এক যে ছিলেন, দারোগাবাবু। ধরা যাক, তাঁর নাম গদাই।
গদাই দারোগার প্রতাপে সব দলের নেতা-কর্মীরা এক ঘাটে জল খান। কিন্তু ইদানীং ঝানু চোর পানু কিনা তাঁকে দু’বেলা কাঁচকলা দেখাচ্ছে! পানুকে ধরলেই বড়কর্তার ফোন আসছে থানায় ওকে ছেড়ে দাও। পানুও মওকা বুঝে বিড়ির ধোঁয়া ছাড়ছে আয়েসে।
ব্যাপার কী? অবশেষে রহস্য খোলসা করলেন যিনি, ধরা যাক, কনস্টেবল রামাবতার পাঁড়ে। পাঁড়েজি বললেন, “পানুকে আর ধরবেন না স্যার। ও সারদায় টাকা লাগিয়েছে। বড়কর্তার বউ-ই তো ওর এজেন্ট।”
নিছক গল্প নয় কিন্তু। যত দিন যাচ্ছে, এ রকম অনেক অভিযোগই পৌঁছচ্ছে রাজ্য প্রশাসনের কাছে। নির্বিঘ্নে ব্যবসা করার স্বার্থে অবসরপ্রাপ্ত অফিসারদের নিয়ে পুলিশ ব্রিগেড তৈরি করেই ক্ষান্ত থাকেননি সুদীপ্ত সেন। থানার দারোগা থেকে শুরু করে পুলিশের নিচুতলার একাংশকেও তিনি গত ক’বছরে এজেন্ট বানিয়ে ছেড়েছিলেন বলে অভিযোগ। আমানতকারী জোগাড় করতেন পুলিশ-স্বামীরাই। আইন এড়াতে এজেন্সিতে খাতায়কলমে নাম থাকত বউদের। খাকি উর্দি ভাঙিয়ে এমন কাজকর্ম দেখে চোখ কপালে উঠেছে তদন্তকারীদের। এক পুলিশ অফিসারের দায়ের করা এফআইআর থেকেই বিষয়টি প্রকাশ্যে এসেছে। |
দেবাশিস দাস নামে রাজ্য সশস্ত্র পুলিশের এক অফিসার গত ৩০ এপ্রিল টিটাগড় থানায় এফআইআর দায়ের করে নিজেরই দুই সহকর্মীর স্ত্রী-র বিরুদ্ধে অভিযোগের আঙুল তুলেছেন। সাব ইনস্পেক্টর পদের ওই অফিসার তাঁর অভিযোগে বলেছেন, ওই দুই মহিলা সারদার এজেন্ট হিসেবে কাজ করতেন। তাঁদের কথাতেই ২০০৯ থেকে এ পর্যন্ত ১ লক্ষ ৫ হাজার টাকা ওই সংস্থায় লগ্নি করেছেন দেবাশিসবাবু। তদন্তে নেমে পুলিশ জেনেছে, যে দু’জনের বিরুদ্ধে অভিযোগ, তাঁদের এক জনের স্বামী ব্যারাকপুরের লাটবাগানে ডিআইজি সেলের ব্যান্ড মাস্টার। অন্য জনের স্বামী মাসখানেক আগেই চাকরি থেকে অবসর নিয়েছেন। তিনিও কাজ করতেন লাটবাগানেই।
নিজের অভিযোগ নিয়ে অবশ্য সংবাদমাধ্যমে কথা বলতে চাননি দেবাশিসবাবু। শুক্রবার তাঁর কাছে এ ব্যাপারে জানতে চাইলে ওই পুলিশকর্মীর পাল্টা প্রশ্ন, “আপনি কি আইও (তদন্তকারী)? আপনাকে কেন বলব? পুলিশ জানে কী করতে হয়।”
কিন্তু শুধু ব্যারাকপুর কমিশনারেট নয়, রাজ্য পুলিশের বেশ কিছু পরিবারের লোকজনই যে সারদার এজেন্ট হিসেবে টাকা তুলতেন, এমন অভিযোগ আরও আসছে। দক্ষিণ ২৪ পরগনার এক পুলিশকর্তা বলেন, “বারুইপুর মহকুমার এক এএসআই বছর তিনেক আগে সারদায় এককালীন ৮০ হাজার টাকা লগ্নি করেছিলেন। পাড়ার যে ছেলেটি টাকা তুলতেন, তাঁকে ফুলেফেঁপে উঠতে দেখে ওই পুলিশকর্মী প্রথমে ভাইঝি, পরে স্ত্রীকে ওই সংস্থার এজেন্ট করে দেন।” একই ছবি রাজ্যের আনাচে কানাচে। উলুবেড়িয়া মহকুমার এক কনস্টেবল বলেন, “কী কুক্ষণেই না স্ত্রীকে সারদার এজেন্ট করেছিলাম। আমারই ৫০ হাজার লগ্নি করে কাজ শুরু করেছিল ও। গোলমাল শুরু হতেই বউ-ছেলেকে মেদিনীপুরে পাঠিয়ে দিয়েছি।”
তদন্তকারীদের একাংশের ধারণা, নানা কারণে থানায় আসা লোকজনের উপরে প্রভাব খাটিয়ে আমানতকারী জোগাড় করতেন এক শ্রেণির পুলিশকর্মী। এটাও কি এক ধরনের তোলাবাজি নয়, প্রশ্ন পুলিশমহলেই। কিন্তু ব্যারাকপুরের ঘটনার যেখানে অভিযোগকারী ও অভিযুক্ত, দু’পক্ষই পুলিশের পরিবার, সেখানে কী ভাবে তদন্ত শুরু করা যাবে?
দিশেহারা তদন্তকারীরা। এক পুলিশকর্তা বলেন, “সরকারি নির্দেশ, আমানতকারীদের অভিযোগের ভিত্তিতেই মামলা করতে হবে। কিন্তু এ ক্ষেত্রে পুলিশের স্ত্রী যেহেতু কোনও সংস্থার এজেন্ট এবং সেই সূত্রে কমিশনবাবদ তিনি অর্থ উপার্জন করেছেন, সে ক্ষেত্রে দেখতে হবে তাঁর স্বামী বছরশেষে সম্পত্তির হিসেবে ওই তথ্য জুড়েছেন কি না।” একই সঙ্গে অভিযোগকারীর সম্পত্তির হিসেব ও আয়কর রিটার্নও খতিয়ে দেখা হবে বলে ওই পুলিশকর্তা জানান। |