রিকোর আলমারি
রিকোর ছোটকাকু চাকরি নিয়ে দিল্লি চলে যাওয়ার পর থেকেই কাকুর ঘরটা রিকোর হয়েছে। হয়েছে মানে, এক রকম জোর করেই দখল নিয়েছে রিকো। কারণ, ঘরটা পেলে ওর সুবিধা হবে সেটা ও জানত। সুবিধা এই জন্যে যে ছোটকার ঘরে একটা বড়সড় কাঠের আলমারি আছে।
এখন মা যখনই রিকোকে বলেন, ‘রিকো তোমার ঘর গোছাও!’ রিকো অমনি ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা সব কিছু তুলে আলমারির মধ্যে ঢুকিয়ে দেয়!
পুরনো খেলনা থেকে শুরু করে, না খাওয়া খাবারের প্লেট, নোংরা জামা কাপড় সব কিছু আলমারির মধ্যে ঢুকে যায়। এক বার ঢুকিয়ে দিয়েই রিকো নিশ্চিন্ত, তার পর আর তাকিয়েও দেখে না, কী আছে সেখানে। মাসি আসছেন বলে ঘর গোছাবার সময় লাইব্রেরি থেকে আনা বই দুটো ধাঁ করে আলমারির ভিতর ছুড়ে দিয়েছিল রিকো, তার পর বেমালুম ভুলে গেল সেগুলোর কথা। শেষে বই খুঁজে না পেয়ে অনেক টাকা ফাইন দিতে হয়েছিল বাবাকে ওর জন্যে। তাও রিকোর ভ্রুক্ষেপ নেই। মা যাতে ভিতরে কী আছে না দেখতে পান, সেই জন্যে আবার এক সেট তালা-চাবি জোগাড় করেছে রিকো। মা রেগে যান, কিন্তু রিকো শোনার পাত্র নয়। কেউ আলমারির ধারে কাছে গেলেই চিৎকার করে বাড়ি মাথায় করে! মা-বাবা দু’জনেই চাকরি করেন, তাই ওঁদের সময় হয় না ওর পিছনে লেগে থাকার। মা প্রায়ই বলেন ওটা তো আর আলমারি নেই, ময়লা ফেলার জায়গা হয়ে দাঁড়িয়েছে।
হঠাৎ এক দিন রিকো স্কুল থেকে ফিরে খেতে বসেছে এমন সময় মা বললেন, ‘রিকো তোমাকে ওই ঘর আর আলমারি খালি করতে হবে, সায়ন আসছে এক মাসের জন্যে। ও নিজের ঘরটাতেই থাকতে চায়।’
‘কবে আসছে ছোটকা?’
‘পরশু, হঠাৎ ঠিক হয়েছে।’
রিকোর তো মাথয় বাজ! পরশু মানে ওর হাতে আর মাত্র একটা দিন!
‘ছোটকাকে যদি অন্য ঘরে...?’
‘না, সেটা হয় না রিকো! তুমি পাশের ছোট ঘরটায় থাকবে ওই একটা মাস।’
‘কিন্তু কিন্তু...’
ছবি: সুমিত্র বসাক
‘হ্যাঁ, জানি ছোট ঘরে আলমারি নেই! সেটাই একটা বাঁচোয়া! ওই আলমারির মধ্যে যে কী সাপ-ব্যাঙ-ছুঁচো লুকিয়ে আছে তার নেই ঠিক! আমি হাত দিচ্ছি না বাবা! তুমিই পরিষ্কার করবে।’
রিকো তো মহা সমস্যায় পড়ে গেল। সঙ্গে সঙ্গে ফোন করে ওর প্রাণের বন্ধু ফচকেকে ডাকতে সে এসে হাজির হল।
রিকো তাকে বলল, ‘দেখ এই আলমারিটাকে ওই ছোট ঘরে টেনে নিয়ে যেতে হবে!’
‘তোর কি মাথা খারাপ হয়েছে! ওই ঘরে এই দৈত্য ঢুকবে? দরজাতেই আটকে যাবে!’ ফচকে বলল।
ফচকে চট করে বাড়ি থেকে একটা ফিতে টেপ নিয়ে এসে মাপজোক করে বলল, ‘যদি আলমারিটাকে কেটে অর্ধেক করতে পারিস, তা হলে ঢুকবে!’
‘না, সেটা সম্ভব নয়! কী করি? ছোটকা আসছে আর এই ঘরেই থাকবে একটা মাস।’
ফচকে বলল, ‘তোর একটাই পথ, আলমারি পরিষ্কার করা!’
রিকোর মাথায় বাজ! আলমারি পরিষ্কার করা কী যে সে কাজ! দেড় বছর ধরে জঞ্জাল জমা হয়েছে!
‘ঠিক আছে, কাল আমি আসব। দু’জনে মিলে পরিষ্কার করলে তাড়াতাড়ি হয়ে যাবে। তুই দুটো বস্তা জোগাড় করে রাখিস ভিতরের সব জিনিস ফেলতে কাজে লাগবে।’
রিকোর মুখে হাসি ফুটল, ‘তুই আসবি?’
‘হ্যা।ঁ’
‘ঠিক আছে তা হলে কালকে কাজটা করা যাবে। চল তা হলে এখন খেলতে যাই।’
মাঝ রাতে হঠাৎ দুমদাম শব্দে ঘুমটা ভেঙে গেল রিকোর। নাইট ল্যাম্পের নীল আলোতে সে দেখল বীভৎস এক জীব দাঁড়িয়ে রয়েছে ওর বিছানার ধারে। ওই রকম ভয়ানক মুখ সে জন্মে দেখেনি।
কাঁপা গলায় রিকো জিজ্ঞেস করল, ‘কে, কে তুমি? কী চাও?’
‘আমি আলমারির থেকে বেরিয়েছি!’
‘অ্যাঁ!’
‘তুমি কি ভাবছিলে আলমারিতে যা খুশি ঢুকিয়ে তুমি পার পেয়ে যাবে? তুমি যেমন আমাকে অনেক আজেবাজে জিনিস উপহার দিয়েছ, আমিও তোমার জন্যে আমার পছন্দের কিছু জিনিস উপহার এনেছি!’ বলে একটা বিশাল বড় লোমশ মাকড়সা তুলে ধরল ভয়ানক জীবটা!
জীবটা আবার বলল, ‘শুধু এটা নয় এটাও আছে!’ আলমারির দানবের আর এক হাতে একটা বড়সড় কাঁকড়াবিছে! এতক্ষণে লক্ষ করল রিকো যে, জীবটার গলায় পেঁচানো রয়েছে একটা সাপ!
একটা বাটি দেখিয়ে সে রিকোকে বলল, ‘এটা তোমায় খেতে হবে! আমি ব্যাঙের নাড়িভুঁড়ি, উচ্চিংড়ে আর গঙ্গাফড়িং দিয়ে এটা তৈরি করেছি তোমার জন্যে। তোমার আধ খাওয়া কেক, আর অন্য এঁটোকাঁটা খাবার খেয়ে খেয়ে আমি ক্লান্ত!’
‘না, না, আমি কালকেই আলমারি পরিষ্কার করে ফেলব, ফচকের সঙ্গে কথা হয়ে গিয়েছে।’
‘ফচকে? ফচকে কেন আসবে? সে তো কিছু ঢোকায়নি আলমারিতে! ঢুকিয়েছ তো তুমি! শাস্তি তোমাকে পেতে হবে! তোমাকে ওই আলমারিতে বন্ধ করে রাখব আমার এই সব প্রিয় জিনিসের সঙ্গে।’
বিশাল মাকড়সা, কাঁকড়াবিছে, সাপ আর বাটি ভর্তি ব্যাঙের নাড়িভুঁড়ি নিয়ে জীবটা রিকোর দিকে এগিয়ে এল ওর ঘাড়টা ধরবে বলে!
ভয়ে পরিত্রাহি চিৎকার শুরু করে দিল রিকো আর অমনি ঘরের আলোটা জ্বলে উঠল।
‘ছেড়ে দে সায়ন! শেষে অন্য বিপদ হলে মুশকিল হবে। এত রাতে ওই রকম চেঁচামেচি শুনলে প্রতিবেশীরা ছুটে আসবে!’ বলতে বলতে বাবা ঘরে ঢুকলেন, সঙ্গে মাও।
বাবার কথায় বীভৎস জীবটা তার মুখে পরা মুখোশটা খুলে ফেলে বলল, ‘দিলি তো মজাটা নষ্ট করে!’
রিকো হাঁ করে দেখল, ওমা! এ তো ছোটকা! তোমার তো রবিবার আসার কথা ছিল ছোটকা, তুমি আজকে এলে কী করে?
‘তোদের চমকে দেব বলে চলে এলাম! এসে শুনলাম তুই আমার সাধের আলমারিটার বারোটা বাজিয়ে ছেড়েছিস!’
রিকো কথা ঘুরিয়ে বলল, ‘তোমার হাতের ওই সব মাকড়সা, সাপগুলো কি সত্যি?’
‘না, ওগুলো জোজোর জন্যে এনেছি। ওর সাপ, ব্যাঙ, পোকা-মাকড় খুব পছন্দ! আমাকে বিশেষ করে বলে দিয়েছিল ওই সব আনতে। বউদির কাছে আলমারির গল্প শুনে আমার মনে হল তোকে একটু শিক্ষা দেওয়া দরকার!’
শনিবার দিন সারা সকাল ধরে ছোটকার সঙ্গে আলমারি পরিষ্কার করতে হল রিকোকে। ফচকে এসেছিল বটে, কিন্তু ওকে কিচ্ছুটি করতে দিল না ছোটকা, তাই ও দাঁড়িয়ে মজা দেখল!
কত কিছু যে বেরোল ভিতর থেকে তার ঠিক নেই! মা’র হারিয়ে যাওয়া কাপ-প্লেট-চামচ, তাতে খাওয়া আধ খাওয়া খাবারের অংশ, লাইব্রেরির বেশ কিছু বই, অসংখ্য খেলনা, এমনকী জোনাইয়ের হারিয়ে যাওয়া পুতুলটাও। আলমারির ভিতরটার এতই শোচনীয় অবস্থা ছিল যে গ্যামাক্সিন দিয়ে সেটাকে আর ঘরটাকে পরিষ্কার করতে হল। পিঁপড়ে হয়ে গিয়েছিল ভিতরে!
রিকো এখন ছোট ঘরটায় থাকে। ওর ঘরে আলমারি নেই, তবে আলমারি চায় না রিকো! না, ছোটকার ওই কিম্ভূত জীব সাজাতে সে ভয় পায়নি, কিন্তু ছোটকা ওকে সবার কাছে নিয়ে গিয়ে ক্ষমা চাইয়েছেন! লাইব্রেরিতে গিয়ে বই ফেরত দেওয়ার সময় একঘর ভর্তি লোকের সামনে ওকে বলতে হয়েছে নিজের কীর্তির কথা! ওরা বই নিয়েছে বটে, কিন্তু টাকা ফিরিয়ে দেয়নি, সে রকম নাকি নিয়ম নেই, ওটা ফাইন ছিল। আলমারির মধ্যে থেকে ওর যত খেলনা বা জামাকাপড় বেরিয়েছে সব ওকে দিয়েই পরিষ্কার করিয়ে বাক্সে ভরে গরিব শিশুদের দান করে দিয়েছে ছোটকা। জোনাইকেও সরি বলতে হয়েছে রিকোকে! ওর কাণ্ড শুনে জোনাই তো হেসেই কুটিকুটি! ওই রকম নাকাল আর কোনও দিন হতে চায় না রিকো, তাই আলমারি ছাড়াই সে খুশি!


First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.