরে টাকা ফেরতের চাপ দেবেন। আমরা লাইসেন্স না দেওয়ায় অফিস বন্ধ হয়েছে জানলে আমানতকারী ও এজেন্টদের রোষ গিয়ে পড়তে পারে পুরসভার উপরে।” আতঙ্কিত এজেন্টরাও। র্যামেল সংস্থার এজেন্ট অসীম বসু বলছেন, “আমরা তা হলে কাজ করব কী ভাবে? এতে তো সবচেয়ে বেশি ক্ষতি হবে লগ্নিকারীদেরই!”
সারদা-কাণ্ডের পরে এটাও স্পষ্ট যে, পুরসভা ও পঞ্চায়েতের কাছ থেকে নাম কে ওয়াস্তে অন্য কোনও ব্যবসার নামে ট্রেড লাইসেন্স করিয়ে জেলায় জেলায় টাকা তোলার কারবার চালাচ্ছে শতাধিক অর্থলগ্নি সংস্থা। শুধু পঞ্চায়েতের দেওয়া ট্রেড লাইসেন্স নিয়েই পূর্ব মেদিনীপুরের মেচেদা বাজার এলাকায় সারদা-সহ ৭৩টি বেসরকারি অর্থলগ্নি সংস্থা এত দিন রমরমা কারবার চালিয়েছে। আপাতত অবশ্য জেলায় জেলায় এই ধরনের অর্থলগ্নি সংস্থাগুলিকে ট্রেড লাইসেন্স না দেওয়ার কাজ শুরু হয়ে গিয়েছে।
মেচেদার শান্তিপুর-১ পঞ্চায়েতের তৃণমূল প্রধান পঞ্চানন দাস বলেন, “মেচেদা বাজারে গত কয়েক বছর ধরে বিভিন্ন সংস্থা তেল, ঘি, মধু, আচার এমনকী পানীয় জল বিক্রি করবে বলে ট্রেড লাইসেন্স নিয়েছে। বাস্তবে দেখা যাচ্ছে, তারা এজেন্ট নিয়োগ করে টাকা তুলছে। এই সব লগ্নি সংস্থার লাইসেন্স পুনর্নবীকরণ না করার সিদ্ধান্ত নিয়েছি। যে ২৪টি সংস্থা লাইসেন্স পুনর্নবীকরণ করিয়েছে ইতিমধ্যে, বিজ্ঞাপন দিয়ে জানিয়ে দেওয়া হয়েছে তাদের লাইসেন্স বাতিলের কথা। জনগণের কাছ থেকে সংগৃহীত অর্থ দ্রুত ফেরত দেওয়ার কথাও বলা হয়েছে।”
মধ্যমগ্রাম পুরসভার চেয়ারম্যান তথা তৃণমূল বিধায়ক রথীন ঘোষ বলেন, “আমাদের এলাকায় ৮টির মতো অর্থলগ্লি সংস্থাকে চিহ্নিত করা হয়েছে। তাদের লাইসেন্স দেওয়া হবে না। এই লাইসেন্সের জন্য স্থানীয় কাউন্সিলরের শংসাপত্র লাগে। কাউন্সিলরদেরও জানিয়ে দেওয়া হয়েছে, কোনও সংস্থার কাজকর্ম সম্পর্কে যেন তাঁরা যথেষ্ট খোঁজখবর নেওয়ার পরেই শংসাপত্র দেন।” হুগলির বৈদ্যবাটির পুরপ্রধান অজয়প্রতাপ সিংহ বলেন, “আমরা পুরসভার তরফে এই ধরনের কোনও সংস্থাকে ট্রেড লাইসেন্স দিচ্ছি না।”
মালদহের ইংরেজবাজার পুরসভার চেয়ারম্যান তথা পর্যটনমন্ত্রী কৃষ্ণেন্দুনারায়ণ চৌধুরী বলেন “একটিও বেসরকারি অর্থলগ্নি সংস্থার ট্রেড লাইসেন্স নবীকরণ করা হবে না। ট্রেড লাইসেন্স ছাড়া মালদহ শহরে কাউকে ব্যবসা করতে দেওয়া হবে না।” |