অন্যায় করি না বলে আক্রমণ বিরোধীদের
সারদা কাণ্ডে নিজের এবং দলের ভাবমূর্তির ক্ষতি মেরামতে এ বার নিজেই মাঠে নামলেন তৃণমূল নেত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। বৃহস্পতিবার সন্ধ্যায় শ্যামবাজার মোড়ে জনসভা করে বার্তা দিলেন, তিনি নিজে কোনও অন্যায় করেন না। অন্যায়কে প্রশ্রয় দেন না। দলের কেউ অন্যায়ে জড়িত থাকলে তাঁকে তিনি আড়ালও করবেন না।
সারদা কাণ্ডের পরে এই প্রথম জনতার দরবারে এসে নিজেকে মুখ্যমন্ত্রী হিসেবে নয়, সর্বভারতীয় তৃণমূলের সভানেত্রী হিসাবেই পেশ করেছেন মমতা। প্রায় সওয়া এক ঘণ্টা ধরে একাই বক্তৃতা দিয়েছেন। আর সেই বক্তৃতার পরতে পরতে বুঝিয়েছেন, বিরোধী সিপিএম এবং কংগ্রেস সারদা কাণ্ডের জন্য যতই তাঁর দল ও সরকারকে দায়ী করার চেষ্টা করুক, কালি তাদের গায়েও কিছু কম নেই।
প্রায় ১৫ বছর আগে যে শ্যামবাজার মোড়ে জনসভা করে যাত্রা শুরু করেছিল তৃণমূল, সারদা কাণ্ডের জেরে কোণঠাসা পরিস্থিতিতে সেখান থেকেই ঘুরে দাঁড়ানোর লড়াই শুরু করলেন তৃণমূল নেত্রী। সততাই তাঁর রাজনীতির মূলধন দাবি করে মমতা বলেন, “আমি টাকা রোজগারের জন্য, ধান্দাবাজির জন্য আসিনি। মানুষের কাজ করতে এসেছি। আমার দ্বারা কোনও অন্যায় হবে না। আমি আমাকে গ্যারান্টি দিয়ে গেলাম।”
পাশাপাশি, সারদার কাছ থেকে আর্থিক সুযোগসুবিধা যে সিপিএম-ও নিয়েছে, তা প্রমাণ করতে এ দিন আটঘাট বেঁধেই মঞ্চে উঠেছিলেন মমতা। সিপিএমের দলীয় মুখপত্র থেকে শুরু করে তাদের প্রকাশনার টেলিফোন-নির্দেশিকা তুলে ধরে সারদার বিজ্ঞাপন দেখান তিনি। অভিযোগ করেন, সিপিএমের আমলেই রাজ্যে বেআইনি লগ্নি সংস্থার রমরমা শুরু হয়েছে। পাশাপাশি কংগ্রেসকে দুষে বলেন, কেন্দ্রীয় সরকার লগ্নি সংস্থাগুলিকে মদত দিয়েছে। এ দিন প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যের সঙ্গে বিতর্কিত একটি আর্থিক সংস্থার কর্তার ছবি দেখিয়েও কটাক্ষ করেন মমতা। বলেন, “তুমি মহারাজ সাধু হলে আজ, আমি আজ চোর বটে!”
দলীয় মুখপত্রে সারদার বিজ্ঞাপন প্রকাশ নিয়ে সিপিএম রাজ্য সম্পাদক বিমান বসু অবশ্য বলেছেন, “মুখ্যমন্ত্রী যে সংস্থার বিজ্ঞাপন ছাপার কথা বলেছেন, তা সব সংবাদপত্রেই ছাপা হয়েছে। ওই সংস্থার আমানতকারীদের অর্থ সংগ্রহের বিজ্ঞাপন কখনওই আমরা ছাপিনি।” তুলনায় তাঁদের দলীয় মুখপত্রে ওই সংস্থার বিজ্ঞাপন কম ছাপা হয়েছে বলে বিমানবাবু দাবি করেছেন।
আক্রমণাত্মক তৃণমূলনেত্রী। বৃহস্পতিবার শ্যামবাজারের জনসভায়। ছবি: দেবাশিস রায়।
সিবিআই তদন্তের দাবি নিয়েও এ দিন বিরোধীদের এক হাত নিয়েছেন মমতা। সিবিআই-এর উপরে রাজনৈতিক হস্তক্ষেপ নিয়ে মঙ্গলবারই কড়া মন্তব্য করেছে সুপ্রিম কোর্ট। সেই মন্তব্যকেই হাতিয়ার করে কেন্দ্রের সমালোচনা করেন তৃণমূল নেত্রী। পাশাপাশি সিপিএম-কে কাঠগড়ায় তুলে বলেন, “এত দিন এ নিয়ে (বেআইনি লগ্নি সংস্থার বিরুদ্ধে) রাজ্যে কড়া আইন সিপিএমের সরকার করেনি কেন? আমরা এক দিনের মধ্যে বিশেষ অধিবেশন করিয়ে বিল পাশ করিয়ে কেন্দ্রের কাছে পাঠিয়েছি।” তাঁর প্রশ্ন, “যাঁরা আজ সিবিআই, সিবিআই করে নৃত্য করছেন, তাঁরা কোনও ব্যবস্থা আগে নেননি কেন?”
ঘটনাচক্রে এ দিনই হাইকোর্টে হলফনামা দিয়ে রাজ্য সরকার বলেছে, সারদা কাণ্ডে তদন্ত যে ভাবে চলছে, তাতে সিবিআই-কে ডাকার কোনও প্রয়োজন নেই। লগ্নি সংস্থার বেআইনি কাজ রুখতে রাজ্য সরকার যে আন্তরিক, তা বোঝাতে ইতিমধ্যেই তৃণমূল সাংসদ কুণাল ঘোষকে জেরা করেছে বিধাননগর পুলিশ। সারদার বিভিন্ন অফিসে তল্লাশি চালানো হয়েছে। পাশাপাশি কাজ বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে কয়েকটি লগ্নি সংস্থায়। তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে বিশেষ অধিবেশন ডেকে পাশ করা হয়েছে কড়া আইন। এই সব কাজে ‘ব্যস্ত’ ছিলেন বলেই এত দিন বিরোধীদের কুৎসার জবাব দেওয়ার সময় পাননি বলে এ দিন মন্তব্য করেছেন মমতা।
বিরোধীদের হাজার আক্রমণ তৃণমূলের কোনও ক্ষতি করতে পারবে না বলেই এ দিন দাবি করেছেন দলনেত্রী। তাৎপর্যপূর্ণ ভাবে বলেছেন, “দল এমন ভাবে তৈরি করেছি যে, কোনও দিনই তা উঠবে না। সিপিএম আমাকে খুন করলেও দল উঠবে না। যত দিন বেঁচে থাকব আপনাদের (মানুষের) সঙ্গেই থাকব।” দলে গুঞ্জন, মমতার পরে তৃণমূলের ভবিষ্যৎ নিয়ে নানা মহলে ইতিমধ্যেই যে প্রশ্ন উঠছে, এ দিন কৌশলে তারই জবাব দিয়ে রাখলেন নেত্রী।
সারদা কাণ্ডের পরে মমতার দল, পরিবারের সদস্যদের জড়িয়ে একের পর এক তোপ দেগেছেন সিপিএম নেতারা। এমনকী, এ দিন তৃণমূল নেত্রীর সভা শুরুর কয়েক ঘণ্টা আগেই দলের কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য ও রাজ্যের প্রাক্তন মন্ত্রী গৌতম দেব লগ্নি সংস্থার বেআইনি কাজকর্ম নিয়ে ফের মমতার ভাইপো অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়কে জড়িয়ে অভিযোগ তুলেছেন।
আমার দ্বারা কোনও
অন্যায় হবে না। আমি
আমাকে গ্যারান্টি
দিয়ে গেলাম।
দল এমন ভাবে
তৈরি করেছি যে,
কোনও দিনই
তা উঠবে না।
আমি মনে
করি, চেয়ারটা
অস্থায়ী। মানুষের
বিশ্বাসটাই স্থায়ী।
দলের কেউ অন্যায়
করলে ছাড়ি না।
বাড়ির কেউ অন্যায়
করলেও ছাড় নেই।
মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়
যে আক্রমণের জবাব দিতে গিয়ে মমতা বলেছেন, “আমাকে কেউ বোল্ড করতে এলে আমি ওভার বাউন্ডারি মারি।” তার পর সভামঞ্চে অভিষেকের উপস্থিতিতেই তিনি বলেন, “দলের কেউ অন্যায় করলেও আমি ছাড়ি না। বাড়ির কেউ অন্যায় করলেও ছাড় নেই।” এই পরিপ্রেক্ষিতে সম্প্রতি গার্ডেনরিচ কাণ্ডে কাউন্সিলর মহম্মদ ইকবাল ও মাঠপুকুর কাণ্ডে শম্ভুনাথ কাওকে গ্রেফতারের প্রসঙ্গ তোলেন মমতা। এমনকী, মঞ্চের নীচে বসে থাকা ভাঙড় কাণ্ডে জড়িত আরাবুল ইসলামকে দেখিয়ে তৃণমূল নেত্রী বলেন, “ওই যে আরাবুল বসে আছে ওকেও ৪২ দিন জেল খাটতে হয়েছে।” তাঁর দলে যে অন্যায়কারীদের স্থান নেই, তা বোঝাতে মমতা বলেন, “ঝুড়িতে এক কেজি লঙ্কার মধ্যে একটি লঙ্কা খারাপ হলে তা বেছে ফেলে দেওয়াই উচিত। দলে সবাই তো খারাপ নয়। এক জন, দু’জন সিপিএম পার্টি থেকে এল বা কোথাও থেকে এল, তারা খারাপ হলে গোটা দলটাই খারাপ হয়ে গেল!”
তবে সারদা-কাণ্ডে, বিশেষত তৃণমূল সাংসদ কুণাল ঘোষ-সহ কয়েক জনের নাম জড়িয়ে দলের ভাবমূর্তি কিছুটা হলেও ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে বলে দলের অনেকেই মনে করেন। এমনকী মমতার ভাবমূর্তিকেও আঘাত করেছে বলে দলের অন্দরেই কথা উঠেছে। (কুণালকে অবশ্য এ দিন সভার ধারেকাছে দেখা যায়নি।)
ভাবমূর্তির সেই ক্ষতি মেরামত করতে এ দিন শ্যামবাজার মোড়ের সভার পর শনিবার পানিহাটিতে সভা করবেন মমতা। বস্তুত পানিহাটিতে সিপিএমের সভা থেকেই তৃণমূল নেত্রীর ভাইপোর বিরুদ্ধে আক্রমণ শানাতে শুরু করেছিলেন গৌতমবাবু। পানিহাটির সভার আগে আজ, শুক্রবার ক্ষুদিরাম অনুশীলন কেন্দ্রে দলের সাধারণ পরিষদের সভা ডেকেছেন মমতা। সেখানে তিনি কী বলবেন তার আভাস এ দিন শ্যামবাজারের সভায় খানিকটা পাওয়া গিয়েছে। দলের নেতা-কমীদের ‘আরও নম্র ও সুশৃঙ্খল’ হওয়ার পরামর্শ দিয়েছেন মমতা। আজকের দলীয় বৈঠকে নেত্রী আরও কড়া কোনও দাওয়াই দেন কি না, সেটাই দেখার।

পুরনো খবর:



First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.