|
|
|
|
|
|
চেনা গল্প অচেনা মোচড় |
আজ কপাল পুড়ল: কিরণমালা-র
|
ঈপ্সিতা হালদার |
ভ্যানোর সামনের চাকাটা বোধ হয় একটা গর্তে পড়ল। আচমকা ঝাঁকুনিতে ঘুম-ঘুম ভাবটা কেটে গেল দেবদাসের। কত দূর আর হাতিপোতা গ্রাম? ভ্যানোর ছেলেটা বড্ড আস্তে চালাচ্ছে তো! দেবদাস ছেলেটাকে কিছু বলবে বলে উঠে বসতে চাইছিল, কিন্তু পারল না। মাথার ভেতরটা কেমন ভোঁ-ভোঁ করছে। শরীরটা জুড়েও ঝিমঝিম ভাব। ক’টা বেজেছে এখন কে জানে! হাতঘড়িটা তো জগুর বিলিতি মদের ঠেকে বাঁধা দিয়ে আর আনা হয়নি। ভ্যানোয় চড়ার আগে, সেই কোন সকালে স্টেশনের প্ল্যাটফর্মে এক ভাঁড় চা খেয়েছিল! সঙ্গে লোকাল বেকারির দু’টো বিস্কুট। শুকনো, শক্ত, মোটা মতন। জাবর কাটার মতো করে দেবদাস জিভ দিয়ে ঠেলে ঠেলে দাঁত আর মাড়ির গায়ে ডেলা পাকিয়ে থাকা বিস্কুট-গুঁড়োগুলোকে আবার মাঝের দিকে নিয়ে এসে কত ক্ষণ ধরে চিবিয়েছিল!
|
|
এখন কিন্তু পেটের ভিতরটা বেশ গুলোচ্ছে। খিদেই পাচ্ছে মনে হয়। ধর্মদা থাকলে নিশ্চয়ই এত ক্ষণে জোরজার করে কিছু একটা খাইয়ে দিত। বেচারা ধর্মদা! চলন্ত ট্রেনে ঘুম ভেঙে যখন দেখবে দেবদাস নেই, তখন কী যে করবে! ট্রেন থেকে লাফটাফ দেবে না তো? দেবদাসের আর ভাবতে ইচ্ছে করে না। স্টেশনের বাইরে এই ভ্যানোটা দেবদাসের পছন্দ হয়েছিল, কারণ এটার মাথায় প্লাস্টিকের একটা ছাউনি ছিল। আর বারমুডা প্যান্ট, গোলগলা টি-শার্ট, টুপি পরা ছেলেটাকেও বেশ চটপটে, স্মার্ট মনে হয়েছিল। এখন এই ভরদুপুরে, তেপান্তরের মাঠের মাঝখানে রোদ্দুর যেন প্লাস্টিকের ছাদ ফুঁড়ে গায়ের উপর ঝাঁপাচ্ছে। মাটি ফাটিয়ে রাস্তা থেকে যেন ধোঁয়া উঠছে, তাকাতে গেলে চোখ ধাঁধিয়ে যায়। আচ্ছা, ভ্যানোর ড্রাইভার ছেলেটার টি-শার্টের বুকের কাছটায় একটা ছবি ছিল না, ক্যাটরিনা কাইফের? কিন্তু পিঠেও যে একটা মেয়ের মুখ, সেটা কি দেবদাস আগে খেয়াল করেছিল? এই মেয়েটা কে? করিনা কপূর?
দেবদাস অবশ্য করিনা-ক্যাটরিনা কাউকেই ভাল চেনে না। ওই চন্দ্রার ঘরেই ওদের পোস্টার দেখেছে। চন্দ্রা মানে চন্দ্রমুখী। সাকিন সোনাগাছি। চন্দ্রার কাস্টমাররা মাঝেমধ্যেই হিন্দি সিনেমার নাচ দেখতে চায়। ‘চিকনি চামেলি’, ‘শীলা কি জওয়ানি’। ও যখন নাচ প্র্যাকটিস করত, দেবদাস বসে বসে দেখত। দেখত, কী ভাবে চন্দ্রা তার পঁয়ত্রিশ ছুঁই-ছুঁই অল্প অল্প মেদ-জমা কোমরে মাধুরীর ঝটকা, ক্যাটরিনার লচক-ঠমক, করিনার বিদ্যুৎ আনার চেষ্টা করছে।
চন্দ্রমুখী! চন্দ্রমুখী! দেবদাসের নিভে আসা কামনার চুল্লিতে তুমি দাউদাউ জ্বালানি হয়েছ। কিন্তু বিনিময়ে দেবদাসের শরীরেও ছড়িয়ে দিয়েছ তোমার গোপন অসুখ। এলাইজা টেস্টের সেই রিপোর্টটা তো দেবদাসের ঝোলাব্যাগেই আছে। কিন্তু চন্দ্রমুখী কোথায় আছে, বেঁচে আছে কি না, দেবদাস কিচ্ছু জানে না। তার এড্স ধরা পড়ার অনেক আগেই তো চন্দ্রা সোনাগাছি ছেড়ে চলে গেছে। চন্দ্রা নেই। দেবদাসের রক্তে বইছে তার দেওয়া অসুখ। সেই অসুখ নিয়েই সে পারো-র কাছে যাচ্ছে। হাতিপোতা আসতে আর কত ক্ষণ ভাই? গা জ্বরে পুড়ে যাচ্ছে। মাথার ভেতরটা যেন ফেটে যাবে এখনই। কিন্তু পারোর বাড়ি যে পৌঁছতেই হবে! |
দুই |
চৌধুরীমশাইকে নিয়ে পারোর কোনও চাপ নেই। এই তো কবে সইয়ের সঙ্গে চ্যাট করার সময় পারো লিখেছিল চৌধুরীমশাই আমার বাবা বেশি, বর কম। সই লিখল বাপ-কাম-বর? টু-ইন-ওয়ান। সই মনোরমাকে তো আর সব কথা লেখা যায় না! বিয়ের পর যতই এখন নয়ডায় থাকুক, শিকড় তো সেই কেয়ার অব তালসোনাপুর। গেঁয়োপনার শেষ নেই! তাই সইকে কিছুতেই বলা যাবে না। রাত্তিরে বিছানায় চৌধুরীমশাই যখন পারোকে আশীর্বাদ-টাশির্বাদ করে কপালে অবধি একটাও চুমু না-খেয়ে পাশ ফিরে কোলবালিশ জড়িয়ে ঘুমিয়ে পড়তেন, পারো তখন উঠে মহেন্দ্রর ঘরে যেত। চৌধুরীমশাইয়ের প্রথম পক্ষের ছেলে মহেন্দ্র বোধ হয় বয়সে পারোর চেয়ে দু-চার বছরের বড়ই হবে। মহেন্দ্রর সঙ্গে বিছানায় শরীরের খেলায় ভেসে যেতে যেতে পারো দেবদাসের প্রত্যাখ্যান, মুখুজ্যেবাড়ির দেওয়া অপমান, বুড়ো দোজবরে তার বিয়ে দিয়ে দেওয়া সব কিছুর শোধ তুলত! মহেন্দ্রর বিয়ের পরেও কিন্তু ব্যাপারটা থেমে যায়নি। তখন মায়ের ঘরে ছেলে আসে। দরজা বন্ধ করে। ‘বৈষয়িক’ আলোচনা হয়। ‘সৎ মায়ের আঁচল ধরা’ বলে মহেন্দ্র বউয়ের খোঁটা খায়। বাড়ির কাজের লোক বা সমাজের কাকপক্ষী কেউ কিচ্ছু টের পায় না, এমন হয়তো নয়। কিন্তু চৌধুরীবাড়ির টাকার সামনে কেউ মুখ খোলেনি।
কিন্তু সেই যে সে দিন বিকেলে এক-গা জ্বর নিয়ে দেবদা এসে তাদের বাড়ির দরজায় ঘা দিল, সেই ইস্তক পারোর জীবনটা কেমন উথালপাথাল হয়ে গেছে। মহেন্দ্রই এসে খবর দিয়েছিল তোমার বাপের বাড়ির গাঁয়ের লোক, নাম বলছে দেবদাস মুখুজ্যে। পারো গা ধুতে যাচ্ছিল, ওই আলুথালু কাপড়েই ছুটে আসে। গ্রামের কুটুম, চৌধুরীমশাইও আপত্তি করেননি। মহেন্দ্র অবশ্য পারোর মুখ দেখেই বুঝেছিল, লোকটা শুধুই গাঁয়ের কুটুম নয়। হিংসেয় জ্বলে মরেছে, কিন্তু বলতে পারেনি কিচ্ছু। বিছানায় যতই বাঘ-সিংহ ভাব দেখাক, আসলে তো সে পারোকে ভয় পায়। হাতিপোতার চৌধুরীবাড়িতে এখন আশ্চর্য নীরব ত্রিকোণ প্যাশন-এর টানাপোড়েন। মহেন্দ্রর বউ-ই বোধহয় শুধু তার কিছুটা আঁচ পায়। |
তিন |
পারোর সেবায়, যত্নে গায়ে এখন একটু বল এসেছে। তবে দেবদাস জানে, নিভে যাওয়ার আগে প্রদীপের এই শেষ বার জ্বলে ওঠা। আজ রাতে পারো আসবে। সেই এক রাত্তিরে সে পারোকে ফিরিয়ে দিয়েছিল। তার জীবন নরক হয়ে গিয়েছিল। আজ রাতে সেই নরক থেকে বয়ে আনা আগুন আর বিষই সে ঢালবে পারোর শরীরে। পারো, ও পারো! পুকুরপাড়ে এক দিন ছিপ ঘুরিয়ে আমি তোর কপালে কলঙ্ক এঁকে দিয়েছিলাম। আজ তোর শরীরে দিয়ে যাব আমার নির্বাসনের অর্জন। তোর দেবদা থাকবে না, কিন্তু তার মৃত্যুযন্ত্রণা তুই তোর শরীরে টের পাবি। সেই হবে আমাদের মিলন। অন্ধকারে দেবদাস হাসে। ঘরের আলো জ্বাললে যে-কেউ দেখতে পেত, সে হাসি প্রেমিকের নয়! |
(সংক্ষেপিত)
ছবি: সায়ন চক্রবর্তী
অনুবাদ অমিত দেবনাথ |
|
|
|
|
|