সারদা-কাণ্ডের জেরে রাজ্যের প্রাক্তন অর্থমন্ত্রী অসীম দাশগুপ্তের প্রাক্তন আপ্ত-সহায়ক গণেশ দে-কে রাতারাতি দল থেকে বহিষ্কার করল সিপিএম। এই সিদ্ধান্ত নিয়েই তারা পাল্টে চাপে ফেলল তৃণমূলকে। কারণ, সারদা-কাণ্ডের সঙ্গে শাসক দলের একাধিক নেতা-মন্ত্রীর নাম জড়ালেও তাঁদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার কোনও প্রক্রিয়া তৃণমূলে শুরু হয়নি। বরং তৃণমূল নেত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় নিজের দলের অভিযুক্তদের পাশে দাঁড়িয়ে তোপ ঘুরিয়ে দিয়েছেন সিপিএমের দিকে।
অসীমবাবুর প্রাক্তন বিধানসভা কেন্দ্র খড়দহের সিপিএম কর্মী গণেশবাবু। অসীমবাবু অর্থমন্ত্রী থাকাকালীন তাঁর আপ্ত-সহায়ক হিসেবে গণেশবাবু সারদা গোষ্ঠীকে কিছু বদান্যতা পাইয়ে দেওয়ার বিনিময়ে সুবিধা নিয়েছেন বলে অভিযোগ উঠেছে। বিধাননগর পুলিশ তাঁকে ডেকে জিজ্ঞাসাবাদও করেছে। এই অভিযোগ সামনে আসার পরেই শুক্রবার সিপিএমের উত্তর ২৪ পরগনা জেলা কমিটির বৈঠকে গণেশবাবুকে দল থেকে বহিষ্কারের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। রাজ্য কমিটির সদস্য এবং জেলার অন্যতম নেতা অসীমবাবুরও মত নেওয়া হয়। বস্তুত, গণেশবাবুকে আগেই শাস্তি দেওয়ার কথা দলের অন্দরে অসীমবাবু জানিয়েছিলেন বলে সিপিএম সূত্রের খবর। শেষ পর্যন্ত বহিষ্কারের সিদ্ধান্ত নিয়ে শুক্রবার রাতেই দলের রাজ্য সম্পাদক বিমান বসুর সঙ্গেও কথা বলেন সিপিএমের উত্তর ২৪ পরগনা জেলা সম্পাদক গৌতম দেব। সিপিএম নেতৃত্বের বক্তব্য, দলের অজান্তেই গণেশবাবু সারদা গোষ্ঠীর সঙ্গে যোগাযোগ রেখেছিলেন।
তৃণমূল নেত্রী যখন সারদা-কাণ্ডে সিপিএমকেই কাঠগড়ায় তুলতে শুরু করেছেন, তখনই গৌতমবাবুর পাল্টা চ্যালেঞ্জ ছিল, তাঁদের দলের কারও বিরুদ্ধে অভিযোগ প্রমাণিত হলে ২৪ ঘণ্টার মধ্যে ব্যবস্থা নেওয়া হবে। সাহস থাকলে তৃণমূল নেত্রীও তাঁর দলে একই কাজ করে দেখান! গণেশবাবুর ক্ষেত্রে কালক্ষেপ করেনি উত্তর ২৪ পরগনা জেলা সিপিএম। গৌতমবাবু শনিবার বলেছেন, “দলের স্বার্থে এবং জনগণের কাছে ভাবমূর্তি ঠিক রাখতে দলীয় সংবিধান অনুযায়ী গণেশ দে-কে সরাসরি দল থেকে বহিষ্কার করা হয়েছে। সারদার সঙ্গে দলের কারও যদি কোনও যোগাযোগ বা সাহায্য নেওয়ার সম্পর্ক থাকে, তা হলে ২৪ ঘণ্টার মধ্যে জরুরি বৈঠক ডেকে কঠিন সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে।” তবে এ ক্ষেত্রে দ্রুত সিদ্ধান্ত নিলেও সিপিএমের অন্দরেই একাংশের প্রশ্ন, গণেশবাবুকে ছেঁটে ফেলে দলীয় নেতৃত্ব সঙ্কটের আঁচ এড়াতে চাইছেন না তো?
তবে তুলনায় ছোট মাপের নেতা হলেও সিপিএম শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নিয়েছে। তৃণমূল কী করবে? তাদের দলের রাঘব-বোয়ালদের নাম তো সারদা-কাণ্ডে জড়িয়ে যাচ্ছে! সদুত্তর তৃণমূল নেতৃত্বের কাছ থেকে মেলেনি। দলের সর্বভারতীয় সাধারণ সম্পাদক মুকুল রায় এ দিন জানান, তিনি কোনও মন্তব্য করবেন না। এই বিষয়ে মন্তব্য করতে চাননি দলের মহাসচিব পার্থ চট্টোপাধ্যায়ও। তবে শাসক দলের এক প্রথম সারির নেতার আক্ষেপ, “কৌশলগত বা লোক-দেখানো যা-ই হোক, সিপিএম তা-ও কিছু পদক্ষেপ করেছে। লোকে তো জানতে চাইবে, আমরা কী করেছি? কিন্তু শ্যামবাজার এবং পানিহাটির সভায় নেত্রী যা বললেন, তার থেকে তো তেমন কোনও ইঙ্গিত পাওয়া যাচ্ছে না!”
২০১০-এর শেষে এক অনুষ্ঠানে গণেশবাবুর সঙ্গে সারদা-কর্তার আলাপ হয়। পরে সল্টলেকের কয়েকটি জায়গায় তাঁদের বৈঠক হয়েছে। গণেশের মাধ্যমে সারদা গোষ্ঠী বেশ কিছু সুবিধা পেয়েছে বলে গোয়েন্দাদের দাবি। তবে তাতে বাম সরকার জড়িত কি না, তা নিয়ে পুলিশ-কর্তারা মন্তব্য করেননি। এ দিনই পানিহাটির সভায় অনুপস্থিত অর্থমন্ত্রী অমিত মিত্রের প্রসঙ্গ টেনে মুখ্যমন্ত্রী বলেছেন, “অমিতদাকে বললাম, আপনি কেন ব্যস্ত হবেন? আপনার কাজ করুন। আপনার তো গণেশ ওল্টায়নি!”
সিপিএমের জেলা সম্পাদক গৌতমবাবু মেনে নিয়েছেন, “আমাদের দল বড় হয়েছে। দলে কিছু অবাঞ্ছিত লোকও ঢুকেছে। কিছু ভুল ত্রুটিও হচ্ছে। এর জন্য অনেক বিধান আছে।” তবে একই সঙ্গে তাঁর আরও বক্তব্য, “চিট ফান্ড নিয়ে শুক্রবার উত্তর ২৪ পরগনার ৩০টি জোনাল কমিটির সম্পাদক ও সদস্যদের নিয়ে সভা করা হয়েছে। কোন কোন চিট ফান্ড জেলায় সক্রিয়, বেশি লোক ঠকাচ্ছে, তার খোঁজও চলছে। তবে সারদার জাল এই জেলায় বেশি একটা নেই। অন্য কিছু চিট ফান্ডের রয়েছে।”
দলের মধ্যেই একাংশ অবশ্য প্রশ্ন তুলছে, প্রাক্তন আপ্ত-সহায়কের দায় কি অসীমবাবু ঝেড়ে ফেলতে চাইছেন? প্রাক্তন অর্থমন্ত্রী সাফ জানান, এই সংক্রান্ত বিষয়ে কোনও নথি দেখার অধিকার আপ্ত-সহায়কের ছিল না। মন্ত্রী হিসেবে তাঁর সিদ্ধান্তও কেউ প্রভাবিত করতে পারত না। তবু এর বাইরে গিয়ে কেউ যদি কোনও সুবিধা সারদা গোষ্ঠীর কাছ থেকে নিয়ে থাকেন, তা হলে সেই ব্যক্তির অর্থ বা সম্পত্তিও আটক করা উচিত বলে অসীমবাবুর মত। |