কর্ষণের অযোগ্য কাঁকুরে বন্ধ্যা জমি ঘিরে সবুজের স্বপ্ন দেখছেন অশ্বিনী ভূমিজ।
কেবল তিনি নন, দেখছে বাঁকুড়ার বনপুসরা গ্রামের ১২০টি পরিবার। কিংবা বাঁকুড়া, পুরুলিয়া ও বীরভূমের কিছু বন্ধ্যা জমির মালিক, ছোট ও প্রান্তিক চাষিও।
বনপুসরা গ্রামের প্রায় ৮০ হেক্টর কাঁকুরে জমিতে ‘রাজ্য পতিত জমি উন্নয়ন নিগম’-এর সঙ্গে যৌথ ভাবে অরণ্য সৃষ্টির কাজ করছেন গ্রামবাসী। গ্রামের প্রান্তিক চাষি অশ্বিনী ভূমিজর কথায়, ‘‘কাঁকুরে জমিতে এখন নিম, শিশু, আকাশমণি, ইউক্যালিপটাস, করঞ্জ, মিনঝুড়ি বেড়ে উঠছে।’’
পুরুলিয়ার হুড়া ব্লকে গুড়দা মৌজার বাসিন্দা তারাপদ রায় বলেন, ‘‘এখানে জমি এতই শুকনো আর অনুর্বর যে ঘাস পর্যন্ত জন্মায় না। সেই জমিতে এখন গাছ বাড়ছে।’’ গাছ লাগানো হয়েছে জগররা, আলোকডি, পঞ্চারি, কলাবনি, তিলবনি, দেউলি মৌজার পতিত জমিতেও।
বাঁকুড়ার ঝুঁঝকা গ্রামের রঞ্জিত মণ্ডল জানান, তাঁর গ্রামে যে ১৬টি পরিবারের বাস, তাঁরা সকলেই পতিত জমি উদ্ধারের প্রকল্পে যুক্ত হয়েছেন। প্রায় ৩৫ হেক্টরে বনসৃজন হয়েছে। ওই সব জমির মালিকেরা সবাই প্রান্তিক বা ছোট চাষি। যার যতটুকু পতিত জমি ছিল সবটাতেই গাছ লাগানো হয়েছে। গাছ যেভাবে বাড়ছে তাতে রঞ্জিতবাবুর ধারণা, সাত বছরের মধ্যে সেগুলি কেটে বিক্রি করা যাবে। |
রাজ্য পতিত জমি উন্নয়ন নিগমের সঙ্গে গ্রামবাসীর ১৫ বছরের চুক্তি হয়েছে। কমবেশি সাত বছর পরপর দু’বার গাছ কেটে বিক্রি করা হবে। জমি বিক্রির টাকার ২৫ শতাংশ পাবেন গ্রামবাসী। জমির মালিকানার অনুপাতে পাবেন বাকিটা। চুক্তির মেয়াদ শেষে ওই অরণ্য গ্রামের সম্পত্তি হয়ে যাবে। গাছ বিক্রির টাকা ছাড়াও জমি তৈরি, গাছ লাগানো, প্রথম বছর প্রয়োজন মতো গাছে জল দেওয়া ইত্যাদি যাবতীয় কাজ একশো দিন কাজের প্রকল্পে গ্রামের লোকদের দিয়েই করানো হয়েছে। এ ছাড়া, নতুন তৈরি ওই জঙ্গল দেখভালের জন্য গ্রামে যে কমিটি তৈরি হয়েছে, তাকে মাসে দু’হাজার টাকা করে দেয় নিগম। রঞ্জিতবাবু বলেন, ‘‘ওই টাকা গ্রামের নানা রকম উন্নয়নের কাজে লাগে।’’ ১৯৯৮ সালে তৈরি ওই নিগম কাজ শুরু করেছে ২০০৯ সাল থেকে। সেই কাজ কেবল পতিত জমিতে গাছ লাগানোর মধ্যেই সীমাবদ্ধ নয়। ছোট ছোট জোড়বাঁধ (চেক ড্যাম) তৈরি করে বৃষ্টির জল ধরে রেখে তা দিয়ে শুখা জমিতে সেচের ব্যবস্থা করাও তাদের কাজের মধ্যে পড়ছে। গত তিন বছরে বাঁকুড়া জেলায় এখনও পর্যন্ত সাতটা জোড়বাঁধ তৈরি হয়েছে। তার সুফলও পেতে শুরু করেছে গ্রাম।
অশ্বিনীবাবু জানান, তাঁর গ্রামের কাছেই আমলাজোড়ে একশো দিন কাজের প্রকল্পে একটি বাঁধ হয়েছে। তার জন্য কোনও ইঞ্জিনিয়ার দরকার হয়নি। গ্রামের মানুষের অভিজ্ঞতা ও চিরাচরিত জ্ঞান দিয়েই কাজ হয়েছে। এত দিন স্থানীয় বড়ড়া, রাধানগর, লেদাপলা, গবড়াশোল মৌজা থেকে বৃষ্টির জল আমলাজোড় হয়ে বয়ে চলে যেত। তা ব্যবহারের কোনও উপায় ছিল না। এখন জোড়বাঁধ হওয়ার ফলে সেখানে আশপাশের এলাকার বৃষ্টির জল জমছে। বনপুসরা, বড়ড়া, রাধানগর, লেদাপলা, গবড়াশোল মৌজার মানুষ তা দিয়েই এই প্রথম ধানের পরে গম, সর্ষে, আলু, পেঁয়াজ, টমেটো চাষ করছেন। অশ্বিনীবাবুর আশা, “ভাল বৃষ্টি হলে আমরা তিনটে ফসলও করতে পারব।”
নিগমের অধিকর্তা রাকেশ সিংহ জানান, এক দিকে অনুর্বর পাথুরে পতিত জমিতে গাছ লাগিয়ে সবুজ করা, অন্য দিকে নিচু জমিতে ছোট বাঁধ তৈরি করে ভূপৃষ্ঠের জল সংরক্ষণ (সয়েল ময়েশ্চার কনজারভেশন) করাই তাঁদের কাজ। এখনও পর্যন্ত বাঁকুড়া, পুরুলিয়া, বীরভূম ও পশ্চিম মেদিনীপুরের প্রায় ৭০ হাজার হেক্টর পতিত জমি চিহ্নিত করা হয়েছে। গত তিন বছরে সাড়ে সাত হাজার হেক্টর জমিতে গাছ লাগানো এবং সাতটি জোড়বাঁধ তৈরি করা সম্ভব হয়েছে।
রাকেশবাবুর কথায়, “অনেক পরিবার এবং গোটা গ্রামকে প্রকল্পে যুক্ত হওয়ার জন্য রাজি করাতে সময় লাগে। কাজটা একশো দিন কাজের প্রকল্পের সঙ্গে যুক্ত হওয়ায় তাদের বরাদ্দের উপরেও নির্ভর করতে হয়। তবু পুরুলিয়ার নডিহা, তিলাবনি, কলাবনি ও দেউল মৌজায় বর্ষার আগেই কয়েকটি জোড়বাঁধ তৈরি করার চেষ্টা চলছে।” |