নিজেই বলছেন, ‘প্রত্যাঘাত’ই তাঁর সেরা অস্ত্র। সেই অস্ত্র হেনেই এ বার দিল্লির গদিতে পরিবর্তনের ডাক দিলেন তৃণমূল নেত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়।
কীসের প্রত্যাঘাত? কেন্দ্রীয় সরকারের তরফে পশ্চিমবঙ্গকে ‘ভাতে মারার’ চক্রান্তের। কংগ্রেস-সিপিএম হাত মিলিয়ে আঞ্চলিক দলগুলিকে ‘শেষ করার’ চক্রান্তের। এবং সর্বোপরি সিবিআইয়ের ভয় দেখানোর চেষ্টার!
বস্তুত, দিল্লি এবং কলকাতায় ইউপিএ সরকারের বিরুদ্ধে এখন লাগাতার সরব তৃণমূল। কিন্তু সেই কংগ্রেস তথা ইউপিএ-বিরোধী জেহাদকে শনিবার যে উচ্চতায় তুলে নিয়ে গেলেন তৃণমূল নেত্রী, তা সারদা-কাণ্ডেরই জেরে বলে মনে করছে মমতার বিরোধী শিবির।
উত্তর ২৪ পরগনার পানিহাটিতে এ দিন তৃণমূলের জনসভা থেকে দিল্লিতে গদি উল্টে দেওয়ার আহ্বান জানাতে গিয়েই রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী বলেছেন, “আমাকে সিবিআই দিয়ে চমকাবেন না! সিবিআই দেখিয়ে লাভ নেই!” এবং এখানেই সারদা-কাণ্ডের ছায়া খুঁজে পাচ্ছে বিরোধী শিবির। সারদা-কাণ্ডের সঙ্গে রাজ্যের শাসক দলের নেতা-মন্ত্রীদের নাম যত জড়াচ্ছে, তত প্রবল হচ্ছে আদালতের নজরদারিতে সিবিআই তদন্তের দাবি। সারদার আমানতকারীদের তরফে এই মর্মে কলকাতা হাইকোর্টে মামলাও হয়েছে। আগামী বুধবার সেই মামলার রায়। রায় বিরুদ্ধে যাওয়ার আশঙ্কা সরকারের একটি অংশের মধ্যে রয়েছে। এর মধ্যেই সোমেন মিত্রর মতো দলীয় সাংসদও সিবিআই তদন্তের পক্ষেই সওয়াল করেছেন। |
সিবিআই নিজেরাও জানিয়েছে, নির্দেশ পেলে তদন্তে তারা প্রস্তুত। কেন্দ্রীয় গোয়েন্দা সংস্থার সঙ্গে সহযোগিতার জন্য ঘর গোছাচ্ছে আর এক কেন্দ্রীয় সরকারি সংস্থা সেবি-ও। রাজনৈতিক শিবিরে জল্পনা চলছে, মায়াবতী বা মুলায়ম সিংহ যাদবের নেতৃত্বাধীন আঞ্চলিক দলগুলিকে যে ভাবে সিবিআইয়ের খাঁড়া ঝুলিয়ে রেখে নিজেদের পক্ষে রেখেছে ইউপিএ, তৃণমূল নেত্রীকেও শেষ পর্যন্ত সেই পথে হাঁটতে হবে কি না? ঠিক এই জায়গা থেকেই এ দিন পাল্টা ‘ওভার বাউন্ডারি’র লক্ষ্যে ক্রিজ ছেড়েছেন মমতা!
মমতা এ দিন বলেছেন, “নো ইউপিএ-থ্রি! আর ইউপিএ সরকার হবে না। মানুষ বলছে এক-দুই-তিন, এ বার বিদায় নিন!” তার সঙ্গেই তৃণমূল নেত্রীর আহ্বান, “দিল্লিতে পরিবর্তন চাই। আমার ক্ষমতা থাকলে বাংলার মানুষকে বলব, দিল্লিতে গদি উল্টে দিন! জনগণের সরকার হবে। সব আঞ্চলিক দলকে বলব, এক জায়গায় আসুন!”
মমতা ধরেই রেখেছেন, আগামী মাসছয়েকের মধ্যে লোকসভা ভোট হবে। তার আগে আঞ্চলিক দলগুলিকে সঙ্গে নিয়ে তিনি যে কেন্দ্রের ইউপিএ সরকারের উপরে চাপ বাড়ানোর পাশাপাশি নিজে জাতীয় রাজনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নিতে চান, তৃণমূল নেত্রীর এ দিনের বক্তব্য থেকেই স্পষ্ট। তিনি দাবি করেছেন, আঞ্চলিক দলগুলির জোট সরকারের পথ দেখাবে বাংলাই। এ দিন ভাষণের আড়ালে আরও একটি কাজ করেছেন মমতা। আরজেডি নেতা লালুপ্রসাদ যাদব দুর্ঘটনার কবলে পড়েছেন শুনে ফোন করে তাঁর কুশল সংবাদ নিয়েছেন। যার মধ্যেও আসলে সৌজন্যের মোড়কে আঞ্চলিক শক্তির জোট বাঁধার রাজনীতির সূক্ষ্ম চাল আছে বলে তৃণমূল সূত্রের ব্যাখ্যা। প্রসঙ্গত, মমতার রেলমন্ত্রিত্বের সময় এই লালুই ছিলেন অন্যতম বড় সমালোচক।
মুখ্যমন্ত্রীর অভিযোগ, কেন্দ্র তাঁদের পিছনে ‘সিবিআই লাগাতে’ চাইছে। কেন? মমতার মতে, তিনি খুচরো ব্যবসায় বিদেশি বিনিয়োগ মেনে নেননি। ইউপিএ-২ সরকার থেকে সমর্থন তুলেছেন। তাঁর দলের সাংসদদের আয়করের ফাইল দেখা হচ্ছে জেনে কেন্দ্রীয় অর্থমন্ত্রীর মুখের উপরে প্রতিবাদ করেছেন। তাই তাঁকে চাপে ফেলতে এক দিকে সিবিআই ‘লাগাতে’ চাইছে দিল্লির সরকার, অন্য দিকে রাজ্যের প্রতি ‘বঞ্চনা’ করছে। আবার পিছন থেকে সিপিএমকে মদত দিচ্ছে। মমতার কথায়, “সিপিএম-কংগ্রেস ভাব হয়েছে বড্ড! এখন যুগ্ম চক্রান্ত করছে!”
তৃণমূল নেত্রীর এ দিনের চড়া সুর শুনে সর্বভারতীয় কংগ্রেসে পশ্চিমবঙ্গের ভারপ্রাপ্ত নেতা শাকিল আহমেদ বলেছেন, “মমতার সরকারের দু’বছর কাটতে না কাটতেই অরাজক পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে। আগে উনি রাজ্যের কথা ভাবুন। নিজের গদি বাঁচান! তার পরে না-হয় কেন্দ্রের কথা ভাববেন!” শাকিলের পাল্টা অভিযোগ, “এই সব কথা বলে উনি আসলে বিজেপি-রই হাত শক্ত করছেন।” যদিও মমতা এ দিনের সভা থেকে কংগ্রেস, সিপিএমের পাশাপাশি বিজেপি-কেও প্রত্যাখ্যান করার আর্জি জানিয়েছেন।
প্রদেশ কংগ্রেস নেতাদের কাছে রাহুল গাঁধী ইদানীং যা বার্তা দিয়েছেন, তার মর্মার্থ: আগামী লোকসভা ভোটে কংগ্রেস একা চলার কথাই ভাবছে। মমতা এ দিন যে সুরে ‘নো ইউপিএ-থ্রি’ বলেছেন, তার মানে কি দাঁড়াচ্ছে কংগ্রেস-তৃণমূল সমঝোতা পুুনরুদ্ধারের চেষ্টায় আপাতত ইতি? পানিহাটির সভার শেষে তৃণমূলের মহাসচিব পার্থ চট্টোপাধ্যায়ের জবাব, “দিল্লিতে কংগ্রেসের কে কী বলছেন, আমি বলতে পারব না। এখানে আমাদের বার্তা পরিষ্কার, আমরা কংগ্রেস এবং সিপিএমের বিরুদ্ধে একা লড়তে প্রস্তুত। বাংলার মানুষ সেই আত্মবিশ্বাস দিয়েছেন।”
কংগ্রেস এবং সিপিএম নেতারা অবশ্য তৃণমূলের ‘আত্মবিশ্বাস’কেই খোঁচা দিচ্ছেন। সিপিএমের কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য গৌতম দেবের প্রশ্ন, “মমতা তো সিপিএমকে চিট ফান্ডের ঘটনায় জড়াতে চাইছেন। সিপিএম জড়িত থাকলে সিবিআই এলে তো মমতারই লাভ! তা হলে আটকানোর এত চেষ্টা করছেন কেন?” আর প্রদেশ কংগ্রেসের এক নেতার কথায়, “শ্যামবাজার এবং তার পরে পানিহাটিতে যে ভাবে তৃণমূল নেত্রী বক্তৃতা করলেন, তাতে বোঝা যাচ্ছে ওঁরা সিবিআইয়ের ভয়ে আছেন! আত্মবিশ্বাস থাকলে নিরপেক্ষ তদন্তে এত ভয় কেন?” ওই নেতার আরও কটাক্ষ, “আঞ্চলিক দলের সরকারের স্বপ্ন দেখতে গিয়ে প্রকাশ কারাটের কী হয়েছিল, জানেন তো!” |