|
|
|
|
|
|
|
একটাভয়[কষ্ট]লজ্জাঘেন্না |
সঞ্চারী মুখোপাধ্যায় |
বাবরি করা কান ঢাকা চুল অমিতাবচন স্টাইল, সায়া-ঘের প্যান্ট অমিতাবচন স্টাইল, হাইহিল চেন-টানা জুতো, রাগী মেজাজ, অল্প গালাগাল সঅঅব অমিতাবচন স্টাইল। ফি শুক্কুরবার বসুশ্রী কিংবা উজ্জ্বলার বারান্দায় উঠে গুরুর গলায় মালা, ফার্স্ট শো-এ সিনে সিনে খুচরো পয়সা। ছেলেটার নাম ছিল মন্টু। পাড়ার দাদা টাইপ। কেরোসিন তেলের লাইনে দাদাগিরি, কালীপুজোর চাঁদায় দাদাগিরি, অ্যাক্সিডেন্ট-এ দাদাগিরি, মা-বোন রক্ষায় দাদাগিরি। সকালে লুঙ্গি-গোটানো আর ফুটো ফুটো গেঞ্জি পরে পাড়ার মোড়ের হাল-হকিকত কন্ট্রোলে রেখে দুপুর নাগাদ বাড়ি। বিকেলে পুরো গুরুর বেশে, গুরুর ঢঙে পাড়া বেড়িয়ে আড্ডা মারা মন্টু। না, টেরর মন্টু। পাড়ার হালকা মাস্তান।
দিন যায়, টেরর মন্টুর বাড়বাড়ন্ত। চুল বাবরি ছেড়ে জুলপি চাঁছা, প্যান্টের ঘের কম কেবল রোয়াব ঊর্ধ্বগামী, রেট ওভারে দশ-বারো। আমরা ইতিমধ্যে ওকে ফেলে দিয়েছি ‘ঘোর মাস্তান’ ক্যাটাগরিতে। কিছু দিন পর থেকে ১৫ অগস্ট, ভোট আর পুজোর সময় সাদা পাঞ্জাবি, কানে উড়ে উড়ে খবর পলিটিকাল দাদার ভালবাসার পাত্তর। আমরা চোখ গোল গোল করে, ‘ও!!! তাই বুঝি?’ বলে কোচিং-এর রাস্তায়।
এক বার ভোটের আগে খুব হইহই। এর-তার সঙ্গে দেখা হলেই একটা খুনের কথা সবার মুখ থেকে ফুটন্ত পপকর্নের মতো ছিটকে বেরোচ্ছে। কেউ বাক্য সম্পূর্ণ না করে নিচু গলায় টেরর মন্টু নাকি উম্ম্ম্.... ও তো নাকি গা ঢাকা... ফ্যাঁসফ্যাঁসে গলায় পাড়ার কেউ কেউ। এ-বাড়ির জানলা ও-বাড়ির জানলায় কথা ছোড়াছুড়ি। তার পর মন্টুকে দেখা যায় না বেশ কিছু দিন। বছর দুয়েক বাদে হঠাৎ এক দিন দেখে আমি ধাঁ! সারা গায়ে তাপ্পি মারা অন্তত পাঁচটা জামা, দুটো প্যান্ট, মাথায় ফেট্টি, হাতে প্রচুর প্রচুর প্লাস্টিকের বোতল, আর একটা বিরাট বস্তা টেনে টেনে চলেছে। সে দিন মন্টুকে দেখে একটুও পাগল মনে হয়নি। ওর চোখ স্পষ্ট, কোথাও একটা স্মিত হাসি ঠোঁটের কোণে, ‘আমায় জব্দ করবি?’ টাইপ। তা হলে সবাই ঠিকই বলেছিল, ও নাকি খুনের দায় এড়াতে পাগল হওয়ার ভান করছে। রাজনৈতিক দাদাটি বলেছিল পাগলামির সুদ হিসেবে ওর বাড়ির অবস্থা ফিরিয়ে দেবে। দিয়েছে? কী প্রমাণ করতে চাইছে সবার সামনে পাগল সেজে সত্যি বেঁচে যাবে মামলা থেকে?
ফের বছরখানেক বাদে ওকে দেখে ছ্যাঁৎ করে উঠল ভেতরটা। চোখের দৃষ্টি বিলকুল বদলে গিয়েছে। গায়ে আরও তিনটে ছেঁড়া নোংরা জামা চেপেছে, ঠোঁটের কোনা বেয়ে কষ গড়িয়ে পড়ছে। প্লাস্টিকের বোতলের বস্তাটা আর টানতে পারছে না। দাড়িতে জড়িয়ে রয়েছে লালা-থুতু-খাবারের শেষ চিহ্নগুলো। সত্যি কি তা হলে পাগলের অভিনয় করতে করতে...
এর পর প্রায়ই দেখতাম। চার-পাঁচটা বাড়ির পরের একটা রকে ওর আশ্রয় ছিল। পুরনো লোকেরা মায়া করে কখনও টিউবওয়েলের তলায় বসিয়ে চান করিয়ে দিত। কোনও কোনও বাড়ির বাড়তি ভাত থার্মোকলের থালায় পড়ে থাকত ওর সামনে। পায়ের কাটা থেকে শুকনো রক্ত অবহেলা আর উপেক্ষার অভিজ্ঞান হয়ে জ্বালিয়ে যেত সারা ক্ষণ। মাছি ঘুরত দাড়ির চার পাশে। আর ঘুম ভাঙলেই প্রায় ২০ কেজির প্লাস্টিকের বোতলের বস্তাটা আপ্রাণ কোথায় টেনে নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করত কে জানে। বাড়ির লোকে নিত না। তবু পুরনো বাড়িটার সামনে নাকি মাঝে মাঝে গিয়ে খুব কিছু বলার চেষ্টা করত। ঘোলাটে চোখ দুটো উজ্জ্বলা সিনেমার দিকে তাক করে কি গাঁদার মালা খুঁজত? |
|
|
|
|
|