|
|
|
|
|
|
|
সুমনামি |
কবীর সুমন |
এই পর্যায়ের একটি লেখায় অন্তত একটি ভুল করে বসেছিলাম। সনৎ সিংহ-এর গাওয়া ‘অহল্যা কন্যা’ গানটির সুরকার হিসেবে নচিকেতা ঘোষের নাম লিখে ফেলেছিলাম। তাঁর গাওয়া ‘সাপুড়ের পাঞ্জা দোলে’ গানটির সুরকার অবশ্যই নচিকেতা ঘোষ, যাঁর সমতুল্য সুরকার মানবেতিহাসেই বিরল। কিন্তু ‘অহল্যা কন্যা’ গানটি ভাস্কর বসুর লেখা ও মৃণাল চক্রবর্তীর সুর দেওয়া।
এ ধরনের ভুল আমি আগেও অন্তত এক বার করেছি। বাংলা ভাষায় এখনও এমন কোনও বই নেই যা থেকে যে-কেউ জেনে নিতে পারেন কোন গান গ্রামোফোন রেকর্ডে কবে প্রকাশিত হয়েছিল, কে গেয়েছিলেন, কে ছিলেন গীতিকার, কে ছিলেন সুরকার। কোনও কোনও গ্রামোফোন কোম্পানি এক সময়ে শুধু তাঁদের প্রকাশ করা রেকর্ডগুলির তালিকা প্রকাশ করতেন। কিন্তু গ্রামোফোন রেকর্ডে বাংলা গানের শুরুর সময় থেকে কোন সংস্থা থেকে কোন কোন গান আশির দশক পর্যন্ত বেরিয়েছে, তার কোনও তালিকা এখনও সামগ্রিক ভাবে নেই। পঞ্চাশের দশক থেকে আমি প্রধানত বেতারে গানবাজনা শুনেছি সত্তরের দশকের মাঝামাঝি অবধি। আকাশবাণী কলকাতার ‘অনুরোধের আসর’-এ কণ্ঠশিল্পীর নাম বলা হত, গীতিকার সুরকারের নাম বলা হত না। ও দিকে আকাশবাণী কলকাতার ‘রম্যগীতি’ অনুষ্ঠানে কিন্তু সকলের নামই ঘোষণা করা হত।
বাংলা গানের ক্ষেত্রে অল্প বয়সের স্মৃতি নিয়েই বেঁচে আছি। ফলে গানের সুরকার ও গীতিকার সম্পর্কে কিছু ভুল ধারণাও থেকে গিয়েছে। তাও বয়োজ্যেষ্ঠ দু’-একজন আছেন, যেমন শচীদুলাল দাস ও অলোক চট্টোপাধ্যায়, যাঁদের মনে আছে খুঁটিনাটি অনেক তথ্য। কিন্তু সব সময়ে তাঁদের বিরক্ত করতে ইচ্ছেও করে না।
|
|
ছবি: সুমন চৌধুরী |
গানবাজনা এমনই জিনিস যে কোনও কোনও ধারণা প্রায় বিশ্বাসের জায়গায় চলে যায়। ছাত্রজীবনে আমরা তিন বন্ধু এক বার রবীন্দ্র সরোবরের পাশ দিয়ে হেঁটে যাচ্ছি আব্দুল রসুল অ্যাভিনিয়ু বরাবর। একটি বাড়ির পাশ দিয়ে যেতে গিয়ে শুনতে পেলাম দিলীপকুমার রায়ের গান ভেসে আসছে, কিন্তু রেডিয়ো বা রেকর্ড থেকে নয়। জানলার ধারে ঘাপটি মেরে উঁকি দিয়ে দেখি গেরুয়া জামা পরা এক বয়স্ক পুরুষ হারমোনিয়াম বাজিয়ে গান গাইছেন। না-জানি কোন জন্মে কোন পুণ্য করে ফেলেছিলাম তাই ভাগ্যবিধাতা এই জন্মে এমন সুযোগ এনে দিলেন: খোদ দিলীপকুমার রায়ের গান শুনছি। ওই তো তিনি বসে আছেন, পেছন থেকে দেখতে পাচ্ছি, ওই তো, আহা, অমন কণ্ঠ আর কোন পুরুষের হবে এই পৃথিবীতে! ওই গায়কি! উফ! বাঁ-দিকে সন্ধের রবীন্দ্র সরোবর। গাঢ় সন্ধে। রাস্তার আলোর হালকা বিচ্ছুরণে গাছগুলো কী মায়াময়! মাঝে মাঝে গাড়ি ছুটে যাচ্ছে চওড়া রাস্তা দিয়ে। আর ডান দিকে পুরনো আমলের একটি বাড়ির এক তলার একটি ঘরে জলদগম্ভীর স্বরে গান গাইছেন বিশ্বের বিস্ময় দিলীপকুমার রায়! তিন জনেরই চোখে জল। এত ভাগ্য করে এসেছিলাম আমরা! না, আর পারা গেল না। তিন বাঙালি যুবক, তিন জনেই যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র, চট করে মনস্থির করে সেই বাড়ির দরজায় গিয়ে টোকা দিলাম। এক প্রবীণা খুব সন্তর্পণে দরজা খুলতেই আমরা চাপা গলায় প্রায় সমস্বরে বলে উঠলাম দিলীপকুমার রায়ের গান জানলার বাইরে থেকে শুনছিলাম, সামনে থেকে শুনতে চাই এক বার, দোহাই আপনার। গানে তত ক্ষণে বিরতি। ভদ্রমহিলা স্নেহের হাসি হেসে বললেন, ও মা, এসো এসো, ভেতরে এসে শোনো। জুতো খুলে ভেতরে ঢুকতেই সেই ভদ্রমহিলা একমুখ হাসি নিয়ে ‘দিলীপকুমার রায়’কে বললেন, এই দেখুন, গোবিন্দগোপালবাবু, আমরা বুড়োরা বলি আজকালকার ছেলেমেয়েরা আমাদের আমলের গান শোনে না, দিলীপকুমার রায়ের গান জানেই না। আর এই দেখুন তিনটি অচেনা ছেলে আপনার গান শুনবেন বলে বাড়িতে কড়া নেড়ে আর্জি জানালেন।
কাঁচুমাচু মুখে আমরা প্রণাম করলাম গোবিন্দগোপাল মুখোপাধ্যায়কে। আমি এক বারও বলব না তিনি দিলীপকুমার রায়কে নকল করে গাইছিলেন। ভরাট সুরেলা কণ্ঠের অধিকারী এই পণ্ডিত, শাস্ত্রজ্ঞ ও রসস্থ মানুষটি তাঁর অন্তরের ভক্তির জায়গা থেকেই দিলীপকুমার রায়ের গান গাইছিলেন। শুধু ভক্তি থাকলেই হয় না, দক্ষতা চাই। দিলীপকুমারের কিছু গান দক্ষতার সঙ্গে গাওয়া ক্ষমতা তাঁর বিলক্ষণ ছিল। জানলার বাইরে থেকে তাঁর গান শুনে আমরা কোনও তফাত করতে পারিনি। তিনি আমাদের সঙ্গে প্রতারণা করেননি। তাঁর আত্মমগ্ন কণ্ঠ ও গায়নদক্ষতা এমনই এক মাত্রায় চলে গিয়েছিল যে ষাটের দশকের তিন বাঙালি তরুণের মনে তিনি ছড়িয়ে দিতে পেরেছিলেন সম্মোহন। দিলীপকুমারের গায়কি এতটাই এক ও অদ্বিতীয় ছিল, বেতারে শুনে এমনই গেঁথে গিয়েছিল তা আমাদের মনে যে, আমরা ধরেই নিয়েছিলাম স্বয়ং দিলীপকুমার গাইছেন। জানলার পাশ দিয়ে যেতে যেতে এক-শোনাতেই আমাদের ধারণা হয়েছিল কিংবদন্তি হয়ে যাওয়া সেই মানুষটি নিজে গাইছেন। কয়েক মুহূর্তের মধ্যে সেই ধারণা পরিণত হয়েছিল বিশ্বাসে। সংগীতে এটা হয়তো সবচেয়ে বেশি সম্ভব।
পঞ্চাশ আর ষাটের দশকে এক ঝাঁক সুরকার অসামান্য কাজ করে গিয়েছেন বাংলা গানে। কিন্তু সে রকম আকর্ষণীয় সুর শুনলেই মনে হত হয় সলিল চৌধুরী, নয় নচিকেতা ঘোষ। অথচ পঞ্চাশের দশকেও অনুপম ঘটক আর পঞ্চাশ-ষাট দুই দশকেই রবীন চট্টোপাধ্যায় ছিলেন। দু’জনেই সুরের জাদুকর। সমানে নিরীক্ষাপ্রবণ, নতুন পথের সন্ধানী। তেমনি কটক থেকে পাঁচ বছর বয়সে কলকাতায় আসার পর যে দুই গায়কের গান বেতারের মাধ্যমে আমার কল্পনাকে দখল করে নিয়েছিল তাঁদের এক জন, মৃণাল চক্রবর্তী, শুধু চোস্ত গায়ক নন, এক অসামান্য সুরকারও। ‘যমুনাকিনারে শাজাহানের স্বপ্নশতদল’ পেড়ে ফেলেছিল আমায়। সকালের আলোমাখা সুর। অনেক পরে জেনেছি এটি মৃণাল চক্রবর্তীর প্রথম গ্রামোফোন রেকর্ড এবং এ গানের লেখক ও সুরকার দিলীপ সরকার। প্রথম শব্দটিতেই তারসপ্তকের ষড়জে কী সাবলীল ভাবে চলে যাওয়া যেন বন্ধ ঘরের জানলা এক ঠেলায় খুলে দিলেন শিল্পী ‘শাজাহানের স্বপ্নশতদল’টিকে দেখাবেন বলে। বলতে দ্বিধা নেই, এর অনেক বছর পর তাজমহলের সামনে প্রথম দাঁড়িয়ে সুরসাগর হিমাংশু দত্তর সুরে শচীন দেব বর্মনের গাওয়া ‘প্রেমের সমাধিতীরে’ গানটি মনে পড়েনি, যদিও সেটি আরও আগে বাবার মুখে শোনা এবং সেটিও মনে গাঁথা হয়ে গিয়েছিল। জীবনে প্রথম তাজমহলের সামনে দাঁড়িয়ে মনে পড়েছিল মৃণাল চক্রবর্তীর গাওয়া গানটি। এক শরৎ-বিকেলের পড়ে আসা আলোয় প্রথম দেখছিলাম তাজমহল। সেই নরম আলোয় হয়তো আমার অবচেতনে দেখতে পাচ্ছিলাম ছেলেবেলার একটি সকালের আলো। সদ্য কলকাতায় আসা একটি ছেলে বেহালার ব্রাহ্মসমাজের মাঠে একা ঘুরে বেড়াতে বেড়াতে শুনে ফেলেছিল পাশের কোনও বাড়ির রেডিয়ো থেকে ভেসে আসা সেই গান। তখন থোড়াই চিনতাম ভৈরবী রাগটিকে, যে রাগে এই গান বাঁধা। বিকেলের আলোয় তাজমহলের সামনে দাঁড়িয়ে ফিরে পেয়েছিলাম সেই সকালটাকে, মৃণাল চক্রবর্তীর গানের স্মৃতিতে। হিমাংশু দত্তর অসামান্য গানটি দু-একটি ব্যতিক্রমী স্বর সত্ত্বেও দরবারি কানাড়ার মেজাজে বাঁধা। রাতের রাগের সাধ্য কী, আলোমাখা ভৈরবী আর মৃণাল চক্রবর্তীর কণ্ঠ ও চনমনে গায়কির স্মৃতিকে ঢেকে দেয়! |
|
|
|
|
|